বাংলা গদ্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাপর্ব : ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭ খ্রীঃ- ১৮৯৪ খ্রীঃ)

বাংলা গদ্যে ভূদেব মুখোপাধ্যায়


ঊনবিংশ শতকে একদিকে ছিল ‘খ্রীস্ট’ ধর্মানুরাগ, অন্যদিকে ছিল পরিশোধিত ‘ব্রাহ্ম’ ভাবনার প্রকাশ। এর পাশাপাশি 'হিন্দু' পুনরুজ্জীবনের এক তৃতীয় ধারা বিকশিত হচ্ছিল, যাকে প্রতিষ্ঠাদানের ক্ষেত্রে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের অবদান ছিল অপরিসীম। হিন্দু কলেজের এই উজ্জ্বল ছাত্রটির মধ্যে ধর্মীয় তথা সমাজ-বিবেক মুখ্যতর হয়ে উঠেছিল।


ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ও কর্মজীবন:

১৮২৭ খ্রীস্টাব্দের ২২শে ফেব্রুয়ারী হুগলীর নতিবপুর গ্রামে প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বংশে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বংশে জন্ম হলেও তাঁর শিক্ষা প্রথমে হয় সংস্কৃত কলেজে, পরে হিন্দু কলেজে ডিরোজিও নেতৃত্বে। তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজের তৃতীয় পর্বের ছাত্র। ডিরোজিয়ানদের আচার-আচরণ, বিশিষ্ট বন্ধু মাইকেল মধুসূদন দত্তের পাশ্চাত্য প্রবণতা দেখে তাঁর মন বিপরীত ভাবনায় আকৃষ্ট হয়। অবশ্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বংশের ঐতিহ্য, বিশেষত তাঁর পিতামহ সার্বভৌম মহাশয়ের ও পিতার সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠা ভূদেবকে যথেষ্ট প্রেরণা দেয়। মা ব্রহ্মময়ীর কাছ থেকে পান দেশপ্রেমের মন্ত্রদীক্ষা। মধুসূদনের মতো সুহৃদকে পান সহপাঠীরূপে।


ভূদেব পূর্ণোদ্যমে তার আচরণে ও রচনায় সদাচারের মহিমা কীর্তনে ব্রতী হয়েছিলেন। এই সদাচার প্রবর্তনে তার লক্ষ্য ছিল প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রের গৌরব এবং প্রাচীন হিন্দু ধর্মের মহিমাকে উজ্জীবিত করা। একসময় যখন ‘আচার’ মাত্রকেই কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়ার একটি প্রথা শিক্ষিতদের মধ্যে চালু হয়েছিল, সেই সময় ভূদেবের এই সদাচারের অনুসরণ যে কতখানি আদর্শস্থানীয় ছিল, তা বোঝা যায় মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষের একটি উক্তিতে—“আমি রঘুনাথ ও রঘুনন্দনের ধারায় বাংলার অত্যুজ্জ্বল ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্রেণীর শেষ আদর্শ ভূদেববাবুতে দেখিয়াছি।

ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:

ভূদেবের রচনা সম্ভারকে প্রমথনাথ বিশী তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন—(ক) বিদ্যালয়ের জন্য, (খ) হিন্দুসমাজের জন্য এবং (গ) সাধারণের জন্য লিখিত।


প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত শিক্ষাব্রতী ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের রচনাগুলি হল ‘শিক্ষা বিধায়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৬), ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান’, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৮-৫৯), ‘পুরাবৃত্তসার’ (১৮৫৮), 'ইংলন্ডের ইতিহাস' (১৮৬২), 'ক্ষেত্ৰতত্ত্ব’, ‘রোমের ইতিহাস’ (১৮৬৩), 'বাঙ্গালার ইতিহাস' (১৯০৪ সালে প্রকাশিত)।


দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত গ্রন্থগুলি হল ‘পারিবারিক প্রবন্ধ' (১৮৮২), 'সামাজিক প্রবন্ধ' (১৮৯২), 'আচার প্রবন্ধ' (১৮৯৪)।


সর্বসাধারণের জন্য লিখিত গ্রন্থ হল 'সফল স্বপ্ন’ ও ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ নামে দুটি কাহিনীযুক্ত গ্রন্থ ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ (প্রকাশ ১৮৬২), 'সফল স্বপ্নের' 'উৎস, কন্টারের 'The Traveller's Dream' অঙ্গুরীয় বিনিময়ের উৎস 'The Marhatta Chier ‘পুষ্পাঞ্জলি' (১৮৬৩), 'স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস' (১৮৯৫), 'বিবিধ প্রবন্ধ' (প্রথমভাগ : ১৮৯৫, দ্বিতীয়ভাগ : ১৯০৫)।


পত্রিকা সম্পাদনা ও পরিচালনা:

'এডুকেশন গেজেট’ (১৮৩৬), ‘শিক্ষাদর্পণ’ ও ‘সংবাদসার’ (১৮৬৪)। ‘আচার প্রবন্ধ’, ‘পারিবারিক প্রবন্ধ' গ্রন্থগুলির মধ্যে হিন্দু সমাজনেতা ভূদেব বাঙালী হিন্দু গৃহস্থের অবশ্য পালনীয় জীবনচর্চা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। প্রমথনাথ বিশীর ভাষায় এগুলি হল ‘গৃহ্যসূত্র’। তিনি ‘ভূদেব-রচনাসম্ভার'-এর ভূমিকায় লিখেছেনঃ “তিনি হিন্দু বাঙালীর ‘গৃহ্যসূত্র’ রচনা করিয়াছিলেন। যেযুগে এসব তিনি লিখিতেছিলেন তখনো হিন্দু বাঙালীর গৃহ ছিল, কাজেই গৃহ্যসূত্রের সার্থকতাও ছিল’” (উদ্ধৃত, ‘বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৫৮)। 'সামাজিক প্রবন্ধ' গ্রন্থের মধ্যে প্রাচীন রাজগণের রাজ্যশাসন থেকে শুরু করে ইংরেজ বণিকগণের রাজ্যশাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, গুণাগুণ বিচার এমন কী ভারতবর্ষে বা অন্যত্র বহির্বাণিজ্যের বিষয়ে বিবিধ জ্ঞানগর্ভ প্রসঙ্গ সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে।


বাংলা ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাসের ক্ষেত্রে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের একটি মূল্যবান স্থান আছে। তাঁর ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়' উপন্যাসকে আদর্শ করেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘দুর্গেশনন্দিনী’ লিখেছিলেন। তাঁর ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস' গ্রন্থে শিবাজী মহারাজের যে কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়েছে ভারত ইতিহাসে মারাঠা পর্বের সেই স্বাদেশিক ইতিহাস পরবর্তীকালে বাঙালী তথা ভারতীয় মনে জাতীয় চেতনা সঞ্চারে সহায়ক হয়েছে। তাঁর অপর উপন্যাস ‘পুষ্পাঞ্জলি’তেও কাহিনী বা আখ্যান অংশ মুখ্য। প্রথমটি লেখা হয়েছিল ইংরাজী উপন্যাসের রীতিতে। এটি লেখা হয় ‘দেশীয় প্রাচীন রীতি’তে। এই উপন্যাসও যে সাহিত্য সম্রাটে’র মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল তা বোঝা যায় ‘পুষ্পাঞ্জলি’ ও ‘আনন্দমঠের’ পারস্পরিক তুলনা করলে। প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন : “পুষ্পাঞ্জলি ও আনন্দমঠ পাশাপাশি রাখিয়া পড়িলে সন্দেহমাত্র থাকে না যে, ১৮৭৬ সালের পুষ্পাঞ্জলি ১৮৮৯ সালের আনন্দমঠে প্রভাব বিস্তার করিয়াছে.....।”


তার ‘বিবিধপ্রবন্ধ’ সাহিত্য সমালোচনা। এর প্রথম ভাগে আছে সংস্কৃত নাটকের আলোচনা, দ্বিতীয়ভাগে আছে পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, শিক্ষাতত্ত্ব, তন্ত্র ইত্যাদি বিবিধ বিষয়। সংস্কৃত নাটকের আলোচনা করতে গিয়ে ভূদেব মুখোপাধ্যায় যে সমাজাশ্রয়ী সাহিত্যের বোধটি প্রকাশ করেছিলেন, ঊনবিংশ শতকের সাহিত্য আলোচনায় তা অনেকাংশেই মান্য আদর্শ হয়ে উঠেছিল।


ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের গদ্যরীতি :

ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের গদ্য বিশেষভাবেই প্রশংসনীয়। তাঁর নিবন্ধের গদ্যভাষা সমকালেই যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল, তার যুক্তিবাদ এবং দার্শনিক প্রত্যয়, তথ্য সন্ধিৎসা, সমকাল-সচেতনতা অনেককেই আকৃষ্ট করেছিল। সেই কারণেই একালের সমালোচকেরা অনেক সময় তার প্রবন্ধের কোন কোন অংশের সঙ্গে ফ্রান্সিস বেকনের তুলনা করেছিলেন।

ভূদেবের ভাষা তার ব্যক্তিত্বের মতোই ঋজু সরল, বাহুল্যহীন, গম্ভীর। সেখানে ভাবাতিশয্য নেই। এই ভাষা রসসাহিত্যের সহায়ক না হোক তা নিঃসন্দেহে জ্ঞাননিষ্ঠ প্রবন্ধের উপযোগী, সংহত ও যুক্তিযুক্ত। দৃষ্টাত্তরূপ উল্লেখ করা যায় তার গদ্যাংশ : “কর্মে নিষ্কামতাই আমাদিগের ধর্মশাস্ত্রের আদর্শ। যাহা কর্তব্য তাহা কায়মনোবাক্যে করিবে, করার ফলাফল কি হইবে তাহার প্রতি কোন লক্ষ্য রাখিবে না। ভারতবর্ষীয়দিগের যে স্বাভাবসিদ্ধ জাতীয়ভাব তাহার অনুশীলন এবং সম্বর্ধন চেষ্টা ভারতবর্ষীয় মাত্রেরই অবশ্য কর্তব্য কর্ম। অতএব তাহা করাই বৈধ না করায় প্রত্যবায় আছে।”


তাঁর 'ঐতিহাসিক উপন্যাস' গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের দূরশ্রুত পদধ্বনি শোনা যায় - “একদা কোন অশ্বারোহী পুরুষ গান্ধার দেশের নির্জন বনে ভ্রমণ করিতেছিলেন ক্রমে দিনকর গগনমণ্ডলের মধ্যবর্তী হইয়া খরতর কিরণ-নিকর বিস্তার দ্বারা ভূতল উত্তপ্ত করিলে পথিক অধ্বভ্রমে ক্লান্ত হইয়া অশ্বকে তরুণ তৃণ ভক্ষণার্থ রজ্জু-মুক্ত করিয়া দিলেন এবং আপনি সমীপবর্ত্তী নির্ঝর তীরে উপবিষ্ট হইয়া চতুর্দিকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। দেখিলেন, স্থানটি ভয়ানক এবং অদ্ভুতরসের আস্পদ হইয়া আছে।”


এইভাবে, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক ভূদেব মুখোপাধ্যায় বাংলা গদ্যসাহিত্যে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্বরূপে বিরাজিত।