“মধ্যযুগীয় মানুষ হলেও—ব্রাহ্মণ এবং ভূস্বামীর আশ্রয়ে কাব্যরচনা করলেও আমাদের কবি ঠিক সামন্ততান্ত্রিকতাগ্রস্ত হননি।”—তোমাদের পঠিত কাব্যা অবলম্বনে এই অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে তোমার নিজের মতটি যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করো।

সাহিত্যে আমরা সমাজের একটা সুস্পষ্ট ছবি দেখতে পাই। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। কবিরাও মানুষ, সমাজকে এড়িয়ে তাঁরা সাহিত্য রচনা করতে পারেন না। সাহিত্যের মধ্য দিয়েই সমাজ জীবনের ছবি চিত্রিত হয়। সাহিত্যই সমাজ জীবনের দর্পণ। বাস্তববাদী কবিরা সমাজকে পরিবেশকে বাদ দিয়ে সাহিত্য রচনা করতে পারেন না। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম ব্রাহ্মণ, ভুস্বামীর আশ্রয়ে কাব্য রচনা করেছেন সামন্ততান্ত্রিকতার প্রেক্ষিতে। কবি-কঙ্কণের সমাজ চিত্রাঙ্কন সম্পর্কে অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী মন্তব্য করেছেন— “সাহিত্যে যাহারা সমাজচৈতন্য খোঁজে চণ্ডীকাব্য তাহাদের লুটের মহাল। এত সমাজ চৈতন্য আর কোনো কাব্যে আছে কিনা জানি না।”


কবিকঙ্কণের কাব্যে সমাজচেতনার যে দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে তা অন্য কোনো কাব্যে উদ্‌ঘাটিত হয়নি। সেটি হল তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশের অন্তর্বর্তী কৃষক জীবন। এই কৃষক জীবনের পরিচয় পাওয়া রায় কাহিনির তিনটি পর্যায়ে- গ্রন্থোৎপত্তির বিবরণ, পশুদের বিলাপ এবং কালকেতুর গুজরাট নগর পত্তন অংশে।


গ্রন্থোৎপত্তির বিবরণ : গ্রন্থোৎপত্তির কারণের সঙ্গে ইতিহাসের কোনো গূঢ় সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু চণ্ডীকাব্যের এই অংশটি একান্তভাবে ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণী। এ কাহিনির দুটি অংশ আছে– (১) সমসাময়িক সমাজের একটি বাস্তবনিষ্ঠ প্রতিবেদন। (২) কবির নিজস্ব কাহিনি।


সমকালীন ইতিহাসের চিত্রটিতে সামস্ততান্ত্রিক ও কৃষকজীবনের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। রাজা মানসিংহ ছিলেন বিহার-উড়িষ্যা ও বাংলার সুবেদার। দিল্লির বাদশার অধীনে তিনি ছিলেন সামন্তরাজা। কবিকঙ্কণের কাব্যে ঐকালের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে উচ্চশ্রেণির সঙ্গে প্রজাদের কোনো সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায় না। কর্তার অধীনস্থ কর্মচারীরা প্রত্যক্ষভাবে প্রজাদের উপর শাসন চালাত। রাজা মানসিংহ সমগ্র দেশকে কয়েকটি পরগণায় ও প্রত্যেক পরগনাকে কতকগুলি ডিহিতে ভাগ করে দিয়েছিলেন। ডিহিতে ডিহিদার থাকত একজন। সমগ্রদেশের শাসন ক্ষমতা তার হাতে। অতএব ডিহিদার প্রমুখ কর্মচারীরাই সামস্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নিয়ামক ছিল।


মুকুন্দরাম তাঁর বসবাস প্রসঙ্গে বলছেন—

“সহর সিলিমাবাজ   তাহাতে সজ্জনরাজ

নিবসে নিয়োগী গোপীনাথ।

তাঁহার তালুকে বসি   দামুন্যায় চাষ চষি

নিবাস পুরুষ ছয় সাত।।”


অতএব ডিহিদার যেমন সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতীক, কবিবেও তেমনি কৃষক প্রজার প্রতীক বলে গণ্য করা যায়। কবি এখানে শুধু নিজের কথা বলেননি—ডিহিদারের অত্যাচারে কৃষক কুল কীভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে তার বস্তুনিষ্ঠ ছবিও এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন।


সামস্ততন্ত্রকে বিধাতার অভিপ্রায় বলে বিবেচনা করা হত বলে সামন্তরাজ মানসিংহের বিরুদ্ধে কোনও কটাক্ষ করেননি কবি। তিনি বলেন—‘প্রজার পাপের ফলে, ডিহিদার মামুদসরীফ।” ওই ডিহিদারই সামন্ত রাজের অত্যাচারী প্রতিনিধি। কবি মনে করেন ডিহিদার রায়জাদার পরামর্শে প্রজাদের উপর জুলুমবাজি চালান। এতদিন পর্যন্ত ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবদের মর্যাদা দেওয়া হত। তাদেরও ডিহিদার শত্রু করে তুললো।

প্রজাদের করুণ অবস্থার বর্ণনা—

“প্ৰজা হৈল ব্যাকুলি   বেচে ঘরের কুড়ালি 

টাকা দ্রব্য বেচে দশ আনা।।”


মুকুন্দরামও এই অবস্থার শিকার হয়েছিলেন। হিতৈষীদের পরামর্শে রাতের অন্ধকারে আত্মীয় পরিজন সহ ভিটা ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। বহু পরিশ্রমে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভুস্বামী বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় গ্রহণ করলেন।


পশুদের বিলাপ : কালকেতুর অত্যাচারে বনের পশুগণ দেবী চণ্ডীর কাছে তাদের দুর্দশা এমন ভাবে বর্ণনা করেছে, যেন ডিহিদারের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে কৃষক প্রজারাই কাতর ক্রন্দনে ভেঙ্গে পড়েছে। এখানে কালকেতু অত্যাচারী সমাস্ততন্ত্রের প্রতীক এবং পশুগণের কাতর ক্রন্দন প্রজাদের ক্রন্দনের প্রতীক হিসাবে চিত্রিত হয়েছে। অত্যাচারিত প্রজাগণ পশুদের মুখ দিয়ে যেন নিজের ভাগ্য বিড়ম্বনাকে প্রকাশ করেছে।


কালকেতুর প্রজাপত্তন : কবি সাতপুরুষের ভিটা ত্যাগ করে পথে নামার যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে সুমাজব্যবস্থার একটা সুন্দর স্বচ্ছ রূপকে ফুটিয়ে তোলার জন্য কালকেতু কর্তৃক প্রজাপত্তনের ব্যাপারে যত্নশীল হয়েছেন। এখানেও সামন্ত্রতন্ত্র লক্ষিত, কিন্তু তা স্বেচ্ছাচারী নয়। নতুন নগরে কালকেতু যে প্রজাদের সুযোগ সুবিধা দিয়েছে তাতে তার হিতকারিতার ছবি ফুটে উঠেছে।


বুলান মণ্ডলের উদ্দেশে তার বক্তব্যে তা প্রকাশ পায়—

"আমার নগরে বৈস    যত ইচ্ছা চাষ চাষ

তিন সন বহি দিহ কর। 

হাল প্রতি দিবে তঙ্কা   কারে না কারিও শঙ্কা

পাট্রায় নিশান মোর ধর।।"


বলাবাহুল্য কবি কল্পিত এই সমাজ ব্যবস্থা সেকালে ছিল না বললেই হয়। কবি কৃষকদের, অত্যাচারিত মানুষদের যে নিদারুণ অবস্থাকে দেখেছিলেন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। তাই বলা যায় কবি সামন্ততান্ত্রিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সমাজের ছবি এঁকেছেন। এটাই কবির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।