‘টিনের তলোয়ারে — ময়না চরিত্রের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করো।

ময়না রাস্তার মেয়ে। তার জন্ম-কাহিনি অজ্ঞাত। সে যুবতী বয়সে বদ্দীবাটীর আলু হাসনানের বেগুন বেচে পেট চালাত। কিন্তু তার গানের গলা অতি চমৎকার। বেণীমাধব ভোর রাত্রে দেয়ালে পোস্টার সাঁটার সময় হঠাৎ নেপথ্যে নারী কণ্ঠের গান শুনতে পায়—

“ছেড়ে কলকাতা বোস হবো পগার পার। 

পুঁজি পাটা চুলোয় গেল পেট চালানো হল ভার।।”


গান শুনে অবাক বেণীমাধব। কৌতূহল তীব্র হল। মেথরের কাছে জানতে পারে গায়িকাটি ময়না। বেণীমাধব তার পিছু নেয়। ময়নাকে থিয়েটারে আসতে আমন্ত্রণ জানায়। আশ্বাস দেয় তাকে নায়িকা করবে। যার জীবন ছিল বেগুন বেচা, সে যদি কোনো থিয়েটারে নায়িকা হবার সুযোগ পায়, সে তো স্বপ্নের মতো। কাজেই ময়না সহজেই রাজি হল, অর্থাৎ ময়না দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় গৃহীত হল।


‘ময়নার জন্য নির্দিষ্ট হল ‘ময়ূর বাহন' নাটকের নায়িকা অনুরাধার ভূমিকা। ময়নার উচ্চারণ স্পষ্ট নয়। অপর নায়িকা বসুন্ধরার সাহচার্যে অল্পদিনেই সুন্দরী রূপসী নারীতে রুপান্তরিত হয়। ময়নার পরিবর্তন দেখে থিয়েটারের অন্যান্য অভিনেতারা হতবাক। যদুর ভাষায় 'ফড়িং প্রজাপতি হয়েছে। যথার্থই বেণীমাধব দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। তার শিক্ষাগুণে ময়না শুদ্ধ উচ্চারণ শিখেছে। ময়না বেণীমাধবকে বাবা বলে ডাকে। অভিনয়ের প্রাক্-মূহূর্তে শিক্ষাগুরু রূপে বেণীমাধবকে প্রণাম করে ময়না মঞে অভিনয় করতে নামে। বেণীমাধব মঞে বিক্রম বেশে প্রবেশ করে দর্শক সাধারণকে সাবধান করে দেয়,— মঞ্চের নায়িকা অশ্রদ্ধার পাত্রী নয়। তাকে পতিতা পল্লির উপভোগ্যা নারী মনে করা অন্যায়। অভিনয় গুণে ময়না সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে গেল। রূপান্তরিত হল স্বনামধন্য নায়িকায়। যথার্থই ময়নার এখন নতুন বেশ, নতুন মন। অভিনয় ছাড়া কলকাতায় সে এখন সব দেখে, বুলবুলির লড়াই দেখে। তার জীবনে এসেছে পরিবর্তন। সে জীবনকে নতুন করে উপভোগ করতে চায়। থিয়েটারে সে চেয়েছে তার মনের মানুষকে। বলা বাহুল্য তার নাম প্রিয়নাথ। প্রিয়নাথের ব্যবহার, মার্জিত রুচি, নাট্যরচনা কৌশল, দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদাবোধ সমস্ত কিছুই ময়নাকে মুগ্ধ করে।


একদা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দা বেণীকে প্রস্তাব দেয় নতুন থিয়েটারে তাকে মলিক করা হবে। বিনিময়ে সে চায় ময়নাকে। অর্থাৎ রক্ষিতারূপে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ময়নাকে রাখতে চায়। কিন্তু ময়না তাকে ঘৃণা করে। অথচ মহাকালের নির্দেশে সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে বিনামূল্যেই বিক্রি হয়ে গেল ময়না তার ব্যক্তিগত অভিরুচির বিরুদ্ধে। চরম দুঃখ ও অনুশোচনায় সে বেণীকে বলে— “ভিখিরি যখন ছিলাম তখন তরকারি বেচে পেট চালাতাম। এখন এমন ভদ্র মহিলা বানিয়েছ বাবু যে বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কেন তুলে এনেছিলে রাস্তা থেকে? অর্থাৎ যখন সে আলু বেগুন বেচে জীবিকা নির্বাহ করত তখন তাকে বিক্রি করে দেবার সাহস কেউ দেখাতে পারত না, কিন্তু থিয়েটারের নায়িকা হয়ে তাকে হতে হল বেশ্যা, এরজন্য দায়ী সেই বেণীমাধব ৷ সে তাকে কেবল বাবা ও শিক্ষাগুরু বলে জানত। কিন্তু বেণী স্বীকার করে নীতিবোধ থাকলে থিয়েটার চালানো যায় না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁয়েদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙেই থিয়েটার চালাতে হয়। তার জন্য থিয়েটারের মেয়েরা হয় থিয়েটার মালিকবাবুর রক্ষিতা। বসুন্ধরা ময়নাকে থিয়েটার ছেড়ে চলে যেতে বললে ময়না অসহায়ভাবে জানায়—তার আর যাবার জায়গা নেই। সব পথই বন্ধ।


প্রিয়নাথ ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে বেণীমাধব রাজি হয় না। কারণ অনেক কষ্টে সে তাকে অভিনেত্রী করে গড়ে তুলেছে। অভিনয়েই যথার্থ মুক্তি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ময়নাকে রক্ষিতা করুক তাও ভালো, কিন্তু প্রিয়নাথের বৌ হলে সেটাই হবে ময়নার বেশ্যাবৃত্তি। বেণী ময়নাকে কারুর ঘরে বউরূপে দেখতে চায় না। আরও বড়ো আশ্চর্যের কথা, প্রিয়নাথের আহ্বান স্বয়ং ময়নাই অগ্রাহ্য করে। সে চিৎকার করে কেঁদে প্রিয়নাথকে জানায়— “পারবো না, থিয়েটার ছাড়া বাচঁবো না। এরাই পিতামাতা ভাইবোন সব, এদের পথে বসিয়ে চলে যেতে পারবো না। আবার গরিব হয়ে যেতেও আমি পারবো না।” অর্থাৎ ময়না এখন দারিদ্র্যকে ঘৃণা করে, সে এখন সতীত্বের পরোয়া করে না। থিয়েটারের স্বার্থেই অশিক্ষিত রুচিহীন মুৎসুদ্দীর শয্যায় স্থান গ্রহণ করে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ময়নার নতুন নাম দেয় টুকটুকি।


তবে ময়না ভোলেনি প্রিয়নাথকে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বারণ সত্ত্বেও সে বেণীকে বলে প্রিয়নাথের নাটক তিতুমীর-এ অভিনয় করতে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ময়নাকে কাছে রাখলেও ময়নার ওপর অত্যাচার করে। ময়নাকে মারে, প্রিয়নাথের নাম করলেই ময়না মার খায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে। অতএব থিয়েটারে প্রিয়নাথের নাটক অভিনয় করার ব্যাপারে সে উচ্চকণ্ঠে তার মনের অভিলাষ ব্যক্ত করে। এমনকি তিতুমীরের অভিনয়ের সময় ময়না বক্সে বসেই ল্যাম্বার্টকে শুনিয়েই দেশপ্রেমের কবিতা আওড়ায়। ময়নাকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শয্যায় স্থান দিলেও তার মনের অধিকার পায়নি। সে অধিকার প্রিয়নাথের। ময়না যথার্থ ব্যক্তিত্বময়ী স্বাধীন নারী। সে তার প্রেমের প্রকাশে বাধাবন্ধনহীন। এখানেই ময়না চরিত্রের সার্থকতা।


সর্বোপরি, ময়নার কথা স্মরণকালে মনে পড়ে যায় নটী বিনোদিনীর কথা। তাঁকে কাছে পাবার শর্তে জনৈক মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী গুমুর্খ রায় গিরিশচন্দ্রকে প্রস্তাব দেয় থিয়েটার প্রতিষ্ঠার। ফলস্বরূপ সেই থিয়েটার এর নাম দেওয়া হবে বিনোদিনীর আদ্যক্ষর 'বি' দিয়ে। গিরিশচন্দ্র বিনোদিনীকে গুর্মুখ রায়ের হাতে তুলে দিলেও বিনোদিনীর নামে থিয়েটারের নাম রাখেননি। বেণীও গিরিশচন্দ্রের মতো বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রস্তাবে থিয়েটারের মালিক হয়। বিনিময়ে ময়নাকে তুলে দিতে হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের হাতে । (ময়না চরিত্র পরিকল্পনায় নটী বিনোদিনীর কথা যে নাট্যকার উৎপল দত্ত বিস্মৃত হননি। তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ ময়না চরিত্র সৃষ্টি নটী বিনোদিনীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্পণ।