‘টিনের তলোয়ার' নাটকের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।

'টিনের তলোয়ার’ কোনো সংকেতিক রূপক বা প্রতীক নাটক হয়। একটি নাট্যদলের গ্রেট বেঙ্গল অপেরার মরণ বাঁচনের কাহিনি নিয়ে রচিত এই নাটক। মূলত ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসের পটভূমিতে বাংলা থিয়েটারের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী থিয়েটারের চেতনার উপযুক্ত প্রতিফলন—টিনের তলোয়ার। নাটকটির মধ্যে 'টিনের তলোয়ার'-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন ও তার বাস্তব ব্যবহার ঘটেছে বেশ কয়েকবার। দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার বিজ্ঞাপন পোস্টারে জানানো হল তাদের আগামী আকর্ষণ—শেকসপীয়রের হ্যামলেট-ম্যাকবেথের সংমিশ্রণে রচিত 'ময়ূরবাহন'। কাশ্মীরের যুবরাজ ময়ূরবাহনের জীবনের করুণ ট্র্যাজেডি এই নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয়। তার কোমরে ঝোলে টিনের তলোয়ার।


কিন্তু ময়ূরবাহন বা যুবরাজের প্রতি নিম্নশ্রেণির মথুরের রয়েছে বিজাতীয় ঘৃণা। কাপ্তেনবাবুকে তাচ্ছিল্য করে মথুর বলে—“এত নেকাপড়া করে টিনের তলোয়ার বেঁধে ছেলেমানুষি করো কেন?” টিনের তলোয়ারের প্রতি মথুরের এই তাচ্ছিল্য আসলে ইংরেজি শিক্ষিত বাবু শ্রেণির প্রতি, নিম্নশ্রেণির মানুষের তাচ্ছিল্য। বেণীমাধবের কাছে নাটকে ব্যবহার করার জন্য টিনের তলোয়ার বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু মথুরের কাছে তা অবহেলার বস্তু। কারণ যতক্ষণ অবধি সাধারণ নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবনযুদ্ধ নিয়ে নাটক রচিত এবং অভিনীত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত টিনের তলোয়ার কোনোভাবেই নাটকে সামাজিক রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে শাণিত কৃপাণ হয়ে উঠবে না, পলকা খেলনা হিসাবেই তা গণ্য হবে। মেথর মথুরের এই কথা বাংলার গ্যারিক বেণীমাধবের হৃদয়ে খরশান তরবারির মতো বেঁধে। বেণীমাধবের মনে নাটককে সামাজিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের বীজ এখানেই প্রোথিত হল।


দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার মহলা কক্ষে বাহারি সজ্জা হিসেবে কিছু টিনের তলোয়ার ঝোলে। এই মহলা কক্ষে প্রতিবেশী বাচস্পতি পণ্ডিত এবং তার অনুচরেরা তাদের অঞ্চল থেকে গ্রেট বেঙ্গলের মহলা কক্ষ তুলে দেবার দাবিতে হামলা করে। হামলার প্রতিরোধে দলের সবার হাতে এমনকি আগন্তুক নবীন নাট্যকার প্রিয়জনের হাতেও তুলে দেওয়া হয় টিনের তলোয়ার। বাচস্পতি টিনের তলোয়ারকে ভয় না পাবার নির্দেশ দেয়। টিনের তলোয়ারকে সামনে রেখে উভয়ের শুরু হয় খণ্ডযুদ্ধ, প্রিয়নাথ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে আওড়াতে থাকে ইংরেজি বাক্যবাণ। প্রিয়নাথের ইংরেজি ধমক খেয়েই বাচস্পতি সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে প্রস্থান করে। লক্ষণীয় নিম্নশ্রেণির মানুষ মথুর বা রক্ষণশীল বাচস্পতি ও তার হুকুমমানা গুণ্ডা ভীমের কাছে টিনের তলোয়ারের কোনো গুরুত্ব নেই।


মতপার্থক্য হেতু প্রিয়নাথ থিয়েটার ছেড়ে আস্তাবলে কাজ নেয়। নাটক লেখা কিন্তু সে ছাড়ে না। সে প্রতিজ্ঞা করে কলকাতার রাজপথে কৃষকের রক্ত ঝরাতে দেবে না। কোনো সিপাহি যদি বিদ্রোহী হয়, তবে তাতেই তার গৌরব। প্রিয়নাথের এই দেশপ্রেমে টিনের তলোয়ারের ঝকমকি দেখার আশা জাগে। নাটকের অন্তিম দৃশ্যে দেখা যায়, দর্শকাসনে ল্যাম্বার্টকে। তাকে দেখে সধবার একাদশীর নিমচঁাদ বেশি বেণীমাধব হঠাৎ তিতুমীরে রূপান্তরিত হয়ে চিৎকার করে ওঠেন— ‘হার্মাদ দুস্য’। আকস্মিক এই আচরণের কোনো ব্যক্তিগত ভিত্তি নেই, একথা মানতে মন চায় না। নট নির্দেশক বেণীমাধব-এর হৃদয় সংবেদনশীল, হয়তো প্রকাশ তেমন নেই। কিন্তু অভিনয় চলাকালীন বেণীমাধব তিতুমীরের যে সংলাপ আওড়েছে তাতে তার মনের গভীরতার সাক্ষ্য মেলে।


বেণীমাধব ব্রিটিশ বিরোধী নাটকের অভিনয় করতে না চাইলেও তিনি যে মনে-প্রাণে দেশপ্রেমিক ছিলেন দর্শকাসনে বসে থাকা ডেপুটি কমিশনার ল্যাম্বার্টকে দেখে তিতুমীরের সংলাপ বলার মধ্যে তার প্রমাণ মেলে। প্রথমে একটু বিচলিত হলেও বসুন্ধরার নেতৃত্বে সহ অভিনেতা অভিনেত্রীর দলও তিতুমীরের অভিনয় শুরু করে। জলদ ইংরেজ সেনাপতি মাগুয়ার সাজে। তাকে লক্ষ্য করে তিতুমীর বেণীমাধব প্রিয়নাথের কলমের ভাষায় বলে ওঠে—“সাহেব তোমরা আমাদের দেশে এলে কেনে ?... হাজার হাজার কোশ দূরে এদেশে এসে কেনে ওই বুট জোড়ায় মাড়গে দিলে মোদের স্বাধীনতা?” নাট্যসাজে সজ্জিতা বসুন্ধরা উত্তরে বলে ওঠে— “এরা হার্মাদ জলদস্যু। এয়েছে লুঠ করতে। দর্শকাসনে বসে থাকা ল্যাম্বার্ট অপমানে গর্জে উঠলে বেণীমাধব সমস্বরে বলে ওঠে—“যতক্ষণ এক ফিরিঙ্গি শয়তান দেশের পবিত্র বুকে পা রেইখে দাঁড়াগে থাকবে, ততক্ষণ এই ওয়াহাবি তিতুমীরের তলোয়ার কোষবদ্ধ হবে না।”


মঞ্চে এই অভিনয়ের পর টিনের তলোয়ার আর নকল পলকা যুদ্ধাস্ত্র থাকে না। পরিণত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীকে, কোষমুক্ত তরবারি রূপে। মাগুয়ারকে ভূপাতিত করে তিতুমীর -বেশি বেণীমাধব তলোয়ারের আঘাত করতে করতে বলে—“এই নাও ইংরাজ দুশমন। এই নাও নারীধর্ষক ইংরাজ হার্মাদ। আজ বছরের পর বছর আমার দেশরে যা দিয়েছ, এই নাও তার খানিক ফেরত নাও।” তুমুল জয়ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে যদুর নেতৃত্বে সকল নটনটী গেয়ে ওঠে মধুসূদনের বিখ্যাত সেই দেশপ্রেমমূলক গান—

“ওঠ গো ভারত ভূমি 

কত নিদ্রা যাবে তুমি...।”


অতএব সবমিলিয়ে বলতে হয়—বেণীমাধবের গ্রেট বেঙ্গল অপেরা আপসের পথ ত্যাগ করে বিপ্লবী থিয়েটারে পরিণত হয়ে ওঠে। অপেরা, পালা, থিয়েটারে ব্যবহৃত নিছক টিনের তলোয়ার যখন বিপ্লবী থিয়েটারের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়, তখন সেই টিনের তলোয়ার বিপ্লবীদের যুদ্ধাস্ত্রে রূপান্তরিত হয়। “টিনের তলোয়ার তখন বিপ্লবী থিয়েটারের যথার্থ প্রতীক হয়ে ওঠে।” এখানে নামকরণের দিক দিয়ে টিনের তলোয়ার সার্থকতা অর্জন করেছে।