বাংলা কাব্যসাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩ খ্রীঃ -১৯১৩ খ্ৰীঃ)

বাংলা কাব্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়


নাট্যকারের কাব্যচর্চার দৃষ্টান্ত ইংরেজী সাহিত্যে বিরল ব্যাপার নয়। শেক্‌সপিয়র থেকে ইয়েটস-এলিয়ট পর্যন্ত অনেকেই এ ব্যাপারে কৃতী পুরুষ। বাংলা সাহিত্যে তুলনীয় দৃষ্টান্ত মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথের পরেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবিতাকে ভিন্ন ভবিতব্যের দিকে যিনি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কবি বিহারীলালকে অনুসরণ করে আত্মগত ভাবকল্পনার মধ্যে দার্শনিক ব্যঙ্গ্যার্থের সন্নিবেশ আদর্শ হয়ে উঠেছিল উত্তরসূরীদের কাছে। তারপরে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শাতীত ভাবকল্পনা, সীমা-অসীমের মিলনতত্ত্ব, প্রেমের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভব-চিত্র দর্শনে কবি ও পাঠকেরা হয়েছিলেন বিমুগ্ধ। এই বিবশ আবেশের ফলে সেই সময়কার কবিতায় দেখা দিয়েছিল ব্যঞ্জনার নামে অস্পষ্টতা, প্রেমোচ্ছ্বাসের বিহ্বল ভাবালুতা। এর প্রতিক্রিয়ায় দ্বিজেন্দ্রলাল প্রত্যক্ষ সচেতন অনুভব-অভিজ্ঞতাকেই কবিতার বক্তব্য ব'লে মেনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে তার এই প্রতিক্রিয়া ‘কাব্যের অভিব্যক্তি’ (প্রবাসী, ১৯০৬ কার্তিকে), 'কাব্যের উপভোগ’ (নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ, মাঘ) প্রভৃতি প্রবন্ধে তীব্র ভাষায় আত্মপ্রকাশ করেছিল - .....যদি স্পষ্ট করিয়া লিখিতে না পারেন, সে আপনার অক্ষমতা। তাহাতে গ করিবার কিছুই নাই। অস্পষ্ট হইলেই অগভীর হয় না; কারণ ডোবার পঙ্কিল জলও অস্পষ্ট, স্বচ্ছ হইলে Shallow বা অগভীর হয় না; কারণ সমুদ্রের জলও স্বচ্ছ; অস্পষ্টতা লইয়া বাহাদুরী করিয়া "miraculous" দাবী করিয়া স্পষ্ট কবিদের ব্যঙ্গ করিবার কারণ নাই। অস্পষ্টতা একটা দোষ; গুণ নহে”


এই আক্রমণে শালীনতার অভাব ও অদূরদর্শিতা দুইয়েরই পরিচয় মেলে। অবশ্য “রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল এই দুই গুণী এককালে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে মনাস্তর ঘটার মূলে রবীন্দ্রভক্ত ও দ্বিজেন্দ্রপক্ষদের উন্মত্ত উস্কানী ছিল” (দ্রষ্টব্য : নিত্যপ্রিয় ঘোষ ‘স্বভাবত ও স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ’, পৃষ্ঠা ২৪-৪৪)। পরবর্তীকালে কবিপুত্র দিলীপ রায় রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসেন। রবীন্দ্রনাথের স্নেহ লাভ করে পিতার অনাবধনতার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন।


দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম ও কর্মজীবন:

১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দের ১৯ জুলাই কৃষ্ণনগরের প্রসিদ্ধ দেওয়ান বংশে দ্বিজেন্দ্রলালের জন্ম হয়। তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের দেওয়ান, ‘ক্ষিতিশ বংশাবলী চরিত' এবং '‘আত্মজীবনচরিত’ রচয়িতা। চরিত্রমাহাত্ম্যে ও বাংলা-ইংরেজী ও ফার্সীভাষার পারদর্শিতায় কার্তিকেয়চন্দ্র বিদ্যাসাগর-মধুসূদন-দীনবন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ নবযুগের মনীষীদের বন্ধুত্ব লাভ করেন। স্বভাবতই সাহিত্যচর্চার পারিবারিক উত্তরাধিকার দ্বিজেন্দ্রলালের ছিল। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজেন্দ্রলাল এবং তৃতীয় ভ্রাতা জ্ঞানেন্দ্রলালের কাছে তাঁর ইংরেজী শিক্ষালাভ। প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ইংরাজী সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম. এ. পাশ করার পর দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দে স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য ইংলন্ডে যান। সেখানে বিদেশী সঙ্গীত চর্চা করেন। কেবল সঙ্গীত নয়, শেলি-কীটস-ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ কবিদের রচনাপাঠে মনোনিবেশ করেন। তাঁর নিজের ভাষায় : “বিলাতে গিয়া ক্রমাগত Shelley পড়িতাম ও তথা হইতে প্রত্যাগত হইয়া ক্রমাগত Wordsworth ও Shakespeare পড়িতাম।” (দ্রষ্টব্যঃ ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’ : দেবকুমার রায়চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১৯৯) স্যার এডুইন আর্নল্ডকে উৎসর্গ করে তার ইংরেজী কবিতা সমগ্র ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে 'The Lyrics of Ind' নামে প্রকাশিত হয়।


দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা কবিতায় আনতে চেয়েছিলেন স্বাভাবিক ইন্দ্রিয়াবেগের প্রত্য স্ফূর্তি, সেইসঙ্গে সামাজিক ও নৈয়ায়িক বাস্তববুদ্ধি। উপরন্তু, বাংলা কবিতার মধ্যে মননের প্রাধান্য বিস্তার করে বিদেশী প্যারডির অনুভাবনায় বিশুদ্ধ রুচির হাসির গান লিখে কাব্যের সীমান্ত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাংলা কবিতায় ইংরেজী শব্দ বসিয়ে মৌখিক রীতি প্রবর্তনেও তার কৃতিত্ব দেখা যায়।


দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাব্যগ্রন্থ:

'আর্যগাথা' (১ম ভাগ ১৮৮২, ২য় ভাগ ১৮৯৩), 'The Lyrics of Ind' (1886), '‘আষাঢ়ে' (১৮৯৯), 'হাসির গান' (১৯০০), 'মন্দ্র' (১৯০২), ‘আলেখ্য' (১৯০৭), 'ত্রিবেণী' (১৯১২)।


দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাব্য-সংক্রান্ত প্রবন্ধ:

কাব্যের অভিব্যক্তি’, (১৩১৩, কার্ত্তিক ‘প্রবাসী’, ‘কাব্যের উপভোগ’, (১৩১৪ মাঘ 'বঙ্গদর্শন'), 'কাব্যের নীতি', (১৩১৬, জ্যৈষ্ঠ, ‘সাহিত্য’)।


‘আর্যগাথা’ কাব্য ঈশ্বর-প্রকৃতি আত্মানুভূতি এবং স্বদেশানুভূতির বিষয়ে সমৃদ্ধ। ঈশ্বর ও প্রকৃতিমূলক কবিতার মধ্যে মানবলোক ও দেবলোকের মধ্যে সম্বন্ধ-সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা আছে।


কবির দৃষ্টিতে প্রকৃতিই বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের আধার

“চাই না বিজ্ঞান, চাই না জ্যোতিষী,

জানিতে কি দ্রব্য এই রূপরাশি, 

কেবল তারাকে এই ভালবাসি

ও জ্যোতি আঁধারে।”


‘আর্যগাথা’ কাব্যের ‘বিষাদোচ্ছ্বাস’ কবিতায় প্রকৃতির বিষাদ-ভাব পরিস্ফুট। এই বিষাদ-ভাব আবার 'The Lyrics of Ind'-এর মানসী প্রতিমাকে আশ্রয় করে এক নতুন রসের অবতারণা করেছে। এই কাব্যের আত্মানুভূতি-বিষয়ক কবিতাগুলির মধ্যে কবি মনের রোমান্টিক প্রবণতার পরিচয় সুস্পষ্ট। ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে ইতিহাসচেতনা এবং স্বদেশচেতনার প্রকাশ 'আর্যবীণা' অংশে লক্ষ্য করা যায়। এখানে স্বদেশপ্রেমের গানে স্বদেশের ধারণাটি যতটা কল্পনাময়, ততটা অভিজ্ঞতা নির্ভর নয়। স্বদেশচেতনার সঙ্গে প্রেম স্বপ্নেরও এক অস্পষ্ট সম্পর্ক অনুভব করা যায়।


‘আর্যগাথা’ কাব্যের দ্বিতীয় ভাগে আছে মানবপ্রেমের প্রকাশ। এই অংশে মূল প্রেরণা, নারী প্রেম। কবি-পত্নী তার উৎস স্বরূপ। বিহারীলাল রবীন্দ্রনাথের মতো দ্বিজেন্দ্রলাল দেশে-বিদেশে তাঁর মানসী-প্রতিমার পূর্বরূপ অনুসন্ধানে রত হয়েছেন।


এই নারী রূপের অন্তরালে প্রকৃতি-সৌন্দর্য হয়েছে অন্তর্হিত। ফলে নৈর্ব্যক্তিক রূপতন্ময়তা ব্যক্তিমানবীর সান্নিধ্যে হয়েছে ব্যাহত। লিরিকের সুর-মূর্ছনা স্থূল চিন্তার নুড়ি পাথরে লেগে বেসুরে বেজে উঠেছে।


এই গ্রন্থে আছে দুটি ভাগ, ‘কুহু’ ও ‘পিউ’। এখানে ইংরেজী ও স্কচ্ গানগুলি হল : 'Home, sweet Home', 'Lines to an Indian air', 'Under the greenwood tree', 'Weep no more, Ladies', 'Rule Britania' প্রভৃতি। স্কচ্-সঙ্গীতের মধ্যে আছে Auld Long Syne', 'Robin Adiar', 'Land of the Leal', 'Annic Laurie', 'Blue bells of Scotland' 'Auld Robin Gray' ইত্যাদি। আর আইরিশ গানের মধ্যে আছে 'Last Rose of Summer' এবং 'Go where glory waits thee'; দ্বিজেন্দ্রলাল তার গানে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মধ্যে সুর ও ভাবগত মিলনের চেষ্টা করেছিলেন।


দ্বিজেন্দ্রলাল 'The Lyrics of Ind' কাব্যটির মধ্য দিয়ে ইংরেজী ভাষার কাব্যভাবনার মিলনসূত্র রচনা করতে চেয়েছিলেন। কাব্যের ভূমিকায় তিনি বলেছিলেন "My principal object in the composition of the following verses has been to harmonise English and Indian Poetics as they ought to be."


দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাস্যরসাত্মক কাব্য:

'আষাঢ়ে' কাব্যটি ইংরেজী ব্যঙ্গকাব্যের অনুসরণে রচিত। এ সম্পর্কে কবির নিজের স্বীকারোক্তি : “বিলাত হইতে ফিরিয়া বাঙ্গলা ভাষার হাস্যরসাত্মক কবিতার অভাব পুরণ করিবার অভিপ্রায়ে Ingoldsby Legends-এর অনুসরণে কতকগুলি হাস্যরসাত্মক বাঙ্গলা কবিতা লিখিয়া ‘আষাঢ়ে’ নামে প্রকাশ করি”। Rev. Richard Haris Barham-এর 'Ingoldsby'-র গল্প বলার ভঙ্গী, ছন্দ ও ভাষার বৈশিষ্ট্য, হাস্যকর কবিতা-পক্তির মিল দ্বিজেন্দ্রলালকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে ‘আষাঢ়ে’ কাব্যেও দেখা যায়— (ক) ‘ভট্টসভা’তে প্রাচীন কাহিনীর ব্যঙ্গাত্মক অনুসরণ, (খ) বিচিত্র ভাঙা ছন্দের মিশ্রণ, (গ) কোমল ও শুদ্ধ স্ল্যাঙের ব্যবহার, (ঘ) চার-পাঁচটি ভাষার মিশ্রণ ও উদ্ধৃতি, (ঙ) শব্দ ভেঙে পরের অংশ দিয়ে পরবর্তী পক্তির সূচনা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসমূহ।


‘হাসির গান’ কাব্যটিও কবি বারহামের 'Ingoldsby Legend's-এর দ্বারা অনুভাবিত। ‘Ingoldsby’-তে তিন-চার শতকের ঘটনাসমূহকে একত্র করে কালাতিক্রমণ দোষ ঘটিয়ে উদ্ভট ঘটনা ও চরিত্র রচনা করে হাস্যরস সৃষ্টি করা হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালও এখানে তানসেন-বিক্রমাদিত্য সংবাদ, রাম বনবাস, দুর্বাসা, কালোরূপ, কৃষ্ণরাধিকা সংবাদ প্রভৃতি প্রসঙ্গের মধ্যে কালগত অসঙ্গতি দেখিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। পৌরাণিক প্রসঙ্গের পাশাপাশি সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের অসঙ্গতিও এখানে বিদ্রূপের বিষয় হয়ে উঠেছে। সেই অর্থে 'Reformed Hindoos’, ‘বিলাত ফের্তা’, ‘নতুন কিছু করো’, ‘হল কি’, ‘তা সে হবে কেন’, ‘বদলে গেল মতটা’, ‘কবি চণ্ডীচরণ' প্রভৃতি গানে সমাজ-সমালোচনার পরিচয় আছে। কর্তৃত্বপ্রিয় দেশপ্রেমিক, অপদার্থ হিন্দুধর্ম ব্যাখ্যা তা, অহঙ্কারী ভাবুক, দুর্বোধ্য রচনাকার, প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীল এবং নারীমুক্তির বিরোধীরা সকলেই বিদ্রূপের পাত্র। সমকালের কবি, নাট্যকার, সমাজব্যাখ্যাতা ও দার্শনিকদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের উন্মত্ততার আভাস আছে অনেক গানে ও কবিতায়

“না পড়েছে Shakespeare না পড়েছে Ganot..

Adam Smith-এর Political Economy জানে না, 

Malthus এর Theory of Population মানে না...

Huxley, Tyndall, Spencer, Mill-এর ধারও ধারে নাক”।


বিলাতী হিউমার ও ব্যঙ্গের সঙ্গে দেশীয় শ্লেষের সংমিশ্রণে, বাংলা গানে ইংরেজী শব্দ বসিয়ে, নতুন সুর ও গীতিপদ্ধতি দেখিয়ে সত্যই “দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান বাঙ্গালী সমাজে একটা ভাববিপ্লব ঘটাইয়াছিল” (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়)।


‘মন্দ্ৰ' কাব্যে দেখা যায় গীতিকার এবং তার্কিক কবি-চিত্তে দুই স্ববিরোধী সত্তার অবস্থান। এই কাব্যের বৈশিষ্ট্য হল : (ক) কল্পলোক এবং কঠিন সংসারের টানাপোড়েনে কবির অসুস্থ এবং অস্থির মনের প্রকাশ (যেমন 'স্বপ্নভঙ্গ' কবিতা) নিসর্গ জগতের কল্পনাময় মাধুর্য থেকে বিজ্ঞানের কর্মময় কঠিন জগতে পতন

“কি প্রভেদ। লীলাময়ী কল্পনার পরিবর্তে 

এই দৈনন্দিন গদ্য' এ প্রভেদ স্বর্গে মর্ত্যে। 

হায় সত্য! হা বিজ্ঞান! হা কঠোর। হা নৃশংস! 

কাড়িয়া নিয়েছ সব জীবনের সার অংশ; 

সুন্দর দেহের মাংস টানিয়া ছিঁড়িয়া তার 

কঙ্কাল রেখেছে খাড়া শুদ্ধ শুষ্ক সভ্যতার”।


এছাড়াও দেখা যায় (খ) প্রেমের ক্ষেত্রে রক্তমাংসের সত্তা ও শাশ্বত সত্তার মধ্যে অবিরোধী অবস্থান। (গ) সংশয়বাদী বা অজ্ঞেয়বাদীর মনোভাব। (ঘ) বিজ্ঞান-চিন্তার আঘাত সহ্য করে ভাবাবেগ-মুক্ত বিচার-বুদ্ধির দ্বারা জগৎ ও জীবনকে পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।


‘আলেখ্য’ কাব্যে একদিকে আছে স্ত্রী বিয়োগের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে দেখা গেছে নতুন সমাজভাবনা ও গণতান্ত্রিক চেতনা, স্বার্থমুক্ত বিজ্ঞান বিশ্বাসী আস্বাদ ও ভবিষ্যতের চিত্র

“অবোধ্য যা বোধ্য হবে; অস্পষ্ট যা স্পষ্ট হবে, অজ্ঞাত যা জ্ঞাত; 

দূরত্ব অতীত হবে; জটিল যাহা সহজ হবে, দুঃখ হবে দূর, 

পরার্থেই ইচ্ছা হবে, ইচ্ছা হবে ফলবতী; কার্য সুমধুর; 

আলোকে সঙ্গীত পূর্ণ, আনন্দ উল্লাসে মুগ্ধ, বিজ্ঞানে মহৎ, 

স্বার্থত্যাগে স্বর্গীয়, সে গগনে গগনে ব্যাপ্ত মহাভবিষ্যৎ।”


আবার এই গভীর-গম্ভীরতার পাশাপাশি ব্যঙ্গের চলিত বাচনভঙ্গীরও প্রকাশ ঘটেছে এই কাব্যে; যেমন—

“তোমার টাকা আছে? আছে না হয় টাকা, 

তোমার কাছে আমি কিছু চাচ্ছি নাক; 

যে চায় মাথা নীচু করুক তোমার কাছে, 

মাথা নীচু কর্তে আমি যাচ্ছি নাক, 

কিসের তরে দর্প! কিসের তরে গর্ব। 

কিসের তরে তোমার এত শ্রেষ্ঠ ভাব? 

তোমার কাছে আমি ভাবো কিসে খর্ব ? 

তোমার কাছে মাথা নীচু কর্তে যাব?”


স্থির গম্ভীর স্মৃতির বেদনায় পূর্ণ কাব্য—'ত্রিবেণী'। এখানে যেমন আছে অতীত স্মৃতির পর্যালোচনা, তেমনি আছে জগৎ ও জীবনে নতুনতর অর্থের, তথ্যের তৃষ্ণা; যেমন

“আবার ছুটি চিত্তারাজ্যে প্রাণের তৃষ্ণায় করি ধ্যান

জগতের এক নতুন তথ্য, নতুন অর্থ, নতুন জ্ঞান”।


দ্বিজেন্দ্রলালের বাংলা কাব্যে অবদান এককথায় : (১) হাদয়-বৃত্তির সঙ্গে বুদ্ধি-মার্জিত মননশীলতার প্রকাশ। (২) যুগের রীতি অনুযায়ী পৌরাণিক ভাব-কল্পনার মধ্যে মানবিকতার মহত্ত্ব ঘোষণা; মৃত্যুচিন্তার মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। (৩) কাব্যরীতির মধ্যে অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রকাশ।


প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, এই নতুনত্ব রবীন্দ্রনাথকেও মুগ্ধ করেছিল, যে কারণে ‘মন্ত্র' কাব্যের সমালোচনায় তিনি মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন : “ইহা নূতনতায় ঝলমল করিতেছে এবং এই কাব্যে যে ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে তাহা অবলীলাকৃত এবং তাহার মধ্যে সর্বত্রই প্রবল আত্মবিশ্বাসের একটি অবাধ সাহস বিরাজ করিতেছে.....। তাহাতে চেষ্টাহীন সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সবলতা আছে।......ছন্দ সম্বন্ধেও যেন স্পর্ধাভরে কবি যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছেন।” রবীন্দ্রনাথের এই সমালোচনার মধ্য দিয়েই বাংলা কাব্যের ইতিহাসে দ্বিজেন্দ্রলালের স্বতন্ত্র স্থানটি সুচিহ্নিত হয়েছে।