বাংলা নাট্যসাহিত্যে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১ খ্রীঃ–১৯৪১ খ্ৰীঃ)

বাংলা নাটকে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ


বিশ্বসাহিত্যের সূচীপত্রে রবীন্দ্রনাথের স্থান বিভিন্ন শাখায়। তার একটি অবলম্বন হল নাটক। আবার এই নাটকের বিচিত্র রূপভেদের মধ্যে তাঁর স্বচ্ছন্দ অবস্থান যে-কোন পাঠকচিত্তেই বিস্ময় জাগায়। বস্তুত, গীতিনাট্য-নাট্যকাব্য-কাব্যনাট্য থেকে শুরু করে পঞ্চাঙ্ক নাটক, কৌতুক নাটক, রূপক-সাঙ্কেতিক তত্ত্বনাটক, নৃত্যনাট্য-নাটিকা ইত্যাদি প্রায় সর্বরূপেই তাঁর সূর্যসমান প্রতিভা প্রকাশিত। ভারতীয় পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত-জাতক ইত্যাদি বিবিধ প্রাচীন গ্রন্থ থেকে তিনি নাটকের উপকরণ অনুসন্ধান করেন। তাঁর নাটক প্রধানত ভাবাত্মক, গীতিধর্মী এবং তত্ত্বচিন্তাবাহী। এই তত্ত্বচিস্তা সমকাল, সমাজ ও ব্যক্তিসমস্যার সঙ্গে যুক্ত। তবে সমকালীন বা পূর্বকালীন কোন নাট্যপ্রভাব তার নাটকে অনুপস্থিত। নাটক নির্মাণে তিনি ঐতিহ্যানুসারী বলা যাবে না অথচ তার যথার্থ ভাবশিষ্য বা উত্তরসাধকও নেই একথাও সত্য। নাটকে তিনি যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান।


পর্যায়-বিভাগঃ রবীন্দ্র-নাটকের সূচনা গীতিনাট্যে আর সমাপ্তি নৃত্যনাট্যে। এরই মাঝে আছে কাব্যনাট্য-নাট্যকাব্য-কৌতুকনাট্য, রূপক-সাঙ্কেতিক নাটক এবং সমাজ সমস্যামূলক নাটক। আলোচনার প্রয়োজনে তাঁর সৃষ্টিশীলতার ধারাবাহিক রূপটিকে পাঁচটি পর্যায়ে দেখানো যায় -


প্রথম পর্যায় (১৮৮১-৮৮) : 

  • রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যসমূহ : ‘রুদ্রচণ্ড’ (১৮৮১), ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮১), ‘কালমৃগয়া' (১৮৮২), ‘মায়ার খেলা’ (১৮৮২), ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ (১৮৮৪)।


দ্বিতীয় পর্যায় (১৮৮৯-১৯০০) : 

  • রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্য ও নাট্যকাব্যসমূহ : ‘রাজা ও রানী' (১৮৮৯), ‘বিসর্জন’ (১৮৯০), 'চিত্রাঙ্গদা' (১৮৯২), 'বিদায় অভিশাপ’ (১৮৯৪), 'মালিনী' (১৮৯৬); এছাড়া আছে অনতি-পরবর্তীকালে লেখা ‘গান্ধারীর আবেদন’ (১৯০০), 'নরকবাস’ (১৯০০), 'কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ (১৯০০)।


তৃতীয় পর্যায় (১৮৮৬-১৯০৭) : 

  • রবীন্দ্রনাথের কৌতুকনাট্যসমূহ : ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭), ‘হাস্যকৌতুক (১৯০৭), ‘ব্যঙ্গ-কৌতুক’ (১৯০৭)।


চতুর্থ পর্যায় (১৯০৮-১৯২৪) 

  • রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাঙ্কেতিক তত্ত্বনাটকসমূহ : ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮), ‘রাজা’ (১৯১০), 'অচলায়তন(১৯১২), 'ডাকঘর' (১৯১২), 'ফাল্গুনী' (১৯১৬), ‘গুরু’ (১৯১৮ ‘অচলায়তনে’র সংক্ষিপ্ত রূপ), ‘অরূপরতন’ (১৯১৯ ‘রাজা’ নাটকের নবতর রূপ), ‘মুক্তধারা' (১৯২২), ‘রক্তকবরী’ (১৯২৪), ‘কালের যাত্রা' (১৯৩২)।


পরিবর্তিত রূপ : ‘প্রায়শ্চিত্ত' (১৯০৯), 'বৌঠাকুরানীর হাট’ (উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে রচিত) পরে লেখা হয়েছে সংক্ষিপ্তরূপে ‘পরিত্রাণ’ (১৯২৯), ‘রথের রশি’ (১৯৩২, ‘কালের যাত্রায় প্রকাশিত)।


পঞ্চম পর্যায় (১৯২৫-৩৯) : 

  • রবীন্দ্রনাথের কৌতুকনাট্য, সামাজিক নাটক ও নৃত্যনাট্য : ‘চিরকুমার সভা' (১৯২৫), ‘গৃহপ্রবেশ’ (১৯২৫, পরিবর্তিত রূপ ‘শেষের রাত্রি’, ১৯২৫), ‘শোধবোধ’ (১৯২৫), ‘বাঁশরী’ (১৯৩৩)।


রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যসমূহ : ‘শাপমোচন' (১৯৩১), 'তাসের দেশ' (১৯৩৩) নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা' (১৯৩৬), 'নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা' (১৯৩৭), 'নৃত্যনাট্য শ্যামা' (১৯৩৯)।


রবীন্দ্র গীতিনাট্যগুলির প্রথম পর্যায়ে প্রকৃতি-প্রয়াণ, আত্মনিপীড়িত প্রেম এবং দুঃখের তপস্যাই মূল কথা। 'রুদ্রচণ্ডে' কিশোর কবির সংবেদনশীল চিত্ত আত্মপ্রকাশিত। ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’য় আছে আদিকবির আত্মজাগরণের কথা। এর গানের অংশ বিশেষে আইরিশ সুর যোজনা নাট্যকারের গীতিকুশলতার পরিচায়ক। 'কাল মৃগয়া'তে আছে অন্ধমুনির কথা, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধে' প্রকৃতি বিমুখ সন্ন্যাসীর বিভ্রান্তির সঙ্কট থেকে মুক্তির প্রসঙ্গ। 'মায়ার খেলা' নাটকে প্রেমের হাসি কান্নাই মুখ্য সুর। গীতিপ্রবণতা এইসব নাটকের প্রাণ। মহাভারতের কচ ও দেবযানীর ঘটনা বিদায় অভিশাপে'র কাহিনী বিষয়। অন্যদিকে প্রাচীন পুরাণ, ইতিহাস, মহাকাব্যের চরিত্র ও ঘটনা অবলম্বনে রচিত হয়েছে ‘কাহিনী’র নাট্য কবিতাগুলি; যেমন—'কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’, ‘গান্ধারীর আবেদন' ইত্যাদি।


গীতিরস ও নাট্যরসে ‘চিত্রাঙ্গদা' নাট্যকাব্যটি পরিপূর্ণ। মহাভারতের তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের অনুরাগিণী মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা তার পুরুষ-কঠিন দেহ নিয়ে আকর্ষণে ব্যর্থ হলেন। মদনের আরাধনায় অপূর্ব রূপলাবণ্য লাভ করে তিনি অর্জুনের মনোরঞ্জন করলেন বটে, কিন্তু নিজেকে কৃত্রিম পরাভূত ব’লে মনে হল। চিত্রাঙ্গদা এক বৎসর পর লাবণ্যপ্রভা থেকে মুক্ত হলে অর্জুন তার মধ্যে সহধর্মিণী ও নিজ সন্তানের জননীকে লাভ করে মুগ্ধ হলেন। এই কাব্যনাট্যের ঘটনাবস্তু, চরিত্র দ্বন্দ্ব, কাব্যসৌন্দর্য সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের অসামান্য প্রতিভার এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত।


‘রাজা ও রানী’ এবং ‘বিসর্জন’ পঞ্চাঙ্ক ট্র্যাজেডি। ‘রাজা ও রানী’ প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক। জলন্ধররাজ বিক্রমদেব রানী সুমিত্রার প্রতি মোহে কর্তব্যভ্রষ্ট। সুমিত্রা তাঁকে সচেতন করার জন্য স্বামীকে ত্যাগ করে পিতৃভূমি কাশ্মীরে ফিরে যান। বিক্রমের দুর্দান্ত প্রেম প্রতিহত হয়ে পরিণত হয় দুর্দান্ত হিংস্রতায় আত্মঘাতী প্রেম হয়ে উঠে বিশ্বাসঘাতী। এইভাবে নাটকটির কাহিনী চরম পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। তবে এই মূল কাহিনী ছাপিয়ে ওঠে সুমিত্রার ভাই কুমারসেন ও ইলার প্রেমকাহিনী। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই অসঙ্গতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন : “এর নাট্যভূমিতে রয়েছে লিরিকের প্লাবন, তাতে নাটককে করেছে দুর্বল। এ হয়েছে কাব্যের জলাভূমি। ওই লিরিকের টানে এর মধ্যে প্রবেশ করেছে ইলা ও কুমারের উপসর্গ। সেটা অত্যস্ত শোচনীয়রূপে অসঙ্গত।” কাহিনীর এই দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন ব’লেই পরবর্তীকালে তা ‘তপতী’ নাটকে সংশোধিত হয়। তবে এখানে নাটকীয়তা অপেক্ষা তত্ত্বভাবনাই প্রাধান্য পায়।


‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয় ‘বিসর্জন’। এই নাটকের বিষয়বস্তু —বলি বন্ধের জন্য পুরোহিত রঘুপতি এবং রাজা গোবিন্দমাণিক্যের মধ্যে সংঘর্ষ, পরিণামে রঘুপতির পালিত পুত্র জয়সিংহের আত্মহত্যা, রঘুপতির প্রেমধর্মের মধ্যে প্রত্যাবর্তন। বিতাড়িতা ভিখারিণী অপর্ণাকে দেখে তার উপলব্ধিই এ নাটকের মূল সুর

“জননী আমার

এবারে দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা!”


চণ্ডধর্মের কাছে প্রেমধর্মের, আনুষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে হৃদয়ভক্তির ও কল্যাণধর্মের জয় ঘোষণায় এই নাটক সমাপ্ত হয়েছে। রবীন্দ্র নাট্যজগতে ‘বিসর্জনের তুল্য জনপ্রিয় নাটক বিরলদৃষ্ট। কাহিনীর যুক্তিসঙ্গত বিকাশে এবং চরিত্র রূপায়ণে কিছু ত্রুটি আছে। তবে ‘বিসর্জন’ অভিনয়-সাফল্যের দিক থেকে রসোত্তীর্ণ।


এই পর্যায়ের আর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘মালিনী'। এখানেও আছে প্রথাবদ্ধ ধর্ম এবং উদার মানসিক ধর্মের মধ্যে বিরোধ। এক বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী এর উৎস। রাজকন্যা মালিনীর হৃদয়ে প্রেমের আবির্ভাব এবং দুই বন্ধু ক্ষেমঙ্কর এবং সুপ্রিয়ের মধ্যে প্রথার সঙ্গে প্রেমের দ্বন্দ্ব এই নাটকের বক্তব্য বিষয় হয়ে ওঠে। প্রথাসিদ্ধ ধর্মাচার ত্যাগ করে প্রেমের মোহে বশীভূত হয়েছে ভেবে ক্ষেমঙ্কর স্বহস্তে সুপ্রিয়কে হত্যা করেছে। ক্ষেমঙ্করের পৌরুষদীপ্ত চরিত্র এ নাটকের এক স্মরণীয় সৃষ্টি।


রবীন্দ্র-নাটকের তৃতীয় পর্যায় কৌতুকনাট্যে পরিপূর্ণ। তার ‘গোড়ায় গলদ’ ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ ‘হাস্যকৌতুক’ ‘ব্যঙ্গকৌতুক' ইত্যাদি নাটকে যুগের চিত্র সরস ও কৌতুককর ঘটনাবিন্যাসের মাধ্যমে ধরা পড়েছে। উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিলগ্নে নগর কলকাতার মানুষদের বিচিত্র চারিত্রিক অসঙ্গতি দেখে এই বিশুদ্ধ হাস্যরসের প্রকাশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ কৌতুক-রস সৃষ্টির জন্য ঘটনাগ্রস্থনের জটিলতার পরিবর্তে ব্যক্তিচরিত্রের অসঙ্গতির উপর বেশি নির্ভর করেছেন। 'চিরকুমার সভা'তে চিরকুমারদের ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’ কিভাবে কিশোরীদের সামান্য উদ্যোগে ভেঙে পড়ল তার কৌতুককর বিবরণ আছে। স্ত্রীভূমিকা-বর্জিত ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ সরস কৌতুকের সঙ্গে স্নিগ্ধমধুর করুণরসের মিশ্রণে "Human verges on pathoes" হয়ে উঠেছে। উইটের বাগ্‌দীপ্তিতেও নাটকগুলির সংলাপ মনোহরণ করে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অতিকথন দোষ যেমন ‘চিরকুমার সভা’তে, তেমনি সামান্য কথনের ত্রুটি নাটকগুলিকে নিখুঁত হতে দেয় নি।


রবীন্দ্র-নাটকের চতুর্থ পর্যায় সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য। কারণ বর্তমান যুগ ও যন্ত্র সভ্যতার জড়বাদী শক্তি, লোকাচার ও সংস্কারের বন্ধনদশা থেকে মানবাত্মার মুক্তিকামনার বাণী এই পর্যায়ের নাটকগুলির মধ্যে মূর্ত হয়েছে। আসলে, চিরসুন্দরের মরমিয়া পূজারী রবীন্দ্রনাথের প্রায় প্রতিটি রূপক সাঙ্কেতিক নাটকের নাট্য সংঘাতের মূলে রয়েছে এক মৌলিক দ্বন্দ্ব। সে দ্বন্দ্ব প্রাণধর্মের সঙ্গে জড়ধর্মের, সর্ববন্ধনমুক্ত আনন্দরসঘন মানবাত্মার সঙ্গে নিষ্প্রাণ যন্ত্রের ‘ডাকঘরে’র অমন, ‘অচলায়তনে’র পঞ্চক, ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী, ‘মুক্তধারা’র অভিজিৎ প্রভৃতি চরিত্রগুলি মুক্তপ্রাণের বাণীবাহক। আর এই জড় শক্তি ‘ডাকঘরে’ গুরুজন-শাসিত গৃহকারাগার, 'অচলায়তনে' অন্ধসংস্কার, ‘রাজা'য় সকাম দেহতন্ত্র, ‘রক্তকরবী’তে আকর্ষণজীবী ধনতন্ত্র এবং ‘মুক্তধারা’য় সাম্রাজ্যবাদী লৌহযন্ত্ররূপে রূপায়িত। রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাঙ্কেতিক নাট্য-সম্ভারের মুক্তপ্রাণ প্রবাহ এইসব বাধার বিরুদ্ধে নিত্যকালের বিদ্রোহবাণী।


এদের বেশভূষা, বাচন এবং আচরণও যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। যেমন ‘ডাকঘরে’ অমলকে পাঠানো রাজার ‘চিঠি’ বিশ্বের রাজাধিরাজের পাঠানো প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের খবর, ‘রাজা’ নাটকে রাজার পতাকায় ‘পদ্মে’র মাঝে বজ্রচিহ্ন আঁকা—“বাহিরে রাজার পদ্মের পেলবতা ও সৌন্দর্য—ভিতরে বজ্রের কাঠিন্য”। নন্দিনীর হাতে ‘রক্তকরবী’ – মুক্ত জীবনানন্দের প্রতীক (তুলনীয় দৃষ্টান্ত ইবসেনের 'Hedda Gabbler'-এ নায়িকার চুলে গোঁজা 'vine leaves' আরণ্যক উদ্দামতার প্রতীক— "I can see her already-with vine leaves in her hair-flushed and fearless"), 'মুক্তধারা'য় অভিজিতকে দেবে ব’লে ফুলওয়ালীর কাছ থেকে নেওয়া সঞ্জয়ের হাতের ‘শ্বেতপদ্ম’ মালিন্যমুক্ত বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতীক। 'মুক্তধারা' মানবজীবনের নিত্যমুক্ত স্বচ্ছন্দ গতির প্রতীক, বিরাট লৌহযন্ত্রের বাঁধ পাশ্চাত্তের উগ্র ও যান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি।


কাহিনীগত পরিচয়ে দেখা যায় ‘অচলায়তনে' আছে ধর্মীয় নিষ্ঠুর প্রথার চাপে ভারতবর্ষীয় সমাজজীবনে স্বাভাবিক বিকাশের পথ কিভাবে রুদ্ধ হয় তার ব্যঙ্গচিত্র। অন্যদিকে তৃষ্ণার জল আর মাঠের ফসল ফলাতো যে মুক্তধারা, উত্তরকুটের রাজা রণজিৎ যন্ত্ররাজ বিভূতিকে দিয়ে লৌহবাঁধ নির্মাণ করিয়ে প্রতিবেশী দরিদ্র রাজ্য শিবতরাইকে বঞ্চিত করেও কিভাবে ব্যর্থ হয় যুবরাজ অভিজিতের আত্মদানে, তার মরমী চিত্র আছে 'মুক্তধারা’য়। ‘রক্তকরবী’তে শোষণ-ব্যবস্থার কেন্দ্রে আছে রাজা। সে যন্ত্রের সহস্রবাহু দিয়ে ভূগর্ভ থেকে সোনার পিণ্ড আহরণ করে পুঞ্জীভূত করে। উৎপাদন ব্যবস্থার সহায়তা ভিন্ন মানুষের অন্য কোন মূল্য এখানে স্বীকার করা হয় না। শেষে যৌবনের জয়ধ্বজা উড়িয়ে রক্তকরবীর গুচ্ছ নিয়ে আসে নন্দিনী। তার আপনজন রঞ্জনের সঙ্গে লড়াই করে রাজা মুক্ত হয়। যৌবনকে ও মনুষ্যত্বের শক্তিকে চিনতে পারে। ‘রক্তকরবী’ রবীন্দ্রনাথের নাট্যভাবনা ও ভাব-চিন্তার স্বর্ণখনি। বর্তমানের যন্ত্রযুগ ও মানব সভ্যতার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পটভূমিতে যৌবনের আনন্দময় জীবনচেতনার প্রকাশ তথা মুক্তিচেতনা এই নাটকের মর্মকথা। 'কালের যাত্রা'য় আছে মহাকালের অচল রথ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য শ্রেণীর সঙ্গে চতুর্থ শ্রেণীর শূদ্রের শক্তিতে কিভাবে চলতে শুরু করল তার রুদ্ধশ্বাস নাট্য-চিত্র।


পরিবর্তন ও রূপান্তরের ক্ষেত্রেও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ অস্পষ্টতা থেকে পৌঁছেছেন দৃঢ়তায়, সংশয় থেকে বিশ্বাসে, সন্ধান থেকে সিদ্ধান্তে। তাই ‘শারদোৎসবে’ প্রকৃতির ঋতুবদলের সঙ্গে মানবজীবনের সুখ-দুঃখের পালাবদলের প্রসঙ্গ ‘ফাল্গুনী'তে জীবন ও মৃত্যুর রূপকে আত্মপ্রকাশ করেছে। ‘রাজা’র প্রেমের দহন ও দীপ্তি ‘অরূপরতনে’ প্রেমের প্রগাঢ় অনুভবে হয়েছে আত্মলীন। ‘অচলায়তনে’ আচার-বন্ধনের দুর্গ চূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা ‘গুরু’ নাটকে নব যৌবনের আবাহন-মন্ত্রে হয়েছে প্রত্যয়ে পূর্ণ। ‘কালের যাত্রা’য় মহাকালের রথ সংক্ষিপ্ত ও সংহত হয়ে রথের রশি’তে সমাজের গতিশীলতার প্রয়োজনে শূদ্র শ্রেণীর সাহায্যের গুরুত্ব নির্দেশ করেছে।


রবীন্দ্রনাথের পঞ্চম পর্যায়ের নাটকসমূহ বিচিত্র বিষয়ে সজ্জিত। এই পর্যায়ে নাটকগুলির মধ্যে পারিবারিক ও গার্হস্থ্য সমস্যা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, শহর সমস্যা ও সমকালীন অভিজাত সমাজের চিত্র কখনো কৌতুকে, কখনো তাত্ত্বিক বা দার্শনিক দৃষ্টিকোণে উপস্থাপিত। এর মধ্যে বাঁশরী' নাটকটি স্বতন্ত্র ধাঁচের। এখানে ‘প্রেম’ বিষয়টিকে ব্যবহারিক প্রয়োজন এবং বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে আন্তরিক চাহিদার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তত্ত্ব-চিন্তা, সামাজিক সম্পর্ক এবং ঘটনা-দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে নাট্য-বিষয়টি মূর্ত হয়েছে। ‘বাঁশরী’তে ‘শেষের কবিতা’র সঙ্গে ভাবনাগত ঐক্য অনুভব করা যায়।


রবীন্দ্র-নাটকে নৃত্যনাট্যগুলি রবীন্দ্রসাহিত্যের মণিমঞ্জুষায় উজ্জ্বল রত্নবিশেষ। এখানে যেমন তত্ত্বচিন্তা ও বস্তু-চেতনা আছে তেমনি আছে রূপ-কল্পনা। 'নটীর পূজা'য় আছে অজাতশত্রুর আদেশ অমান্য করে নটীর বুদ্ধমূর্তির পূজায় দুঃসাহসিক আত্মনিবেদন। ‘শাপমোচন'-এ আছে রাজকন্যা কমলিকার কুদর্শন রাজাকে ত্যাগ করে শেষে অন্তরের আলোয় তার প্রেমের মূর্তি উপলব্ধির দুঃখময় অভিজ্ঞতা লাভ। 'চণ্ডালিকা’তে দেখা গেছে বুদ্ধশিষ্য আনন্দের ‘জল দাও' প্রার্থনা চণ্ডালকন্যার মধ্যে মনুষ্যত্ব ও কুসংস্কার মুক্ত প্রেমের উদ্বোধন ঘটিয়েছে। 'শ্যামা’য় আছে রাজনটী শ্যামার উত্তীয়ের ভালোবাসা তুচ্ছ করে বজ্রসেনকে হৃদয়-নিবেদনের ব্যর্থতার বেদনা। আর 'তাসের দেশে’ রূপকের আড়ালে মূর্ত হয়েছে রাজপরিবার ও জনজাগরণের বাণী। এই নৃত্যনাট্যগুলিতে নৃত্য ও নাটক যদি হয় দেহ, তবে কাব্যরসাশ্রিত সঙ্গীত হয়েছে তার প্রাণ।


রবীন্দ্রনাথের গীতিপ্রাণতা/লিরীকধর্মিতা:

রবীন্দ্রনাথ মূলতঃ গীতিকবি। তাঁর প্রতিভার মৌল স্বরূপ গীতিধর্মী। একটা নিবিড় মন্ময়তাই তাঁর সাহিত্যের ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। তাঁর নাটকও এই ভাবময়তা বা লিরিকধর্মিতা থেকে মুক্ত নয়। এই ভাবময়তার আতিশয্য লক্ষ্য করে রবীন্দ্র-সমালোচক ড. এডোয়ার্ড টমসন বলেছিলেন: "His dramatic work is the • vehicle of ideas rather than the expression of action", অন্যদিকে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও রবীন্দ্র-নাটকের বিশেষত্ব নির্দেশ করে বলেছেন “রবীন্দ্রনাথের নাটক, কাব্যনাটক, সাঙ্কেতিক নাটক—সবই কবিপ্রত্যয়ের বাহন হয়ে উঠেছে একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু তার সঙ্গে একথাও স্বীকার্য যে, কবিমনোভূমি এই নাটকের রঙ্গভূমি, এবং নাটকের চরিত্রগুলি তারই মানস-সপ্তান হলেও তত্ত্বের অনুরোধে বা কবির ব্যক্তিগত আবেগ-উচ্ছ্বাসের জন্য নাটকের নাট্যধর্ম ক্ষুণ্ন না হয়ে এমন এক্ ধরনের নাট্যকলা সৃষ্টি করেছে যে, বাংলা সাহিত্যে এ ধারাটির গৌরব কোনও দিনই খর্ব হবে না” (“রবীন্দ্রনাথ”, “বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত', পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮২-৪৮৩)। প্রকৃতপক্ষে, কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব নাট্যসাহিত্যেও রবীন্দ্র নাট্যধারা এক স্বতন্ত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবাহ।