বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের কৃতিত্ব তুলনামূলক বিচার করো।

বৈষ্ণবসাহিত্যে মৈথিল কবি বিদ্যাপতির যেমন জনপ্রিয়তা, বাঙালী কবি চণ্ডীদাসের অনুরূপ সমাদর। রবীন্দ্রনাথ দুই কবির পার্থক্য নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছেন- “বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হইয়া পড়েন, চণ্ডীদাসের মিলনেও সুখ নাই বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন, চণ্ডীদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়াছেন, বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চণ্ডীদাস সহ্য করিবার কবি। চণ্ডীদাস সুখের মধ্যে দুখ ও দুখের মধ্যে সুখ দেখিতে পাইয়াছেন। তাঁহার সুখের মধ্যেও ভয় এবং দুখের প্রতিও অনুরাগ। বিদ্যাপতি কেবল জানেন যে মিলনে সুখ, ও বিরহে দুখ, কিন্তু চণ্ডীদাসের হৃদয় আরও গভীর, তিনি উহা অপেক্ষা আরও অধিক জানেন”।


বিদ্যাপতি রাজসভার কবি; বিদগ্ধ সমাজের জন্য তিনি কাব্যকলার চরম সমুন্নতি ঘটিয়েছেন। অলংকার ও শব্দ ব্যবহার পর্যায়ে তার নিপুণতা প্রবাদের মত। প্রেমলীলার বিভিন্ন পর্যায়গুলি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে ভাবোল্লাস পর্যন্ত প্রণয়ের যে নানা পর্ব সেগুলি শিল্পীর দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন এবং মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ ক’রে কিশোরী রাধার যৌবনে পদার্পণ এবং পরবর্তী কালে পূর্বরাগ অভিসার, মান ও ভাবোল্লাসের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। কাব্যের মণ্ডনকলার দিকে বিদ্যাপতির দৃষ্টি ছিল প্রখর। আবার কিছু পদে অন্তরের গভীরতাও প্রকাশ পেয়েছে।


কিন্তু চণ্ডীদাস সম্পর্কে আমরা জানি তিনি একজন গ্রাম্য কবি। ইনি বাশুলির উপাসক ছিলেন। তাঁর সাধন সঙ্গিণী ছিলেন রাণী রাজকিনী–এরকম একটা জনশ্রুতি আছে। চণ্ডীদাস ক’জন ছিলেন তা নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ আছে। সে যাই হোক পদাবলী রচয়িতা চণ্ডীদাস যে উচ্চ কবিত্ব শক্তির অধিকারী ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পূর্বরাগ ও আক্ষেপানুরাগের পদে চণ্ডীদাস তুলনাহীন।


অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন—“চণ্ডীদাসের বাক্রীতি নানা অলংকারে ও ঝংকারে মণ্ডিত না হইলেও তাহার মধ্যে এমন একটা সরল ব্যঞ্জনা আছে যে তাহাকে রসিক হৃদয় সানন্দে গ্রহণ করিবে।” কয়েকটি উদাহরণ দিলে বক্তব্যটির যাথার্থ্য বোঝা যাবে। যেমন— “ক্ষুরের উপর রাধার বসতি নড়িতে কাটিয়ে দেহ”, “বণিকজনার করাত যেমন দুদিকে কাটিয়া যায়”, “কানুর পিরীতি চন্দনের রীতি ঘষিতে সৌরভময়” “বদন থাকিতে না পারে বলিতে তেঁই সে অবোলা নাম”—এই সকল উক্তি সুগভীর ব্যঞ্জনাময়। চণ্ডীদাসের রাধা যেমন গভীর ও ব্যাকুল; চণ্ডীদাসের ভাষাও তেমনি গভীর বেদনায় ও নিবিড় উপলব্ধিতে কম্পমান। চণ্ডীদাস মিলনের কবি নন, উল্লাসের ঐশ্বর্য তাঁর বৈশিষ্ট্য নয়। চণ্ডীদাসের রাধার কৃষ্ণপ্রেম দুঃখের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে খাঁটি সোনার মর্যাদা পেয়েছে। চণ্ডীদাস যে গভীর বেদনার মধ্য দিয়ে রাধা চরিত্র অঙ্কন করেছেন—তার সমধর্মী আর কোনও রচনা বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায় না।


পণ্ডিত কবি বিদ্যাপতিকে ভুলে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু চণ্ডীদাসের পদাবলীর বেদনামধুর সৌন্দর্য কখনও ভোলা সম্ভব নয়। তার গান মুখের ভাষা নয়, বুকের রক্তে তার অভিষেক, অশ্রু লবণাক্ত আর্তিতে তার যা কিছু মূল্য। হৃদয়ের গভীরতা ও অনুভূতির ঐকাস্তিকতা তাঁর রাধার উক্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। মিলন ও আনন্দের কথা রাধা বলেছেন বটে কিন্তু বিরহে ও শোকে উপনীত হয়ে রাধা জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করাতে পেরেছেন। তাঁর রাধা একদিকে মর্ত্যের মানবী আর একদিকে অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনার প্রতীক। তাঁর প্রেমসাধনা নামজপের মতো ঐকান্তিক তদ্গত সাধনা—

না জানি কতেক মধু    শ্যাম নাম আছে গো

বদন ছাড়িতে নাহি পারে।

জপিতে জপিতে নাম    অবশ করিল গো

কেমনে পাইব সই তারে।।


কখনও শ্রীকৃষ্ণকে সব কিছু সমর্পণ ক’রে বলে ওঠেন—

বঁধু কি আর বলিব আমি!

জীবনে মরণে    জনমে জনমে

প্রাণনাথ হৈও তুমি।।

তোমার চরণে     আমার পরাণে

বাঁধিল প্রেমের ফাঁসি।

সব সমর্পিয়া একমন হৈয়া

নিশ্চয় হইলাম দাসী ।।


কৃষ্ণপ্রেম ব্যাখ্যার অতীত। তা উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু বোঝানো যায় না। তাই শ্রীরাধা বলেন—

“রাতি কৈনু দিবস দিবস কৈনু রাতি।

বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি।।’


অপর পক্ষে বিদ্যাপতির পদে গ্রামীণ সরলতা অপেক্ষা নাগরিক আড়ম্বর ঈষৎ অধিক ফুটেছে। কবির অন্তরের গভীর প্রত্যয় কোনও কোনও সময়ে রচনাচাতুর্যের ঐশ্বর্যে কিছুটা আবৃত হয়ে পড়েছে। তিনি রাধার চরিত্রটিকে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত ক'রে প্রকাশ করেছেন (১) বয়ঃসন্ধি বা মুগ্ধভাব (২) অভিসার মিলন মান (৩) মাথুর (৪) ভাবসম্মেলন।


প্রথম দুটি পর্যায়ে রাধার চরিত্রটি মানবিক আবেগ সমন্বিত। কবির সূক্ষ্ম দর্শনশক্তি ও রচনার বিচিত্র কলাকৌশল নিশ্চয় উচ্চ প্রশংসা দাবী করতে পারে। কিন্তু যা হৃদয়কে বেদনায় বিবশ ক'রে দেয় তা তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের অর্থাৎ মাথুর ও ভাবসম্মেলনের পদাবলী।


বক্তব্যের অপূর্বত্ব, উপমা, রূপকের বিচিত্র ব্যবহার, চিত্র সন্নিবেশের অজস্রতায় বিদ্যাপতির পদাবলী বাংলা ও মৈথিলি সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ। কৃষ্ণ রাধাকে চকিতের মধ্যে দেখে বলে ওঠেন—

সজনী ভল কত্র পেখন না ভেল।

মেঘমালা মঁয়ে   তড়িত লতা জনি

হিরদয়ে সেল দেই গেল।।


বিরহের পদেও বিদ্যাপতি অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কৃষ্ণ বিরহে শ্রীরাধার বিলাপের ভাষা অপূর্ব আন্তরিকতায় মণ্ডিত হয়েছে। মিলনে রাধা ধন্য, উল্লসিত ও তৃপ্ত। কিন্তু তবু যেন মনে হয় কোথায় যেন এক ব্যবধান আছে। কৃষ্ণকে নিবিড় ক’রে পেয়েও তিনি কৃষ্ণের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারছেন না।


জনম অবধি হাম     রূপ নেহারলু 

নয়ন না তিরপিত ভেল।

সোই মধুর বোল     শ্রবণ হি শুনলু 

শ্রুতিপথে পরশ না গেল।।

অথবা,

“তুহুঁ, কৈসে মাধব, কহ তুঁহুঁ মোয়” পদে প্রেমের চিরন্তন রহস্যমন্ডিত প্রশ্ন : মাধব তুমি কেমন তা আমাকে বলে দাও।


এছাড়া ভাবোল্লাস ও প্রার্থনার পদে বিদ্যাপতি অনুরূপ কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বিদ্যাপতির রাধা বলেন—

আজু রজনী হাম    ভাগে পোহায়লু

পেখলু পিয়া মুখচন্দা।

জীবন যৌবন   সফল করি মানলু

দশদিশ ভেল নিরদ্বন্দ্বা।।


প্রার্থনার পদে বিদ্যাপতি যেমন আত্মসমর্পণ করেছেন, নিবদেন পর্যায়ের পদে চণ্ডীদাস তেমনি আত্মলীন হ’তে চেয়েছেন। বিদ্যাপতি প্রার্থনা পর্যায়ে নিজেই আত্মসমর্পণ করেছেন আর চণ্ডীদাস রাধার মাধ্যমে আত্মনিবেদন করেছেন। অতএব দেখা যাচ্ছে কবিত্বশক্তিতে কেউ কারও অপেক্ষা ন্যূন নয়। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে কাব্যকলা মণ্ডনে দুজনের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও দু’জন কবি দুটি দিকে শ্রেষ্ঠ কবির সম্মান নিয়ে বিরাজ করছেন। বিদ্যাপতি অসামান্য শ্রুতিমধুর ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং চণ্ডীদাস খাঁটি বাংলায় সহজ সরল ভঙ্গীতে অন্তরের গভীরে প্রবেশ করেছেন।