মুন্সী প্রেমচন্দের ছোটোগল্প সম্পর্কে যা জানো লেখো।

ভূমিকা: ঔপন্যাসিক হিসাবে প্রেমচন্দ অসামান্য খ্যাতির অধিকারী ছিলেন। অবশ্য অনেক সমালোচক মনে করেন যে তিনি যদি উপন্যাস না লিখে কেবল ছোটোগল্প লিখতেন তাহলেও হিন্দি কথা সাহিত্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন। অনেকে ঔপন্যাসিক প্রেমচন্দ অপেক্ষা ছোটোগল্পকার প্রেমচন্দকে অধিকতর সফল বলে মত প্রকাশ করেছেন। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, রচনারীতি এবং স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য তিনি যথার্থ ছোটোগল্পকারের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯০৭–১৯৩৬ দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর ধরে তিনি প্রায় ২৭৭টি ছোটোগল্প লিখেছেন। তার গল্পরচনার সূচনা হয় ১৯০৭ সালে 'দুনিয়া কা সবসে আনমোল রতন' রচনার মাধ্যমে। প্রেমচন্দ যখন ছোটোগল্প রচনায় আত্মনিয়োগ করেন তার আগেই তিনি ছোটোগল্পকার লিও টলস্টয় এবং রবীন্দ্রনাথের অমর ছোটোগল্পগুলির অনুবাদকর্মে রত ছিলেন। ফলে প্রথম শ্রেণির ছোটোগল্পকারদের রচনারীতি, কাহিনিবিন্যাস ও চরিত্রায়ণ তাকে প্রভাবিত করেছিল। এদের রচনা সান্নিধ্য তার প্রতিভাকে আরও শানিত করে তোলে ফলে তার ছোটোগল্পগুলি কালজয়ী ছোটোগল্পের মর্যাদালাভে সমর্থ হয়। তার প্রথম গল্প 'সোজে রতন' নামক গল্পসংগ্রহ ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সরকারি শিক্ষক হয়ে নবাব রায় ছদ্মনামে তার লেখা এই বই তীব্র দেশপ্রেমমূলক হওয়ায় ইংরেজ সরকারের বিষদৃষ্টিতে পড়ে এবং গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তার লেখার উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে লেখক প্রেমচন্দ ছদ্মনাম নিয়ে লিখতে শুরু করেন।


গল্পগ্রন্থসমূহ : তার গল্পসংকলন গ্রন্থগুলিকে কলানুক্রমিকভাবে সাজালে নিম্নরূপ দাঁড়ায়—

  • সপ্তসরোজ

  • নবনিধি

  • প্রেমপূর্ণিকা

  • প্রেমপচ্চীসী

  • প্রেম প্রসূন

  • প্রেম দ্বাদশী

  • প্রেম প্রতিভা

  • প্রেম প্রমোদ

  • অগ্নিসমাধি

  • পাঁচফুল 

  • প্রেম চতুর্থী

  • প্রেমতীর্থ

  • প্রেম প্রতিজ্ঞা

  • প্রেম পঞ্চমী 

  • সপ্তসুমন

  • সমর যাত্রা

  • প্রেরণা

  • পঞ্চপ্রসূন 

  • নবজীবন

লেখক নিজে তার বেশিরভাগ গল্প 'মানসসরোবর' নামক গ্রন্থে সংকলন করেছিলেন। ৮ খণ্ডে প্রকাশিত এই গল্প সংকলন ১০৩টি গল্পের ঠাঁই হয়েছে।


পর্যায় : তাঁর ছোটোগল্পগুলিকে ৮টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল— (১) পারিবারিক (২) সামাজিক (৩) রাজনৈতিক (৪) দেশপ্রেমমূলক (৫) ঐতিহাসিক (৬) মনস্তাত্ত্বিক (৭) গ্রামীণ প্রহসনমূলক (৮) জীবনীমূলক।


আদর্শ ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য সমূহের যথার্থ বাস্তবায়ন আমরা প্রেমচন্দের ছোটোগল্পসমূহে পাই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চারপাশে অসংখ্য ঘটনাসমূহের মধ্য থেকেই তুলে আনা হয়েছে গল্পের চরিত্রাবলি এবং বিষয়বস্তুকে, গোষ্পদে আকাশ দর্শনই ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য। তাই জীবন থেকে তুলে আনা এক একটি ঘটনা অসংখ্য ঘটনার, প্রতিনিধিরূপে আমাদের চিত্তে দোলা দেয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের দৈনন্দিন ঘটনার, তাদের আচার আচরণের, অর্থনৈতিক জীবনের এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের পটচিত্র হল লেখকের গল্পরাজি। উত্তর প্রদেশে অসংখ্য হরিজন বা দলিত সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের বাস। একদিকে জমিদার অন্যদিকে মহাজন এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা তাদের শোষণের স্টিম রোলার চালিয়ে হরিজনদের জীবনকে ওষ্ঠাগত করে তুলত। দলিত জাতির প্রতি তার আন্তরিক সমবেদনা ঝরে পড়েছে এই পর্যায়ের ছোটোগল্পগুলিতে। এই পর্যায়ের গল্পগুলির মধ্যে মন্দির, দুধ কা দাম, খুনে সফেদ, ঠাকুর কা কুঁয়া, কফন, সদগতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের প্রতি লেখকের সহানুভূতির অত্যুজ্জ্বল নিদর্শনরূপে ‘সদগতি' এবং ‘কফন’ গল্পটির উল্লেখ করা যায়।


প্রেমচন্দের প্রথম পর্বের অনেক ছোটোগল্প তার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও দেশভক্তিকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। ইংরেজ সরকারে ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করার জন্য তাকে ইংরেজ সরকারের বিষদৃষ্টিতে পড়তে হয়েছে। দেশপ্রেম মূলক গল্পসংকলন গ্রন্থ সোজে রতন এর মুখবন্ধে লেখক নিজেই বলেছেন “বঙ্গাল কে বিভাজন নে লোগাঁ কো দিলো মে বিদ্রোহ কী চেতনা জাগাই হ্যায়। সাহিত্য পর ভী ইসকা অসর হোগা হী। ইস সংগ্রহ মে প্রস্তুত কহানিয়োঁ মেঁ যহ চেতনা মুখর হুই হ্যায়”, অর্থাৎ বঙ্গবিচ্ছেদ লোকের মনে বিদ্রোহের চেতনা সঞ্চারিত করেছিল এবং সাহিত্যের পাতায় তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধিজির ডাকে প্রেমচন্দ ইংরাজ সরকারের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তার মনে বিশ্বাস জন্মে যে সরকারি চাকরি করা মানেই চাটুকারিতা করা। তার দেশভক্তি ও ঐতিহাসিক গল্পগুলি যথা— শতরঞ্জ কী খিলাড়ী, সতী ও রানী সারন্ধা এই পর্যায়ভুক্ত।


প্রেমচন্দের উপন্যাসে আমরা নারীজীবনের সমস্যা ও যন্ত্রণার অসংখ্য ছবি পেয়েছি। সর্বত্রই তিনি নারীকে অন্ধ কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলা কথা সাহিত্যে আমরা শরৎচন্দ্রের লেখনীতে নারী জীবনের জটিল সমস্যাসমূহের উল্লেখ পেয়েছি। অবৈধ ও অসামাজিক প্রেমের কাহিনিকে শরৎচন্দ্রের ন্যায় প্রেমচন্দ ও তার সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন। এদের দুজনের সাহিত্যেই পতিতা এবং অসতীরা মনুষ্যত্বের মানদণ্ডে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রেমচন্দের এই পর্যায়ের গল্পসমূহের মধ্যে ‘বড়ে ঘর কী বেটী’ ‘আধার' 'স্বামীনী' 'মাতা কা হৃদয়', 'উদ্ধার', 'অগ্নিসমাধি' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।


প্রেমচন্দের বাল্যকাল এবং কৈশোর গ্রাম্য পরিবেশে অতিবাহিত হয়েছিল। তার সমগ্র চেতনায় গ্রামের পরিবেশ সম্পৃক্ত। তাই গ্রাম এবং গ্রামের মানুষজন তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রেমচন্দের লেখনী মূলে ভিড় জমিয়েছে। জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে জীবিকার সন্ধানে তাকে শহরমুখী হতে হলেও গ্রামের মানুষজন চিরদিন তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছিল। অনাহারক্লিষ্ট, দরিদ্র চাষিদের জীবনের বাস্তবায়ন নিয়ে তার ছোটোগল্পগুলির মধ্যে ‘মুক্তিমার্গ' ‘অগ্নিসমাধি’, ‘বেটী কা ধন', 'বলিদান', 'পঞ্চ পরমেশ্বর’, ‘রোশনী’, ‘মুক্তিধন’: ‘পুস কী রাত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।


প্রেমচন্দ কিছু Satire ধর্মী ছোটোগল্প রচনা করেছিলেন। ‘মোটেরাম' নামে একটি চরিত্রকে অবলম্বন করে আমাদের সমাজব্যবস্থার দোষ-ত্রুটিগুলিকে প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছেন। সরকারি অব্যবস্থা, মহাজন ও ইংরাজদের অর্থলিপ্সা, হরিজনদের সঙ্গে উচ্চবর্ণের সংঘর্ষ ইত্যাদি কাহিনিই এই পর্যায়ের ছাটোগল্পগুলির উপজীব্য। ‘মোটেরাম শাস্ত্রী’ ‘মোটর কী ছীটে’, মনুষ্য কা পরম ধর্ম, নিমন্ত্রণ ইত্যাদি ছোটোগল্পগুলি এই পর্যায়ে পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তরে'র কমলাকান্ত চক্রবর্তী চরিত্রের সঙ্গে ‘মোটেরামের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।


বাল্যাবস্থায় প্রেমচন্দ প্রিয়জনদের স্নেহবঞ্চিত ছিলেন। স্নেহবুভুক্ষু প্রেমচন্দ নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে শিশুমনের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য স্নেহের পরশের মূল্য জ্বরজ্বালার থেকে অনেক গুণ বেশি। মানুষের মর্যাদাবোধ লেখককে খুব নাড়া দিত। ব্যক্তিসত্তার সুষ্ঠু পরিচর্যার জন্য সুস্থ সামাজিক পরিবেশের গুরুত্বকে লেখক উপলব্ধি করেছিলেন। তার এই মানসিকতার পরিচয় সমৃদ্ধ গল্পগুলির মধ্যে ‘ঘরজমোহ’ ‘বিমাতা, ‘প্রেরণা ‘চোরী কজাকী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।


কয়েকটি ছোটোগল্পে প্রেমচন্দ মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে মানুষের আত্মিক যোগসূত্র রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। শরৎচন্দ্র তার ‘মহেশ’ গল্পে গফুর জোলার সঙ্গে মৃক পশু মহেশের এক আত্মিক যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। অনুরূপভাবে ‘পুস কী এক রাত’ গল্পে মনুষ্যেতর প্রাণী কুকুর ‘জবরা'র মধ্যে মানবোচিত গুণাবলির প্রকাশ ঘটিয়ে গরিব চাষি হল্লুর আত্মিক যোগসূত্র ঘটিয়েছেন। এই গল্পে একটি গৃহপালিত পশুকে মানবজীবনের সঙ্গে একসূত্রে গ্রথিত করে লেখক গল্পটিকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছেন। এই পর্যায়ে আমরা ‘দো বয়লো কী কথা' এবং ‘স্বত্বরক্ষা গল্পগুলির উল্লেখ করতে পারি।


প্রেমচন্দের মনস্তাত্ত্বিক গল্প ‘কফন' তার শ্রেষ্ঠ গল্পের মর্যদা পাবার দাবিদার, এই গল্পের প্রধান চরিত্র দুটি হল যীশু ও মাধব আসলে বাবা ও ছেলে। চুরি করাই তাদের পেশা। মাধবের গর্ভবতী স্ত্রী সারাদিন পরিশ্রম করে তাদের মুখের অন্ন জোগাত। তারা খেটে খেতে চায় না। মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীর সামনে তারা পিতাপুত্রে চুরি করা আলু পুড়িয়ে গোগ্রাসে গিলতে ব্যস্ত। তারা এত অলস যে স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তার কফন কেনার পয়সা জোগাড় করার চেষ্টা থেকেও বিরত থাকে। গ্রামবাসীরা কফন কেনার পয়সা দিলে তারা সেই পয়সায় মদ্য পান করে। মদ্যপ যীশু সদ্যমৃত পুত্রবধূকে আশীর্বাদ করছে কারণ সে মরেও তাদের মদ্যপানের ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে। আমাদের হৃদয়হীন নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক অবিচারের ফাঁদ কীভাবে দরিদ্র প্রজাদের গলায় চেপে বসেছে তারই জ্বলন্ত দলিলরূপে এই গল্পটি আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।


উপসংহার : প্রেমচন্দ নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছিলেন আমাদের সমাজের কিছু ক্ষতস্থানকে। সেই ক্ষতস্থানে আপন সংবেদনশীলতার কোমল লেখনী স্পর্শ বুলিয়ে তিনি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। অনাগত কালের পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন কিছু সামাজিক সমস্যাকে যার কিছু সমাধানের ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাকে আমরা প্রকৃত সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাতেও দেখতে পাই।