বাংলা গদ্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাপর্ব : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭ খ্রীঃ- ১৯০৫ খ্রীঃ)

বাংলা গদ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর


কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের কর্ণধার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয় ১৮১৭ খ্রীস্টাব্দের ১৫ই মে তিরোধান ঘটে ১৯০৫ খ্রীঃ ১৯শে জানুয়ারী। পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। রামমোহনের প্রতিষ্ঠিত এ্যাংলো হিন্দু স্কুলে দেবেন্দ্রনাথের শিক্ষা শুরু হয়। তারপরে হিন্দু কলেজে প্রবেশ করেন। অল্প বয়সেই পিতৃবন্ধু রামমোহনের সংস্পর্শে আসেন। তিনি ব্রাহ্মধর্ম, সমাজ সংস্কার, বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য সচেষ্ট হন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৩২ খ্রীস্টাব্দে 'সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে ‘গৌড়ীয় সাধুভাষা আলোচনাৰ্থ বক্তৃতা' দেন। ১৮৩৯ খ্রীস্টাব্দে বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার' প্রচার উদ্দেশ্যে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ (প্রথমে নাম ছিল 'তত্ত্বরঞ্জিনী’) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪০-এ তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা এবং ১৮৪৩-এ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' নামে ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র প্রকাশ করেন।


এরপর ব্রাহ্মসমাজের আচার্যরূপে তিনি বেশ কিছু বক্তৃতা দেন। সেইগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ধর্মনেতা রূপেই তিনি স্মরণীয়। ধর্মপ্রবক্তার পরিচয়ে তাঁর লেখক সত্তা এমনভাবে প্রচ্ছন্ন ছিল যে, তাঁর লেখক-পরিচয় অনেক সাহিত্যপাঠকের কাছে অজানা থেকে গেছে। তাঁর মন ছিল যুক্তিনিষ্ঠ অথচ ভাবুক প্রকৃতির। তিনি তথ্যজীবী প্রাবন্ধিক নন। তাই মননশুষ্ক প্রবন্ধ না লিখে রসস্নিগ্ধ আলোচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তার সহযোগী ধর্মনেতা রাজনারায়ণ বসু 'বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ গ্রন্থে বলেছেনঃ “বাঙ্গালা ভাষায় বক্তৃতা করিবার উৎকৃষ্ট প্রণালী ব্রাহ্মসমাজের সভ্যেরা প্রথম প্রবর্তিত করেন। ব্রাহ্মসমাজের বক্তৃতার মধ্যে শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যাখ্যান অতি প্রসিদ্ধ। উহা তড়িতের ন্যায় অত্তরে প্রবেশ করিয়া আত্মাকে চমকিত করিয়া তুলে এবং মনশ্চক্ষুসমক্ষে অমৃতের সোপান প্রদর্শন করে”।


দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসমূহ

দেবেন্দ্রনাথের রচনাসমূহের অধিকাংশতই বক্তৃতা তাঁর সমস্ত রচনাই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। বিষয়—ব্রাহ্মসমাজে আচরণীয় ধর্ম, যেমন মাঘোৎসব উপলক্ষে বক্তৃতা-সঙ্কলন। এছাড়া ১৮৩৯ খ্রীস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভায় (প্রতিষ্ঠা—১৮৩৯ সাল, তখন নাম ছিল তত্ত্বরঞ্জিনী) প্রদত্ত বক্তৃতা, কঠোপনিষদের বাংলা অনুবাদ (১৮৪০ খ্রীঃ), বাংলা গদ্যে প্রথম সংস্কৃত ব্যাকরণ (১৮৪৫ খ্রীঃ), ‘ব্রাহ্মধর্মগ্রন্থ’ (১৮৫০) 'আত্মতত্ত্ববিদ্যা' (১৮৫২ খ্রীঃ), প্রাচীন বয়সের লেখা (১৮৯৪ খ্রীঃ), স্বরচিত ‘জীবনচরিত' (১৮ থেকে ৪১ বছর পর্যন্ত বয়সকালের বিবরণ–১৮৯৮ খ্রীঃ) ‘পত্রাবলী’ (১৮৫০-১৮৮৭ খ্রীঃ) ইত্যাদি। তার ‘ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান’ গ্রন্থটি মৌলিক চিন্তা ও সাহিত্যগুণে শুদ্ধ। ধর্মীয়-নিষ্ঠা, চিন্তার নিবিড়তা, গভীরতা ও উপলব্ধির প্রকাশে গ্রন্থটি পরিপূর্ণ। তার ঋগ্বেদের অনুবাদ ১৮৪৮ থেকে ১৮৭১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চব্বিশ বৎসর একাদিক্রমে প্রকাশিত হয়। এই অনুবাদের কৃতিত্বে ‘কোলব্রুক, রোজেন, বুরুনফ, রথ, ম্যাকমূলার এবং উইলসনের' সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও চিরস্মরণীয় হয়ে উঠেছে। তাঁর ‘আত্মজীবনী' ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এই আত্মকথা ভারতকথায় পরিপূর্ণ। এখানে তার প্রিয় উপনিষদের শ্লোকগুলি, হাফিজের মরমিয়া কবিতা, আমিয়েলের অস্তর খুলে দেওয়া রোজনামচা এবং নিসর্গজগতে অখিল মাতার করস্পর্শে ফুটে ওঠা সৌন্দর্যমঞ্জরী সবকিছুই দেবেন্দ্রনাথের ভাবুক ও রসিক মনটিকে প্রকাশ করেছে। এখানে ‘হিমালয় ভ্রমণে’র বর্ণনাও অপূর্ব। সেই অর্থে আত্মজীবনী ছাড়া এই গ্রন্থ ভ্রমণকাহিনী রূপেও স্মরণীয়। তার মধ্যে এক সৌন্দর্যরসিক সাহিত্যিক সত্তা যে প্রচ্ছন্ন ছিল এই গ্রন্থে তার পরিচয় পাওয়া যায়। শঙ্কর বেদান্তের অদ্বৈতবাদকে তিনি ব্যক্তি অনুভূতির রঙে রঞ্জিত করে যে ভাষ্য রচনা করেছেন, সেখানে তার রোমান্টিক আত্মগৌরবী ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে।


দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যরীতি :

দেবেন্দ্রনাথ প্রধানত গদ্যলেখক। তার রচনার মূল বিশেষত্ব, প্রাঞ্জলতা ও ছন্দহিল্লোল। অনেকের মতে, তার গদ্য বিদ্যাসাগরের ভাষার মতই উন্নত। তার রচিত আত্মজীবনী ঊনবিংশ শতকের এক শ্রেষ্ঠ রচনা, যেমন— “একদিন বেলা চারিটার সময় আমি রাজনারায়ণবাবুকে বলিলাম, “আজ তোমার দৈনন্দিন লেখা শেষ করিয়া ফেল। আজ প্রকৃতির শোভা বড়ই দীপ্তি পাইতেছে, চল, আমরা বোটের ছাদের উপর গিয়া বসি।'... এইরূপে তাহার সঙ্গে কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় দেখি, পশ্চিমের আকাশে ঘটা করিয়া একটা মেঘ উঠিতেছে।”


তাঁর রচনাপ্রণালী রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য লেখকবৃন্দ এবং রাজনারায়ণ বসু, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করেছিল। ১৮৭৮ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে লেখা ধর্মব্যাখ্যা সম্পর্কে তাঁর নিবন্ধাদি বাংলা গদ্যের গঠনকার্যে প্রভূত সাহায্য করেছিল।