মনসামঙ্গলের কবি : বিজয়গুপ্ত | মনসামঙ্গলে বিজয়গুপ্ত

মনসামঙ্গলে বিজয়গুপ্ত


কবি হিসাবে বিজয়গুপ্ত খুবই জনপ্রিয়, অন্ততঃ পূর্ববঙ্গে। আর সেই কারণেই লিপিকর-গায়েনের স্বেচ্ছাচার সংযোজনায় তার পুথির কালনির্ণয় এক দুরূহ সমস্যার বিষয়। তাঁর গ্রন্থের নাম ‘পদ্মাপুরাণ’। গ্রন্থ সম্পাদক, বরিশালের প্যারীমোহন দাশগুপ্ত। তাঁর সাহায্যকারী ছিলেন রামচরণ শিরোরত্ন ও প্রকাশক অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়। ছাপাগ্রন্থ ও পুঁথির পাঠে পার্থক্য সহজেই স্পষ্টরেখ। ড. সুকুমার সেন এই কারণে কাব্যের বহু অংশে আধুনিক শব্দপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গ্রন্থটির প্রামাণিকতায় সংশয় জানিয়েছেন।


বিজয়গুপ্তের কাব্যে তারিখ উল্লেখিত পয়ার পাওয়া যায় চার, কিন্তু এক ‘হুসেন শাহের’ নাম-সাদৃশ্য ভিন্ন তাদের মধ্যে আর কোনো ঐক্য নেই, যেমন

  • (ক) ঋতুশশী বেদশশী শক পরিমিত (অর্থাৎ ১৪১৬ শক – ১৪৯৪ খ্রীস্টাব্দ)।
  • (খ) “ছায়াশূন্য বেদশশী পরিমিত শক, সনাতন হোসেন শাহ নৃপতি তিলক ৷৷” (অর্থাৎ ১৪০০ শক–১৪৭৮ খ্রীঃ)। 
  • (গ) সাতুশূন্য বেদশশী পরিমিত শক। সুলতান হোসেন শাহ নৃপতি তিলক ॥” (অর্থাৎ ১৪০৬ শক–১৪৮৪ খ্রীস্টাব্দ)। 
  • (ঘ) “ঋতু সিখে বেদশশী পরিমিত সক।” (শশীকান্ত সেনের উদ্ধৃত)।

হুসেন শাহের রাজত্বকালের সঙ্গে মিলিয়ে (১৪৯৩ খ্রীস্টাব্দ) প্রথম পর্যায়ের সনটি (অর্থাৎ ১৪৯৪ খ্রীস্টাব্দ) কাব্যের রচনার কাল বলে অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়।


কবি পূর্ববঙ্গের মানুষ, গ্রামের নাম মানসী, পরে হয় ফুল্লশ্রী। “সনাতন তনয় রুক্মিণী গৰ্ভজাত” এই উক্তিটুকু বাদে নিজের সম্বন্ধে কবি বিশেষভাবেই নীরব। শুধু রচনায় নয়, আচরণেও তাঁর মনসাভক্তির পরিচয় পাওয়া যায় গ্রামে মন্দির প্রতিষ্ঠার সংবাদে। কাব্যে হরি ও চণ্ডীর উল্লেখ দেখা যায়। কাব্যের শুরুতে আছে “গরুড় বাহনে বন্দম বিষ্ণুর চরণ”, আছে অন্যত্র “হরি ভজিবার সময় যায় বহিয়া”, “হরিধ্বনি জয়জোকার বচাইর নগর” প্রভৃতি পঙ্ক্তি, যা চৈতন্যপূর্ব বাংলাদেশে বৈষ্ণবভক্তির নিদর্শনরূপে গণ্য ও গ্রাহ্য হওয়ার যোগ্য। তবে ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবের বিপন্ন অবস্থা, তাঁদের প্রতি মুসলমান শাসকের তীব্র অত্যাচারের বিবরণ তাঁর কাব্যে পাওয়া যায়

“ব্রাহ্মণ পাইলে লাগে পরম কৌতুকে। 

কার পৈতা ছিঁড়ি ফেলে থুতু দেয় মুখে ৷৷

যাহার মস্তকে দেখে তুলসীর পাত। 

হাতে গলায় বাঁধি লয় কাজীর সাক্ষাৎ ॥”


পূর্বজ কবির প্রতি খর অভিযোগের মাধ্যমে যে দায়বৃত্তকে মেনে নিয়ে বিজয়গুপ্তের কাব্যরচনা, তা কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে অক্ষম। দেবদেবী এবং মানবচরিত্রের মধ্যে লক্ষণীয় শুধু রতিচেতনার ছদ্মবেশ। ঈর্ষা ও ক্রুরতায় মনসা চরিত্র, কলহনিপুণা চণ্ডী ও গঙ্গা এবং চরিত্রহীন মহাদেব চরিত্র একাব্যে উপস্থিত। ভারতচন্দ্রের হাতে মহাদেবের অবমাননার পূর্বাভাস এখানে লক্ষণীয়। এক অর্থে সেকালীন পুরুষ-জীবনের নৈতিক অধঃপতনের সামগ্রিক পরিচয় (মহাদেব-জরৎকারু চাঁদ সদাগর) অজান্তেই যেন একাব্যে উদ্ঘাটিত। চাঁদের বহুখ্যাত উক্তিতে তারই প্রকাশ

“এক পণ কড়ি দিয়া ক্ষৌর শুদ্ধি হব।

আর এক পণ কড়ি দিয়া চিরা কলা খাব ।

আর এক পণ কড়ি নিয়া নটি বাড়ী যাব।

আর এক পণ কড়ি নিয়া সনকারে দিব ।”


সুতরাং পত্নী প্রেম এবং পরনারী-সংসর্গ সেযুগে ছিল একই চিত্তের দুই প্রকাশ। অথচ নিরুদ্দেশ যাত্রা শেষে বাড়িতে লখিন্দরের মতো “সুরূপ পুরুষ দেখি পুরীর ভিতর” চাদের সনকার চরিত্রে সন্দেহ করতে বাধেনি। চাঁদ চরিত্রের সনাতন পৌরুষ বিজয়গুপ্ত ফোটাতে পারেননি, পারেননি হাস্যরসের মাত্রাবোধ-নির্ণয়ে। তবু সনকার প্রতি সান্ত্বনাদানে চঁাদের কণ্ঠে কাব্যে একটি বিষাদবলয় গড়ে ওঠে কিছুক্ষণের জন্য

“শীতল চন্দন যেন আভের ছায়া।

কার জন্য কান্দ প্রিয়া সকল মিছা মায়া ।।

মিছামিছি বলি কেন ডোকর আমার।

যে দেছিল লখীন্দর সে নিল আরবার ।”

কাহিনী-চয়ন, চরিত্র-নির্মাণ, কাব্যশিল্পে পূর্ববঙ্গে এই কবি নারায়ণদেবের মতো মনসা মঙ্গলের অদ্বিতীয় কবি না হলেও নিঃসন্দেহে তাঁর স্থান অতৃতীয়।


বিজয়গুপ্তের কাব্যে আঙ্গিক-চৈতন্যের প্রগাঢ় পরিচয় প্রতিফলিত। তিনিই হয়ত প্রথম কবি যিনি শ্রোতার মনে বৈচিত্র্যের প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ছন্দের পুনরাবর্তনে কাব্য যাতে মন্থর না হয়ে পড়ে সেইজন্য তার গায়েনকে উপদেশ

“বিজয়গুপ্ত বলে গায়েন হও সাবহিত। 

পয়ার এড়িয়া বল লাচাড়ীর গীত ॥”


তাঁর কাব্যের প্রধান গুণ এই প্রত্যক্ষতা, যা কখনো কখনো অশোভন হাস্যরসে পর্যবসিত হয়েছে।