বাংলা গদ্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাপর্ব : বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ খ্ৰীঃ-১৯৭৪ খ্রীঃ)

বাংলা গদ্যে বুদ্ধদেব বসু


“আমাদের মধ্যে যার যেটুকু গুণপনা আছে সেটা যত ছোটই হোক) তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার না-করাটা অন্যায়, এটা আমি ধর্মের মতো বিশ্বাস করি” (উদ্ধৃত, ‘দর্পণে বিম্বিত মুখ বুদ্ধদেব বসুর চিঠি, সুদক্ষিণা ঘোষ, ‘বিষয় চিঠিপত্র’, কোরক সাহিত্যপত্রিকা, ১৪১১, সেপ্টেম্বর ডিসেম্বর, ২০০৪, পৃষ্ঠা ২৭৫)। উদারতায় ভরা এইরকম এক বালক আধুনিক ভাবনা ছড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের মুক্ত প্রাঙ্গণে তরুণ লেখকদের বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তরুণ বয়সেই তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত। কবি-সমালোচক-অধ্যাপক-ঔপন্যাসিক ছোট গল্পকার-নাট্যকার-ভ্রমণরসিক-শিশুসাহিত্যিক-পত্রিকা সম্পাদক ইত্যাদি বিবিধ ভূমিকায় তাঁকে দেখা যায়। তবে আপাতত প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেবের পরিচয় অন্বেষণই আমাদের উদ্দেশ্য।


বুদ্ধদেব বসুর জন্ম ও কর্মজীবন:

বুদ্ধদেবের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল ঢাকার বহর বিক্রমপুর গ্রামে। ঢাকা জেলার মালখানগড়ে বসু পরিবার ছিল বিখ্যাত। এই পরিবারে ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বুদ্ধদেবের জন্ম হয়। জন্মমুহূর্তেই বুদ্ধদেব মাতৃহারা হয়ে দিদিমা ও দাদামশায়ের আশ্রয়ে মানুষ হন। ছেলেবেলা কাটে নোয়াখালিতে। শিক্ষা শুরু হয় ঢাকায়। বাল্যকালেই মেধাবী ছাত্ররূপে সুনাম অর্জন করেন। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপরে অধ্যাপনার জন্য সচেষ্ট হন। তিন বছর পর ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে কলকাতার রিপন কলেজে অধ্যাপকরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। সহকর্মীরূপে কবি বিষ্ণু দে এবং খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিদের সাহচর্য লাভ করেন। তবে কলেজে অধ্যাপনার কাজ স্থায়ী হয়নি। এর পরে ১৯৪৪ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত 'The Statesman' পত্রিকায় স্বাধীন সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু সাহিত্যসৃষ্টির তাগিদে সেই কাজেও বেশি দিন থাকেননি। কারণ সাহিত্যসৃষ্টি ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। মনে হয়েছিল, “যদি আমি সাহিত্যে ফিরতে না পারি তাহলে আমার সুখ শান্তি স্বাস্থ্য কিছুই হবে না—তার জন্য যে কোনো উপায় বরেণ্য।” অথচ আর্থিক অসুবিধা ছিল যথেষ্ট। স্কুলের জন্য পাঠ্যপুস্তকও লিখেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায় : “Lean days followed, I had bleak imitations of poverty, and I struggled hard to keep it at bay.” (দ্রষ্টব্য : কোরক সাহিত্য পত্রিকা, ১৪১১, বিষয় : চিঠিপত্র, পৃষ্ঠা ২৭১)।


১৯৫৬ সালে যাদবপুরে ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ (Comperative Literature) বিভাগ গড়ে ওঠে। এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান অধ্যাপক হন বুদ্ধদেব বসু। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশ গুহ প্রমুখ অনেক লব্ধপ্ৰতিষ্ঠ লেখককে তিনি পড়ানোর জন্য আহ্বান করেন। অথচ এক অভাবিত পরিস্থিতিতে নিজের হাতে গড়া এই বিভাগ একসময় ছেড়ে যেতে তিনি বাধ্য হন। ইণ্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অতিথি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালনের কথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানতেন। কিন্তু পরে সেইজন্য তাঁকে ছুটি দিতে অসম্মত হন। আত্মমার্যাদা সম্পন্ন কবি বুদ্ধদেব চাকরিতে ইস্তফা দেন। পরে আর কোনদিনই তিনি চাকরিতে প্রত্যাবর্তন করেন নি।


এর পরেও বুদ্ধদেব ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বিদেশের নানা কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময় পড়িয়েছেন; যেমন পিটসবার্গে, পেনসিলভানিয়া কলেজ ফর উইমেন, ব্লুমিংটনে ইলিনয়ের ওয়েসলিয়ান কলেজে অধ্যাপনা ইত্যাদি।


কবি, কাব্যসমালোচক, ভ্রমণরসিক, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, রম্যরচনাকার, সম্পাদক রূপে প্রসিদ্ধ উত্তর-রৈরিক বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু এক স্মরণীয় পুরুষ। তার রচিত এবং জীবিতকালে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫৩, মরণোত্তর প্রকাশনার সংখ্যা ৭টি (উৎস সূত্র : বুদ্ধদেব বসুর রচনাসংগ্রহ)। তাঁর সমগ্র রচনাবলী ১২টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এই বিপুল রচনা সম্ভারের মধ্যে তাঁর প্রবন্ধ, গ্রন্থের ভূমিকা বা প্রবন্ধজাতীয় রচনা, স্মৃতিকথা এবং রম্যরচনা (ভ্রমণ কাহিনীসহ)-কে কয়েকটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়; যেমন


(১) প্রবন্ধগ্রন্থ ও ভূমিকা জাতীয় রচনা ; 'হঠাৎ-আলোর ঝল্কানি’ (সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫), ‘উত্তরতিরিশ’ (১৯শে জুলাই, ১৯৪৫), ‘কালের 'পুতুল' (২রা অক্টোবর, ১৯৪৬), 'An Acre of Green Grass (1948), আধুনিক বাংলা কবিতা’ (সম্পাদনা, ভূমিকা অংশ, ফাল্গুন, ১৩৬০), 'Favourite Author (1953), ‘সাহিত্যচর্চা' (সমালোচনা-প্রবন্ধ, ১৯৫৪), 'রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য' (সমালোচনা প্রবন্ধ, মে, ১৯৫৫), 'স্বদেশ ও সংস্কৃতি' (সমালোচনা প্রবন্ধ, ১৯৫৭), 'কালিদাসের মেঘদূত' (মূলসহ অনুবাদ, ভূমিকা ও টীকা, সেপ্টেম্বর, ১৯৫৭), 'শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা' (অনুবাদ, ভূমিকা, টীকা, জানুয়ারী, ১৯৬১), "Tagore: Portrait of a Poet' (সমালোচনা প্রবন্ধ, August, 1962, enlarged edition 1994), 'সঙ্গ : নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ’ (জানুয়ারি ১৯৬৩), ‘প্রবন্ধ-সংকলন’ (এপ্রিল, ১৯৬৬), ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ (জুন, ১৯৬৬), ‘হোল্ডলিনের কবিতা' (অনুবাদ, ভূমিকা, টীকা, (ডিসেম্বর ১৯৬৭), ‘রাইনার মারিয়া রিলকে-র কবিতা' (অনুবাদ, ভূমিকা, টীকা, অগাস্ট ১৯৭০), 'An anthology of Bengali Writing' (বাংলা সাহিত্যের সম্পাদিত সংকলন, 1971), ‘মহাভারতের কথা' (১৯৭৪), 'কবিতার শত্রু ও মিত্র’ (অগাস্ট ১৯৭৪)।


(২) রম্যরচনা ও ভ্রমণ কথা: ‘সমুদ্রতীর' (ভ্রমণ, জুলাই ১৯৩৭), 'আমি চঞ্চল হে’ (ভ্রমণ, অগাস্ট ১৯৩৭), 'সব পেয়েছির দেশে’ (শান্তিনিকেতন ভ্রমণ, অগাস্ট ১৯৩৭), ‘জাপানী জার্নাল’ (ভ্রমণ, মে ১৯৬২), ‘দেশান্তর’ (ভ্রমণ, এপ্রিল ১৯৬৬)।


(৩) স্মৃতিকথা : আমার ছেলেবেলা’ (মার্চ, ১৯৭৩), 'আমার যৌবন' (এপ্রিল, ১৯৭৬)।


(৪) পত্রিকা সম্পাদনা : (ক) প্রগতিকবি অজিতকুমার দত্তের সঙ্গে যুক্ত সম্পাদনা (১৯২৭-১৯২৯ খ্ৰীঃ), মাত্র দু’বছর পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। (খ) ‘কবিতা’ (আশ্বিন ১৩৪২ বঙ্গাব্দ/১৯৩৫-১৯৬১ খ্রীঃ)। পত্রিকাটি শততম সংখ্যা ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার বিশেষত্ব হলঃ তিন দশক ধরে বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতি নির্ণয়, খ্যাত-অখ্যাত বিভিন্ন কবিদের কবিতা প্রকাশ, শুদ্ধ রুচি ও আদর্শনিষ্ঠা অনুসরণ ইত্যাদি। বাংলাদেশের সমস্ত প্রধান কবি এর সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রথম কয়েক বছর বুদ্ধদেবের সঙ্গে পত্রিকাটির সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং কবি সমর সেন।


শ্রেণী ও বিষয়-বৈচিত্র্য : বুদ্ধদেব বসু বস্তুনিষ্ঠ এবং ব্যক্তিনিষ্ঠ দু-জাতীয় প্রবন্ধই লিখেছেন। সাহিত্যসমালোচনা তার হাতে 'সৃষ্টিকর্মে’ পরিণত হয়েছে। বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকেও তার প্রাচুর্য চোখে পড়ে; যেমন— ১. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা, ২. নজরুল ইসলাম, ৩. জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে, ৪. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : কবি, ৫. অমিয় চক্রবর্তীর পালাবদল, ৬. রামায়ণ, ৭. বাংলা শিশুসাহিত্য, ৮. সংস্কৃত কবিতা ও আধুনিক যুগ, ৯. শার্ল বোদলেয়ার ও আধুনিক কবিতা, ১০. ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্ব, ১১. চার্লস চ্যাপলিন, ১২. এক গ্রীষ্ম দুই কবি, ১৩. মধুসূদন দত্ত, ১৪. সমর সেন, ১৫. সুভাষ মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি। ইংরেজিতে রচিত প্রবন্ধের মধ্যে আছে : 16. Modern Bengali Prose, 17. Pramatha Chaudhury, 18. Sarat Chandra Chattopadhyay, 19. Rajsekhar Bose, 20. Sisir Kr. Bhaduri.


অন্যদিকে ‘রম্যরচনা ও ভ্রমণ' শ্রেণীর মধ্যে আছে ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধের প্রকাশ। এই পর্যায়ে আছে

  • (ক) পুরানা পল্টন,
  • (খ) ক্লাইভ স্ট্রিটে চঁাদ,
  • (গ) মৃত্যু-জল্পনা,
  • (ঘ) উত্তর তিরিশ,
  • (ঙ) আড্ডা,
  • (চ) নোয়াখালি,
  • (ছ) কোণারকের পথে,
  • (জ) গোপালপুর-অন্-সী,
  • (ঝ) রবীন্দ্রনাথের শেষজীবন,
  • (ঞ) বীটবংশ ও গ্রীনিচ গ্রাম,
  • (ট) 'যে-আঁধার আলোর অধিক’ প্রভৃতি।

আত্মকথা বা স্মৃতিচারণার লক্ষণ ধরা পড়েছে 'আমার ছেলেবেলা', ‘আমার যৌবন’ ইত্যাদি রচনায়।


বুদ্ধদেবের সাহিত্য রবীন্দ্র-সমালোচনা:

প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেবের সাহিত্য সমালোচনার বিশেষ পরিচয়টি রবীন্দ্র-সমালোচনার মধ্যে প্রকাশিত। কাব্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে তরুণ বয়সে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রবিরোধী গোষ্ঠীর প্রধান মুখপাত্র। কল্লোল কালিকলম-প্রগতি পত্রিকায় আছে এর নানা চিহ্ন। আবার সেই একই ব্যক্তি রবীন্দ্রসমালোচনায় নানা নতুন ভাবনার দিক নির্দেশক। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রবন্ধ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত তাঁর রচনার সংখ্যা ছ'টি; যেমন—‘রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি ও বাঙালি’, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও গদ্যশিল্প’, ‘কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ’, ‘গল্পগুচ্ছ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' এবং রম্যরচনার মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবন'। এইভাবে রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকেও আলোচনার বিষয় করে রবীন্দ্র সমালোচনায় তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন; যেমন ‘রবীন্দ্রনাথঃ বিশ্বকবি ও বাঙালি’ প্রবন্ধে বলেছেন: “চিন্তাহীন মাল্যচন্দনে আজ আবৃত তিনি, এক বিগ্রহ, তাঁর মাতৃভূমির নব্যতম ‘অবতার’। এখানে গ্যেটে, ওয়াডসওয়ার্থ, হুগো, হুইটম্যান, টেনিসন, শেলি, কীটস প্রমুখ পাশ্চাত্ত্য কবিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনা করে বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যে তিনি কেন উপেক্ষিত তার আবেগপূর্ণ অথচ চিন্তাশীল কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। শেষে সিদ্ধান্ত করেছেন “স্বজাতির প্রতি তার বাৎসল্যের” জন্যই নানা কাজে যুক্ত হয়ে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন “যথার্থভাবে কবিতার যা অঙ্গ নয় এমন বহু বিষয়ের দ্বারা ‘লুব্ধ’ হ’য়ে তিনি এমনকি তার অমরতার একটি অংশ ত্যাগ করেছেন” (পূর্বোক্ত, ‘প্রবন্ধ-সংকলন, পৃষ্ঠা ২২)।


‘রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ’ ও গদ্যশিল্প’তে বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথের গদ্যনিবন্ধের মধ্যে “মনের বিদ্যুৎধর্মিতা” এবং “অন্তর্দৃষ্টি” বা “বিশ্বগ্রহণের সহজ ক্ষমতা” লক্ষ্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথের একটি নির্বাচিত রচনা সংকলনের প্রয়োজনের কথা বলেছেন। ‘কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ' প্রবন্ধে কোথাও তিনি করেছেন তীব্র সমালোচনা : “উপন্যাসের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের স্বভাবে আর উত্তরাধিকারে যে-বিরোধ ছিল, তার দুষ্ক্রিয়তার সবচেয়ে শোচনীয় দৃষ্টান্ত ‘চোখের বালি’র উপসংহার”; কোথাও আছে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ “....রবীন্দ্রনাথ ধীরে এগিয়েছেন, হঠাৎ কিছু বদল ঘটাতে যাননি।” শেষে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন“... বাংলা উপন্যাসের যে-সৌধ আজ উঠেছে, সেখানে বঙ্কিম ভিত্তিস্থাপক হ’লেও রবীন্দ্রনাথই প্রধান স্থপতি, আর– যেহেতু তিনি ‘ঘরে বাইরে' লিখেছেন, ‘শেষের কবিতা’ লিখেছেন—পরবর্তীরও যাত্রাস্থল; এর পর যাঁরা বাড়াবেন, বদলাবেন, নতুন নতুন মহল বানাবেন, তেতলার ওপর চারতলা-পাঁচতলা তুলবেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠ না নিলে তাদের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হবে না। রুচির গুরু তিনি, রূপায়ণের ভাষাশিল্পের”; ‘গল্পগুচ্ছে’র আলোচনায় কবি সমালোচক বুদ্ধদেব উপমা প্রয়োগের উপযোগিতা দেখিয়ে নবতর ব্যাখ্যা করেছেন “...‘গল্পগুচ্ছে’র অধিকাংশ উপমায় বাহ্য বস্তুর প্রতিকৃতি শুধু নয়, মানসিক অবস্থার প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে.... সহায়হীন অবস্থায় আখ্যান যেখানে পৌঁছতে পারে না, মনের সেই গহন অংশে উপমা ও বিশেষণাদি যেন প্রদীপের মতো কাজ ক'রে যাচ্ছে। ভাষার সঙ্গে কাহিনীর এই অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কথাসাহিত্যে আমরা পাই না; এবং 'গল্পগুচ্ছে’ প্রায় সর্বত্র তা পাওয়া যায় ব’লে এই গ্রন্থের আবেদন এমন চিরায়ত।” “রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধের বিষয় চারটি পর্যায়ে বিন্যস্ত; যথা

  • (১) স্বভাবকবির উল্লেখসহ বিশ শতকের বাংলা কাব্যের প্রথম দুই দশকের সংকট বিশ্লেষণ
  • (২) রবীন্দ্রানুরাগী সত্যেন্দ্রনাথ ও সমকালীন কবিদের অবলুপ্তির কারণ নির্দেশ,
  • (৩) কল্লোল গোষ্ঠীর রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্তির চেষ্টা ও বাংলাকাব্যে মোড় ফেরাবার ঘণ্টাধ্বনি ব্যাখ্যা,
  • (৪) প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ মধ্যবর্তী আধুনিক কবিদের মূল্যায়ন এবং রবীন্দ্র-উত্তরাধিকারের স্বরূপ নির্ধারণ।

এখানে বুদ্ধদেব রবীন্দ্র-কাব্যকলার আপাত-সরল জটিলতা, কবিমনের গূঢ় দ্বন্দ্ব, তাকে অনুকরণের ব্যর্থ চেষ্টা ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর অভিমত দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছেন। কল্লোল যুগের লেখকদের সম্পর্কে তার মনোভাবটিও প্রকট। তার মতে কল্লোল যুগের “প্রধান লক্ষণই বিদ্রোহ, আর সে বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্যই রবীন্দ্রনাথ”। এই বিদ্রোহের প্রয়োজন ছিল “বাংলা কবিতার মুক্তির জন্য” এবং “রবীন্দ্রনাথকে সত্য করে পাওয়ার জন্য।”


বুদ্ধদেব পরিণত জীবনে এই সত্য করে পাওয়ার আশায় হয়ত ছুটে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবন’ দেখে তাঁর উপলব্ধি হয় “কোনো প্রশ্নেরই তিনি নিরুত্তর নন, কোনো প্রসঙ্গেই অনিচ্ছুক নন। তিনি সর্বদাই প্রস্তুত; একদিকে যেমন তাঁকে ঘিরে আছে অফুরন্ত ছুটি, তেমনি আবার তাঁর মনের কারখানা-ঘরে ছুটির লাল তারিখ কখনো ছিল না, এখনো নেই... (উদ্ধৃত, প্রবন্ধ সংকলন, পৃষ্ঠা ৩৭৩)।


বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য সমালোচনা ও অন্যান্য গ্রন্থ আলোচনা:

বুদ্ধদেবের সাহিত্যজিজ্ঞাসা শুধু রবীন্দ্রনাথের মধ্যে গণ্ডীবদ্ধ ছিল না, অন্যান্য কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক-চলচ্চিত্র ও নাট্যাভিনেতা, ভাষা সাহিত্য-মানবতা ইত্যাদি বিষয়ের মধ্যেও পরিব্যাপ্ত ছিল; যেমন ‘কালের পুতুল' গ্রন্থে আছে 'নজরুল ইসলাম' (১৯৪৪), ‘জীবনানন্দ দাশ’-এর ‘স্মরণে’ (১৯৫৫), অমিয় চক্রবর্তীর ‘পালা বদল’ (১৯৫৫) প্রভৃতি প্রবন্ধ।


‘সঙ্গ : নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথে’ আছে একদিকে রবীন্দ্রনাথের আলোচনা। অন্যদিকে ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : কবি’, ‘বারিস পস্তেরনাক’ ‘রাজশেখর বসু’, ‘শিশিরকুমার ভাদুড়ী’ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রবন্ধ। আবার ‘সাহিত্যচর্চা' গ্রন্থে স্থান পেয়েছে বাংলা শিশুসাহিত্য' (১৯৫২), ‘রামায়ণ’ (১৯৪৭), ‘মধুসূদন দত্ত' ইত্যাদি রচনাসমূহ।


‘সংস্কৃত কবিতা ও আধুনিক যুগ' (১৯৬০) নিয়ে এক রমণীয় আলোচনা আছে 'কালিদাসের মেঘদূত' গ্রন্থের ভূমিকাতে। অনুরূপভাবে ‘শার্ল বোদলেয়ার ও আধুনিক কবিতা’র (১৯০৮) পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা স্থান পেয়েছে ‘শার্ল বোদলেয়ার তার কবিতা' গ্রন্থের ভূমিকা অংশে।


সরকারি ভাষা কমিশনের বিবৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা হয় ‘ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্ব’ (১৯৫৭)। এটি ‘স্বদেশ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে স্থান পায়। এই গ্রন্থে আছে ‘চালর্স চ্যাপলিনে’র (১৯৪৯) মতো সুখপাঠ্য রচনা এবং দুই কবির তুলনামূলক আলোচনা ‘এক গ্রীষ্মে দুই কবি” (১৯৫৮)।


আবার তার ইংরেজি গ্রন্থ 'An Acre of Green Grass এর অন্তর্ভুক্ত, 'Modern Bengali Prose', 'Pramatha Chaudhury', 'Sarat Chandra Chattopadhyay' উল্লেখযোগ্য রচনারূপে স্বীকৃত।


প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেবের সমালোচনা যেমন ‘ইম্প্রেশানস্টিক' (তার ভাষায় ‘বিস্বধর্মী’) তেমনি অনেক প্রবন্ধের আলোচনা 'অ্যানালিটিক্যাল' বা বিশ্লেষণধর্মী; যেমন একটি বালক মনের প্রতিবিম্বে অথবা স্মৃতিচারণায় সুকুমার রায়ের বিশ্লেষণ“আবোল তাবোল’-এর সঙ্গী বই এবার প্রকাশিত হ’ল ‘খাই-খাই' নামে। বইটি চোখে দেখে, এমন কি শুধু নাম শুনে, আমার মনে প'ড়ে গেল ‘খাই-খাই’ কবিতা যখন প্রথম বেরিয়েছিল অদূরবর্তী, সুদূরবর্তী অতীতে।...মনে পড়ে একটি বালককে অসংখ্য বার এটি আবৃত্তি করতে হয়েছিল, আর তা-ই শুনে বয়স্কজনেরা কতই না হেসেছিলেন।...‘খাই খাই’ পদ্যে লেখা হ’লেও আসলে একটি প্রবন্ধ বা অভিধানের ছিন্নপত্র; অথচ রঙে রসে উজ্জ্বল; পণ্ডিতের সঙ্গে রসিক এখানে মিলেছে, আর রসিকতায় গান দিয়ে যাচ্ছে ছন্দ-মিলের দাঁড়িকমা। ঐ মিল-স্বচ্ছন্দ, অভিনব, অনিবার্য এক একটি মিল—ওর প্রয়োজন ছিলো ওখানে—নয়তো অতক্ষণ ধ’রে সহ্য করা যেতো না” (দ্রষ্টব্য : “বাংলা শিশুসাহিত্য”, ‘প্রবন্ধ সংকলন’, প্রথম দে'জ সংস্করণ, মাঘ ১৩৮৮, ফেব্রুয়ারি ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১৬৭ ১৬৮)।


আবার তরুণ বয়সে ‘প্রগতি’র পাতায় জীবনানন্দের কবিতা আলোচনায় ইংরেজি শব্দের অবিরল ব্যবহারে লজ্জার কথা (...আজ আমার কর্ণমূল আরক্ত হচ্ছে’) অকপটে বলেছেন বুদ্ধদেব। আর সেইসঙ্গে আছে জীবনানন্দের কবিতায় শব্দ ব্যবহারের চুলচেরা বিশ্লেষণ “কোনো মহিলার চোখের আকার নিশ্চয়ই পাখির বাসার মতো হয় না, কিন্তু ক্লান্ত প্রাণের পক্ষে কখনো কোনো চোখ আশ্রয়ের নীড় হতে পারে। যে মানুষ আপন হাতে মরতে চলেছে তার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল ‘উটের গ্রীবার মতো’ নিস্তব্ধতা, এই অপরিচিত ও অপ্রত্যাশিত ছবিতে আসন্ন আত্মঘাতের আবহাওয়াটা আরো থমথমে ও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল....। 'সমাচার' কথাটাও লক্ষণীয়। মিশনারিরা ‘গসপেল’-এর আক্ষরিক অনুবাদ করেন ‘সুসমাচার’–এ কথাটা মনে রাখলেই ধরা পড়ে যে শব্দটিতে এখানে ‘খবরে’র চাইতে অনেক বেশি কিছু বোঝাচ্ছে (দ্রষ্টব্য : ‘প্রবন্ধ সংকলন’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১৮)।


বুদ্ধদেবের কোন কোন প্রবন্ধের ভাষা গতিশীল এবং চিত্রময়। রাজশেখর বসুর বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদ আলোচনায় আদি কবির নিসর্গ বর্ণনার প্রয়োজনটুকু তিনি যেন কথা দিয়ে ছবি এঁকেছেনঃ “ঘনজটিল বনের মধ্যে চলতে চলতে হঠাৎ যেন একটা স্বচ্ছনীল হ্রদের ধারে এলুম। সেখানে নৌকো আমাদের তুলে নিয়ে জলের গান শোনাতে লাগল; ওপারে জটিলতর পথ, কুটিলতম কঁাটা—কিন্তু এই অবসরটুকু এমন মনোহরণ তো সেইজন্যই। বনবাসের দুঃখ, সীতা হারানোর দুঃখ, বালীবধের উত্তেজনা ও অবসাদ— সমস্ত শেষ হয়েছে, সামনে পড়ে আছে মহাযুদ্ধের বীভৎসতা : দুই ব্যস্ততার মাঝখানে একটু শাস্তি, সৌন্দর্য-সম্ভোগের বিশুদ্ধ একটু আনন্দ। এই বিরতির প্রয়োজন ছিল সকলেরই—কাব্যের, কবির এবং পাঠকের, আর সবচেয়ে বেশি রামের। বর্ণনার শ্লোকগুলি রামের মুখে বসিয়ে বাল্মীকি সুতীক্ষ্ণ নাট্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন” (দ্রষ্টব্য, ‘প্রবন্ধ সংকলন’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭)। কবি ব্যতীত এই অনুভূতির আবিষ্কার সম্ভব নয়।


‘সংস্কৃত কবিতা ও আধুনিক যুগ' প্রবন্ধে সংস্কৃত ভাষার অবক্ষয়ের কারণ অনুসন্ধানে লেখকের পাণ্ডিত্য, তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ, রসবোধ এবং নাটকীয় অভিব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায় “এ দেশেও সংস্কৃত বিদ্যার অর্থ দাঁড়িয়েছে সাল-তারিখ নিয়ে সংগ্রাম, তথ্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা, এবং বিবরণ। আমরা যারা সাধারণ পাঠক তাদের প্রায় ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সংস্কৃত 'মৃত' ভাষা হ'লেও তার সাহিত্য জীবক্ত ...পৃথিবীর মধ্যে শুধু সংস্কৃতই এক বিশাল ও শ্রদ্ধেয় শবে পরিণত হয়েছে, ব্যবচ্ছেদের প্রকরণ না-শিখে যার সম্মুখীন হওয়া যাবে না। আমাদের সঙ্গে সংস্কৃত কবিতার যে বিচ্ছেদ ঘটেছে এই তার অন্যতর কারণ” (দ্রষ্টব্য : 'প্রবন্ধ সংকলন', পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৬)।


এই প্রবন্ধ অন্যত্র নাটকীয় বিশ্লেষণে কাব্যধর্মী হয়ে উঠেছে জয়দেবের কবিতার অভিনবত্ব আবিষ্কারে “ সত্যিকার প্রেমিকের স্বর আমরা শুনতে পেলাম, যখন, আদিরসের মরচে-পড়া মুখস্ত করা বুলির মধ্যে, কৃষ্ণ হঠাৎ ব’লে উঠলেন, 'ত্বমসি সম ভূষণম্'। ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনং ত্বমসি সম ভবজলধিরত্নম্—সারা ‘গীতগোবিন্দে’ এই একবারই ভাষা হ'য়ে উঠল কবিতার দ্বারা আক্রান্ত–আক্রান্ত, উন্নত ও রূপান্তরিত, যেন এক ঝাপটে চ’লে গেল যুক্তিনির্ভর কার্পণ্যকে ছাড়িয়ে। 'তুমি আমার ভূষণ’—এই একটি কথাই বলে দিচ্ছে যে জয়দেব এক সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে আছেন ? ভারতীয় সাহিত্যে প্রাচীনের অস্তরাগ তিনি, এবং আধুনিকের পূর্বরাগ। কবিতা যখন সংস্কৃতের বিধিবদ্ধতা থেকে একবার বেরোতে পারল, তখনই তার মধ্যে জেগে উঠল অপূর্বতা ও আবিষ্কারধর্ম; মানুষের প্রত্যাশার যা অতীত, জাগতিক সম্ভাবনার যা বহির্ভূত, সেই ‘অনির্বচনীয়কে বাঁধতে গিয়ে ভাষা সব লজ্জা ভয় ত্যাগ করলে”


বুদ্ধদেব বসুর গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য:

বুদ্ধদেবের প্রবন্ধের গদ্যভাষা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এই গদ্যভাষার স্বাতন্ত্র্য নানা দিক থেকে লক্ষ্য করা যায়


(১) স্পষ্টতা এবং দৃঢ় মন্তব্য প্রকাশ : বক্তব্য উপস্থাপনায় এটাই তার অধিকাংশ প্রবন্ধেরই এক লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। সময় বিশেষে কঠিন সমালোচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত; যেমন রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধ ভক্ত হয়েও তীক্ষ্ণ মন্তব্য “....‘চোখের বালি’ কাঁচা লেখা সন্দেহ নেই।” নজরুল সম্পর্কে তার মূল্যায়ন যেন সূক্ষ্ম অবজ্ঞার : “আগাগোড়াই তিনি প্রতিভাবান বালকের মতো লিখে গেছেন, তাঁর নিজের মধ্যে কোনো বদল ঘটেনি কখনো, তার কুড়ি বছর আর চল্লিশ বছরের লেখায় কোনোরকম প্রভেদ বোঝা যায় না” (রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক')।


(২) আত্মধর্মী উপস্থাপনা: বুদ্ধদেবের প্রবন্ধে আত্মধর্মী অনুভাবনা তাঁর ভাষাকে কোন কোন ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র মর্যাদা এনে দেয়; যেমন “......অমিয় চক্রবর্তীর সাম্প্রতিক কবিতা বাংলা সাহিত্যের একটি প্রধান ঘটনা ব’লে আমি মনে করি” (অমিয় চক্রবর্তীর ‘পালা-বদল’)। প্রাবন্ধিকের আত্মবিশ্বাসের ভাবটিও এর মাধ্যমে ধরা পড়ে।


(৩) শব্দপ্রয়োগে সতর্কতা : বুদ্ধদেব শব্দপ্রয়োগে প্রখরভাবে সজাগ ছিলেন। তাই তার যে কোন সাহিত্য আলোচনায় শব্দ-বিশ্লেষণে সতর্কতা সহজেই চোখে পড়ে; যেমন অমিয় চক্রবর্তীর ‘পালা-বদল’ কাব্যে ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দ প্রয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন “...‘সংসারতা’ বলতে যা বোঝায় তা 'সংসার'-এর মধ্যেই নিহিত আছে, মূল শব্দটাকে যথাযোগ্যভাবে খাটিয়ে নিলেই 'তা' আগমের প্রয়োজন হয় না। অন্য কোনো দিক থেকে এগুলোকে যদি বা সমর্থন করা যায়, ‘পুণ্যতা’, ‘জীবনতা’ বা ‘সংসর্গতা’র সপক্ষে কী যুক্তি দাঁড়াতে পারে আমি তো ভেবে পাই না” (পূর্বোক্ত প্রবন্ধ)।


(৪) চিত্রকল্প-উপমা-প্রতীক ব্যাখ্যায় নবত্ব : বুদ্ধদেবের প্রবন্ধের ভাষায় কবিত্ব এবং চিত্রকলা এবং উপমাদি ব্যাখ্যায় সমালোচনার মণি-কাঞ্চন সংযোগ ঘটেছে। এই ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে তাঁর ভাবুক মন, চিত্রশিল্পীর চোখ এবং প্রাবন্ধিকের পাণ্ডিত্যের প্রকাশ পেয়েছে ; যেমন—‘চিত্রকল্প’ ও ‘প্রতীকে’র ব্যাখ্যা যা-ই হোক না, কার্যত তাদের একদিকে থাকে চিত্ররচনা, আর অন্য দিকে এক গভীর রহস্য, যাতে জাল ফেলে আমরা তুলে আনতে পারি—হয়তো শূন্যতা, হয়তো এক মুঠো শামুক, হয়তো কখনো মুক্তো বা আশ্চর্য উদ্ভিদ, আর কখনো যার স্তরে স্তরে ডুবে গিয়ে বহু রত্ন উদ্ধার ক'রে আনি (‘সংস্কৃত কবিতা ও আধুনিক যুগ')। রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ আলোচনায় এর সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে।


(৫) নাটকীয়তা ও কবিত্ব বোধ : বুদ্ধদেবের ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধগুলিতে বিশেষত রম্যরচনার মধ্যে অনেক সময় নাটকীয়তা ও কবিত্বের দুর্লভ সমাবেশ ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে ‘ক্লাইভ স্ট্রিটে চঁাদ’, ‘নোয়াখালি’, ‘কোণারকের পথে’, ‘রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবন' ইত্যাদি রম্যরচনাধর্মী প্রবন্ধগুলির নামোল্লেখ করা যায়। এই ধরনের রচনাগুলির মধ্যে কথাশিল্পী বুদ্ধদেবের চরিত্রচারণায় অনুভূতির নানা রূপ প্রকাশ পেয়েছে; যেমন বর্ণনায় কবিত্ব ও নাটকীয়তার অপূর্ব প্রকাশ : “...আর হঠাৎ, রাস্তার পশ্চিম দিকের আকাশে মাথা উঁচানো বিরাট দুই বাড়ির মাঝখানে, আমার চোখের উপর ঝলসে উঠল চঁাদ, রুপোলি চাঁদের বাঁকা টুকরো সন্ধ্যার স্তব্ধ-নীল আকাশে, যেন কোনো দূর, শান্ত হাসির মতো, যেন এক অনির্বচনীয় শান্তির দৃশ্যমান ইঙ্গিত” (“ক্লাইভ স্ট্রিটে চঁাদ’)।


(৬) বানানে চিত্রকল্পের আভাস : বুদ্ধদেব বসু অনেক সময় সচেতনভাবে বাংলা কিছু প্রচলিত বানান ভিন্নরূপে লিখেছেন, যার মধ্য দিয়ে কোন চিত্র বা ভাব (image) প্রাধান্য পেয়েছে ব’লে মনে হয়; যেমন ‘সাদা' কথাটিকে ‘শাদা’ বানানের ব্যাখ্যায় (জীবনানন্দের কবিতায় ব্যবহৃত) আগাগেড়া ‘শুভ্রতা’র নতুন তাৎপর্য খোঁজা। আবার রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট কোন কোন চরিত্র আলোচনায় (যেমন ‘শেষের কবিতা’) তিনি ‘রূপবান’ কথাটি ‘গুণ’ অর্থে প্রয়োগ করেছেন। কখনও বা ছড়াকার অন্নদাশঙ্করের কৃতিত্ব পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন— “অন্নদাশঙ্কর দু-দিকই ঠিক সামলে চলেন, তার ছড়ায় একরতি রূপের মধ্যে একটি ফেঁাটা বস্তুও তিনি বসিয়ে দেন, সঙ্গে দেন কৌতুকের সেই আমেজটুকু, যার স্বাদ জিভে লেগে থাকে” (“বাংলা শিশুসাহিত্য')। চিত্রকল্পের নানারূপ দৃশ্যময়তা, স্বাদুতা ('olfactory'), মিতায়তন উপস্থাপনা ইত্যাদি একাধিক বৈশিষ্ট্য এখানে প্রকাশিত।


রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু যেন এক বিচিত্রশীল ব্যক্তি। ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদীরীতির লেখক তিনি নন। আবার বুদ্ধিনিষ্ঠ পাঠক হয়ত মোহিতলাল মজুমদার এবং ম্যাথু আর্নল্ডের সঙ্গে তার কিছু সাদৃশ্যও খুঁজে পেতে পারেন। উপস্থাপনার কাব্যিক সৌরভে বাংলা গদ্যের বায়ুমণ্ডলকে তিনি আজও যেন ভরিয়ে রেখেছেন।