গোষ্ঠী দর্শনের আশ্রয় ছাড়াই ব্যক্তিগত জীবনদর্শনের আলোকে উজ্জ্বল হয়ে আছে বিদ্যাপতির প্রার্থনা বিষয়ক পদ। প্রাসঙ্গিক পদ অবলম্বনে মন্তব্যটির যৌক্তিকতা বিচার করো৷

বিদ্যাপতির প্রার্থনার পদগুলির পটভূমিকারূপে জনৈক বিশেষজ্ঞের মত উদ্ধৃত করা হল - “প্রার্থনা পদে বিদ্যাপতি যে অভিনব কবি-ভাবনার কথা বলিতে ছিলাম, আমার নিজের বিশ্বাস, এগুলির মধ্যে কবির ব্যক্তি ও সমাজরূপের ছায়াপাত ঘটিয়াছে।” যে গভীর আন্তরিকতা এবং সুতীব্র আকৃতির সুরে পদগুলি রচিত তাতে এমনি সন্দেহ স্বাভাবিক। ‘আধজনম হাম নিন্দে গোঙায়লু, জরা শিশু কতদিন গেলা। নিধুবনে রমণী রসরঙ্গে মাতলু, তোহে ভজব কোন বেলা। এই আকুল আক্ষেপ ও আত্মগ্লানি, এই পার্থিব নৈরাশ্য, নিজ জীবনাভিজ্ঞতা ভিন্ন ধ্বনিতে হওয়া বড়ই দুরূহ। রাজসভাশ্রিত পণ্ডিত অভিজাত বিদ্যাপতির লৌকিক জীবনে এই ঐশ্বর্য বিলাসের প্রভূত আড়ম্বর— অবশ্যই অতৃপ্তি আনতে পারে! সে অতৃপ্তির সুরই 'প্রার্থনা'র পদে ধ্বনিত হয়েছে।


‘মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়'—পদটিতে কবি শুধু আত্মসমর্পণই করেননি, যদি কর্ম বিপাকে, কীটপতঙ্গ আদি রূপেও তাঁকে জন্মগ্রহণ করতে হয় তবু যেন ‘মতি রহু তুয়া পরসঙ্গ। তাই তিনি শাস্ত্রোক্ত বিধানে

'দেই তুলসী তিল এদেহ সমর্পিলু


তিল তুলসী দিয়েই আত্মদেহ শ্রীকৃষ্ণে সমর্পণ করলেন। কিসের অধিকারে কবি সেই পরমপদ কামনা করছেন ? কবির উত্তরটি যেমন সরল তেমন জটিলও বটে। ফলে ভক্তের কাছে ভগবানের হার মানতেই হবে কারণ—

“তুই জগন্নাথ   জগতে কহায়সি

জাগ বাহি নহ মুঞি ছার।।”


ভগবানকে বলা হয় জগৎপতি, আর বিদ্যাপতি যতই তুচ্ছহোন না কেন, তিনিও তো জগৎ-বহির্ভূত নন, অতএব বিদ্যাপতিও ভগবানের কৃপালাভের পাত্র।


সংসার তপ্ত বালিকা স্বরূপ। জীবন সায়হ্নে এসে বিদ্যাপতি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তপ্ত মরুভূমিতে জলবিন্দুর ন্যায় এই সংসারের স্ত্রী-পুত্র-বন্ধুরা স্বল্পস্থায়ী। এই অনিত্য সংসারে এতদিন তিনি মগ্ন ছিলেন। জীবনের সমস্ত সময়টাই ভোগমতায় অতিবাহিত হয়েছে। ভয়ে ভীত বিদ্যাপতির প্রার্থনা।

“ভনয়ে বিদ্যাপতি   শেষ শমনভয়

তুয়া বিনু গতি নাহি আর।

আদি অনাদিক    সাথ কহায়সি

ভবতারণ ভাব তোহারা।।”


এখানে বিদ্যাপতির মোক্ষ-বাঞ্ছা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনুতাপ জরজর কবি-হৃদয়ের প্রকাশে প্রার্থনার পদ এক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষতালাভ করেছে।


“তাতল সৈকত    বারি বিন্দুসম

সুত-মিত-রমণী-সমাজে।”

উক্ত পদটিতে শুধু আত্মসমর্পণই নয়, এতে রয়েছে কবির পূর্বকৃত অপরাধের স্বীকারোক্তি—এযেন খ্রীস্টানের confession। এ সংসার, সমাজ, আত্মবন্ধুজনের সেবাতেই তো সারাজীবন কেটে গেল। তপ্ত সৈকতে পতিত বারি বিন্দুর মতই তার সমস্ত রস শুষে নিয়েছে সংসার। কাজেই ভগবানকে ভজনা করবার তাঁর সময় কোথায় ? কিন্তু হতাশ হননি ? কবি, কারণ তিনি জানেন, প্রভু জগতারণ, তাঁর তুলনা নেই—

“কত চুতরানন   মরি মরি যাওত

নতুয়া আদি অবসানা।

তোহে জনমি পুন    তোহে সমাওত

সাগর লহরী সমানা।”


অতএব প্রভু কবিকে ত্রাণ করবেনই এসত্য তাঁর অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। তাই তো কবির গভীর আন্তরিক বেদনা—

“ভনয়ে বিদ্যাপতি   অতিশয় কাতর

তরইতে ইহ ভবসিন্ধু

তুয়া পদ পল্লব   করি অবলম্বন

তিল এক দেহ দীনবন্ধু।”

তিনি দীনবন্ধুর পদপ্রান্তে অল্প সময়ের জন্য হলেও স্থান পেতে চান।


প্রধানত রসসম্ভোগের কবিরূপে পরিচিত হলেও বিদ্যাপতি যে শাস্ত রসাশ্রিত প্রার্থনা—পদাবলী রচনা করেছিলেন সাহিত্য কীর্তিরূপে এবং সাধক ভাবুকচিত্তে অপার্থিব রসের উদ্বোধনে এদের স্থান শীর্ষে। বিদ্যাপতির রচনায় সর্বত্র ঐশ্বর্যের প্রকাশ ঘটলেও অস্তত প্রার্থনার কবিতাগুলিতে যে আত্মনিবেদন ও ঈশ্বর ভক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তাতে কবির অরূপসন্ধানী বিনীত চিত্তের পরিচয় ফুটেছে।