বীরসা মুণ্ডার চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো | বীরসা মুণ্ডার চরিত্র কতটা সংগতিপূর্ণ হয়েছে আলোচনা করো।

সুগানা মুণ্ডার ছেলে বীরসা মুণ্ডা। মায়ের নাম করমি। বীরসার পূর্বপুরুষ দুই ভাই, টুটু আর নাগু। সম্ভবত এদের নামানুসারে ছোটোনাগপুর নামকরণ হয়েছিল, কিন্তু সেখানে তাদের উত্তর পুরুষদের ঠাঁই মিলল না। ফলে তাদের যে খুঁটকটি গ্রাম উলিহাতু সেখান থেকে সুগানার বাস উঠিয়ে চলে আসতে হয় বোম্বায়। এখানে জন্মগ্রহণ করে সুগলার বড়ো ছেলে কোম্‌তা। দুটো মেয়ে দাসকির ও চম্পা। এর পরেই বিষ্যুৎবারে, জন্ম হল বীরসার। বৃহস্পতিবার জন্মেছে বলেই তার নামকরণ হয়েছে বীরসা। তার জন্ম হয় ১৮৭৫ খ্রি.। জীবন ও জীবিকার তাড়নায় সুগানা বোম্বা থেকে বাস উঠিয়ে চলে এল চালকাড়ে। আসার আগে সুগানা, কোমতা, পাশ্শ্না, বীরসা সবাই কিরিশ্চান হয়ে এলো জার্মানির মিশন থেকে। সুগানা হল সুগানা মাশিদাস। আর বীরসা হল বীরসা দাউদ মুণ্ডা। বীরসা জানত যদি দিকুদের ভাষা জানা যায় তবে সে দিকুদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করতে পারবে। কারণ দিকুরা তাদের বকেয়া জমি সব নিয়ে নিয়েছে। তাই সে লেখাপড়া শিখার জন্য সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে প্রস্তুত হল। দেখতে দেখতে বীরসা আট বছরে পদার্পণ করল। কাজেই সে বসে না থেকে—“ছাগল চরিয়ে, বন থেকে কাঠ পাতা ফল কন্দমধু এনে সংসারে সুসার করত।” বীরসার তো অজানা ছিল না তারা বড়ো দরিদ্র। এইভাবেই জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। খাটো খাবার সেই নুনটুকুও তাদের সম্বল ছিল না। দাদা যখন বলত সে বড়ো হলে—হাট থেকে একবস্তা নুন কিনে এনে বাড়িতে মজুদ করে রাখবে, তখন বীরসা তার এই অবাস্তব কথা শুনে হাসত। বাঁশি নিয়ে বেরিয়ে যেত। “লাউয়ের খোলে তৈরি টুইলা আর বাঁশি দুটোই ওর বাধ্য ছিল।”


জঙ্গলে এলে বীরসা বাড়ির সমস্ত অভাব দারিদ্র্যের কথা এক মুহূর্তে ভূলে যেত। আপন সুরে বাঁশি বাজাত। টুং টাং সুরে টুইলা বাজাতে প্রমত্ত হত। তার বাঁশি শুনে সুগানা বেশ অবাক হত। আবার “হাতে টুইলা আর কোমরে রসিতে গোঁজা বাঁশি নিয়ে বীরসা যখন মুণ্ডারী ছেলেমেয়েদের বারোয়ারি নাচের মণ্ডপে আখরায় যায়, তখন কেন সুগানার বয়সি ওর মা বাপের বয়সি চালকাড়ের সকল মুণ্ডা গিয়ে দুদণ্ড দাঁড়ায় ? বীরসার বাঁশি শোনে কেন ?” বীরসা মুণ্ডা ছেলে হয়েও আপন গুণে অন্য জাতের ছেলেদের মতো বেড়ায়।—“সকলের মতো দেখতে নয় ও। মুখ চোখ অন্যরকম সব।" বীরসার বাঁশি শুনে সুগানার খ্রিস্টান দন্দা কানু পলুস মুগ্ধ হয়। অবাক হয়ে বলে—“তোর ছেলে খুব শাহানদাররে সুগানা। ওর বাঁশি শুনে গেলাম, এমন জিনিস শুনি নাই।” করমিকে মুণ্ডারী মায়েরা এমন ছেলেকে গর্ভে ধারণ করার জন্য ধন্যবাদ না দিয়ে পারে না। বিশাল অরণ্যের মাঝে কোথায় কুণ্ডীতে মাছ, কোথায় সুমিষ্ট কুল আর অল্পকষার আমলকি, বনকচু আর মাংসল খরা, সজারু সব বীরসার নখদর্পণে বীরসা ক্রমে বড়ো হচ্ছে দেখে সুগানা দারিদ্র্যের সংসারে একটু সুরাহা পেতে ঠিক করল—“বীরসাকে কোথাও গাইচারীব কাজে লাগিয়ে দেবে।” ফলে করমির জ্যাঠার ছেলে নিবাই মুণ্ডার সঙ্গে কোমতা আর বীরসা মামাবাড়িতে আয়ুভাতুতে চলে আসে। সেখানে বীরসা তার জোনি মাসির নির্দেশে—“বীরসা জয়পাল নাগের পাঠশালায় গেল।" বীরসার মনে স্বপ্ন সে বড়ো হবে, অনেক বড়ো। একদিন স্কুল থেকে ফিরে বীরসা মাসির কাছে সদর্পে ঘোষণা করল সে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ সমস্ত শিখে নিয়েছে। সেদিন মাসি তাকে পেটপুরে যত্নসহকারে জাইভাজা, তিতিরের মাংস আর বনধুধুলের তরকারি দিয়ে খাইয়েছিল। এসকল খেতে খেতে বীরসার মনে হয়—“এ পৃথিবীতে এত খাদ্য আছে, তবে তার মা করমি কেন ঘাটোর সঙ্গে নুন পায়না।" একদিন জোনি মাসির বিয়ে হয়ে যায়। বীরসা ও মাসির সঙ্গে মেসোর গ্রাম মাটাংগাতে চলে আসে, মেসো বদমেজাজী। কিন্তু বীরসা সাবধানে চলে, কারণ “রোজভর পেট খেতে পাওয়া, গায়ে মাথায় তেল মাখতে পাওয়া, কাপড় গামছা আস্ত পরতে পাওয়া এর একটা অন্য সুখ আছে।” তাই সে মাসির বাড়ি নানাধরনের কাজ করে। কিন্তু একদিন অসাবধানতাবশত মেসোর চিরশত্রু ঘাসী মুণ্ডার বাগানে গাই ছাগল ঢুকে গাছ নষ্ট করায় ঘাসী রেগে কোঠি ছুঁড়ে মারায় একটা পাঠার পা গেল ভেঙে। বদমেজাজি মেসো বেধরক মারল বীরসাকে। কিন্তু বীরসা মুখ বুজে মার খেল। তারপর বিকেলের সমস্ত কাজ সে করল। তারপর ভোর হবার আগে উঠে পড়ল। চুপিসারে বাড়ি থেকে পালিয়ে এল।


পরদিন বিকাল নাগাদ বীরসা এসে পৌঁছাল কুন্তী বরতোলীতে। বীরসার দাদা সেখানে গাইচারীর কাজ করছে। দাদার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর বীরসা বুরজুতে জার্মান মিশনে ভর্তি হবার সিদ্ধান্ত নিল। বুরজুতে কয়েক বছর লোয়ার প্রাইমারি শিক্ষা সমাপ্ত করে ফাদার রেভারেণ্ডের নির্দেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বীরসা চাইবাসা মিশনে গেল। চাইবাসা মিশনে ভর্তি হয়ে সহপাঠী অমূল্যকে সে তার ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতিকে এমনভাবে ব্যক্ত করেছে—“লেখাপড়া শিখবে, অনেক লেখাপড়া তাবাদে কাছারি করে বাবার খুঁটিকাটি গ্রামের জমি ফিরাবে।” মাকে বোরা ভরা নুন কিনে দেবে। মোটের উপর বড়ো স্বপ্ন বুকে নিয়ে বীরসা তার ছাত্রজীবন শুরু করেছিল। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হল না। সর্দারদের সঙ্গে মিশনের দ্বন্দ্ব হলে ফাদার নট্রট সর্দারদের জোচ্চোর বলে প্রতিপন্ন করলে বীরসা গর্জে ওঠে। প্রতিবাদ হেনে সর্দারকে জিজ্ঞাসা করে কী জোচ্চোরি করেছে সর্দাররা ?” ফলে মিশনের সঙ্গে একরকম সম্পর্ক ছিন্ন করে শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে চলে এসেছিল। আসার আগে বন্ধু অমূল্যকে বলেছিল—“যদি দেখি দিকু হোস নাই, তবে কথা বলব। নয়তো বলব না।” মিশন ছাড়ার পর বীরসা মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিল। মানসিক সুস্থিরতা পেতে সে কদগাঁও এর বৈঘ্নব সেবাইত আনন্দ পাড়ের কাছে ছুটে যায়। সেখানে সে—“পইতে নিল, চন্দন মাখল, তুলসী পূজা করল। রামায়ণ মহাভারত সব শুনল, পড়ল কিছু কিছু।” এই সময়ে ভরমিরা এসে জানায় জঙ্গলে কেউ গাইছাগল চরাতে পারবে না। জঙ্গলে কাঠ মধু সংগ্রহ করতে পারবে না। ভরসির একথায় বীরসা 'না!' বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। আসলে “ওর সঙ্গে চুটুয়া আর নাগু চেঁচিয়ে উঠেছিল, অরণ্যের অধিকার কৃষ্ণ ভারতের আদি অধিকার, যখন সাদা মানুষের দেশ সমুদ্রের অতলে ঘুমুচ্ছিল তখন থেকে কৃষ ভারতের কালো মানুষেরা জঙ্গলকে মা বলে জানে।” তবে বীরসার রক্ত তাকে দিয়ে ‘না’ কথাটা বলিয়েছিল। বস্তুত এখান থেকেই বীরসা তার ভবিষ্যৎ কর্মজীবন পন্থা নির্ধারণ করে ফেলে।


মিশন ছাড়ার পর দরিদ্র বাবা মায়ের সংসারে বীরসা খুব অন্ন কষ্টে পড়েছিল। দুবেলা ভালোভাবে সে খাটো খেতে পায় না। ক্ষুধার জ্বালায় একদিন সে শ্মশান থেকে মৃতা চালকির গা থেকে গহনা খুলে ছুটেছিল বাজারে চাল কিনতে। মা করমি তাকে একাজ করার জন্য ভর্ৎসনা করে। বীরসা এবার আশ্রয় নিয়েছিল অরণ্য জননীর কোলে। অরণ্য তো সকলের মা। ও বুঝতে পারছিল অরণ্য জননী কাঁদছে। অরণ্য জননী ধর্ষিতা, দিকুদের আইনের হাতে বন্দিনী। অরণ্য জননী যেন বীরসাকে বলছে—“আমি শুচি, শুদ্ধ নিষ্কলঙ্ক হব।" মায়ের অসহায় অবস্থা দেখে বীরসা গর্জে উঠেছিল—“দিব সকলের সুখ, হ্যাঁ আমি ভগবান হব, বীরসা ভগবান। ধরতি আবা হয়া যাব তবে।” বাড়িতে ফিরে মা করমিকে বলেছিল—“বীরসা বলিস না মা। আমি ভগবান, আমিই ভগবান। আমি মুণ্ডাদের ছেলে ভুলাব না, কোলে দুলাব না। আমি সকলের জন্য এই জঙ্গল মাটি জিনে এনে দিব।" এখান থেকেই বীরসার জীবন নতুন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। তার কাজেকর্মে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মুণ্ডারা তার কাছে জমায়েত হতে থাকে। বীরসা করজোড়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায়—“এদের জ্ঞান দাও হে, বুদ্ধি দাও হে।” মুণ্ডাদের জীবন থেকে যাবতীয় কুসংস্কার ঝেড়ে সে সকলকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলে। তার নির্দেশে বসন্ত রোগীকে আলাদা রাখা হয়। কলেরায় আক্রান্ত সবাইকে জল ফুটিয়ে খেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে গ্রামের মানুষরা অতি সহজেই উপকৃত হয়। ফলে তার নাম ডাক আরও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে বুঝেছিল এতে “ধরতির আবা হওয়া যাবে না।” তাই সে দিকুদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অরণ্যের অধিকারের দাবি নিয়ে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করল। তার এই যুদ্ধ ঘোষণায় সরকার আতঙ্কিত হয়। তার দলে মুণ্ডাদের যোগদানের ব্যাপকতা থেকে সরকার ভীত হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে। এবং ১৮৯৫ সালে ১৯ নভেম্বর বীরসাকে দু'বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।


১৮৯৭ সালে নভেম্বরে বীরসা মুক্তি পেল। সে কমিশনারকে কথা দিয়েছিল মুণ্ডাদের আর খ্যাপাবে না। কিন্তু স্বভূমিতে এসে দেখে বৃষ্টির অভাবে চারিদিকে ফুটিফাটা অবস্থা। মুণ্ডাদের দারিদ্র্য দেখে সে বুঝল কথা ও রাখতে পারবে না। নব কৌশলে মুণ্ডাদের পরিচালনা করতে হবে। এবার তার “পরনে ধবধবে কাপড়, মাথায় পাগড়ি, গায়ে পিরান, পায়ে খড়ম।” এখন সত্যিকারের দুশমনকে সে চিনতে পেরেছে—“যারা আমাদের খেতে খামারে জুড়ে বসেছে তারাই দুশমন।" ইংরাজদের নজর এড়াবার জন্য গোপনে গ্রামে সভা করে। এখানে বীরসা ঘোষণা করে—“মোরা মোদের পুরানো দখল পেতে চাই। পুরানো দেবস্থান চাই।” বীরসা আরও ঘোষণা করে—“আমার এ লড়াই-এর নাম উলগুলান।” উলগুলান শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘গণবিদ্রোহ'। বীরসা তার মুণ্ডাদের নিয়ে যে বিদ্রোহ করেছিল তা যে গণবিদ্রোহের আকার নিয়েছিল সে কথা বলাই বাহুল্য।


বীরসার নেতৃত্বে সমগ্র ছোটোনাগপুর অঞ্চল জুড়ে বীরসাইতরা শুরু করল তাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। একের পর এক হামলা শুরু করল খ্রিস্টান গির্জা, থানা, জমিদারদের উপর। ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন কনস্টেবলকে মেরে ফেলে। পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেয় জমিদারের অঙ্গন। সময়টা ছিল ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ। বীরসাইতদের বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজ বহু সৈন্য নিয়ে ঝঁপিয়ে পড়েছিল। বহু মুণ্ডাকে গ্রেপ্তার করে সেই বিদ্রোহকে ইংরেজরা প্রতিহত করেছিল। কিন্তু বীরসা ধরা দেয় নি, অবশেষে লেনত্রাব জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকাকালীন সঙ্গীনি পরমীর সামান্য ভুলের জন্য বীরসা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে। ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০০ খ্রিঃ। বীরসাকে ধৃত অবস্থায় প্রথমে সুনটি, তারপর কদগাঁও, তারপর রাঁচি জেলে আনা হয়। সেখানে ইংরেজদের অকথ্য অত্যাচারে বীরসা রক্তবমি করে মারা যায়। পুলিশ রিপোর্টে বলা হয় বীরসার মৃত্যু হয় কলেরায়। আদিবাসী আন্দোলনের শেষ ও উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বীরসা মুণ্ডার এভাবে জীবনাবসান হয়। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তার এ গণবিদ্রোহ ‘বীরসার বিদ্রোহ' রূপে আখ্যা পেয়ে আজও জাতির মণিকোঠায় ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করে বিরাজ করছে।