‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে স্বপ্ন ও বাস্তবের যে সহাবস্থান ঘটেছে তা উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা করো।

'টিনের তলোয়ার' নাটকের শুরুতে দেখা যায় বেণীমাধব গ্রেট বেঙ্গল অপেরার নতুন পালা ‘ময়ূরবাহন' নাটকের পোস্টার সাঁটতে বেরিয়ে একজন মেথরের মুখোমুখি হয়েছেন। মেথর মথুরকে বাংলা নাটক, মাইকেল মসুধূদন দত্ত, গ্যারিক, গ্রেট ন্যাশানাল, অর্ধেন্দু মুস্তাফি প্রভৃতি বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করেও বেণীমাধবকে শুনতে হয়, 'টিনের তলোয়ার’ বেঁধে ছেলেমানুষী করো কেন?’ বেণীমাধবের মেঘনাদবধ কাব্যের আবৃত্তি শুনে মেথর মথুর বলে ওঠে—‘জঘন্য'। অর্থাৎ নাটকের সূচনা হয় বেণীমাধবের স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা দিয়ে।


এরপর নাটক ক্রমেই এগোতে থাকে। দেখা যায় দেনার দায়ে জর্জরিত হয় পড়েছেন বেণীমাধব ও তাঁর সাধের গ্রেট বেঙ্গল অপেরা। এমনকি থিয়েটারের স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁও থিয়েটারে লাভ হচ্ছে না বলে থিয়েটার বন্ধ করে দিতে চায়। বেণীমাধব নিজেকে নাট্যশিক্ষক বলে মনে করেন। নিজেকে ব্রহ্মার মতো স্রষ্টা ভাবেন। তাল তাল কাদা মাটি দিয়ে জীবন্ত প্রতিমা তৈরির স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু সেই স্বপ্ন তাঁর ভেঙে যেতে বসে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ লাভ হচ্ছে না দেখে থিয়েটার বন্ধ রাখার মনস্থ করলে তাঁকে লোভ দেখিয়ে বেণীমাধব থিয়েটার চালু রাখেন। স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে রূঢ় বাস্তবের ওপরেই নির্ভর করেন বেণীমাধব। ময়নাকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে গচ্ছিত রেখে থিয়েটারের মালিকানা অর্জনের স্বপ্ন দেখেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। ময়নার কান্নার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়সঙ্গিনী বসুন্ধরা তাই বেণীমাধবকে ময়নার সতীত্ব বিক্রিকারী দালাল বলতেও দ্বিধা করে না। সব মিলিয়ে বেণীমাধবের মনের মাঝে লালিত স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তর প্রভেদ লক্ষিত হয়।


‘টিনের তলোয়ার’-এর অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র হল বসুন্ধরা। বেণীমাধবের গ্রেট বেঙ্গল অপেরার সংসারের গৃহিণী, পার্ট বিতরণ থেকে দৈনন্দিন খাওয়া দাওয়া, কার কী ওষুধ দরকার সবকিছুরই খোঁজ নেওয়া এবং জোগান দেওয়া তার দায়িত্ব। বসুন্ধরা ও বেণীমাধবের মতো নিজেদের মালিকাধীন একটা থিয়েটারের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু পাওনাদারদের সঙ্গে লড়তে লড়তে, সংগঠিত একটি নাট্যগোষ্ঠীকে পরিচালনা করতে গিয়ে তাঁর সে স্বপ্ন বর বার ভেঙে যায়। শেষপর্যন্ত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ যখন থিয়েটারের মালিকানা বেণীমাধবের নামে লিখে দিতে চান, তখন সে খবর শুনে বসুন্ধরা আনন্দে ময়নাকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর এতদিনের স্বপ্ন বুঝি সার্থক হল। কিন্তু পরমুহূর্তেই বসুন্ধরা জানতে পারেন ময়নাকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর কাছে বাঁধা থাকতে হবে, এই শর্তসাপেক্ষে বেণীমাধব থিয়েটারের মালিক হয়েছে, বসুধরার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় সে অশ্রুসিক্ত হয় ওঠে।


ছাতুবাবুর বাজারের সবজিওয়ালী ময়না নাটকের অভিনেত্রী হবার স্বপ্ন নিয়ে পরনে শতছিন্ন শাড়ি জড়িয়ে শোভাবাজারে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার কর্ণধার বেণীমাধব অর্থাৎ কাপ্তেনবাবু তথা বাংলার গ্যারিকের কাছে এসে হাজির হয়। মদের নেশায় চুর বেণীমাধব ময়নাকে পেয়ে তাকে অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়। ময়নার স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে। ময়নাকে সভ্য শিক্ষিত ভদ্র পরিবারের কুলবালারূপে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে যখন সত্য সত্যই সুঅভিনেত্রী শংকরীতে রূপান্তরিত করা হয়, তখনই থিয়েটারের স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ ময়নাকে নিজের বাবুয়ানীর খাঁচায় বন্ধ করতে চান। শংকরীতে রূপান্তরিত হওয়া ময়না বেণীমাধব বসুন্ধরার মতো স্বাধীন থিয়েটারের স্বপ্নের বাস্তবায়নে আহ্লাদিত হয়ে উঠেই বুঝতে পারে তার নিজের স্বাধীনতা হরণ করার শর্তে পিতৃসম গুরু বেণীমাধব থিয়েটারের মালিক হতে চলেছে। ময়নার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়।


‘টিনের তলোয়ারে’র রোমান্টিক নায়ক প্রিয়নাথ। প্রিয়নাথ হিন্দু কলেজের ছাত্র, ইংরেজি বস্তুবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত তথাকথিত বাংলা রেনেসাঁসের প্রতিভূ। কিন্তু বাবার কদর্য আচরণে ব্যথিত হয় সে—অর্থাৎ শিক্ষিত মার্জিত রুচির প্রিয়নাথের প্রথম স্বপ্ন ভঙ্গ হয় তার বাবার আচরণে। পরিবার পরিজন ত্যাগ করে সে আদর্শ নাট্যকাররূপে নিজেকে চিহ্নিত করতে চলে আসে গ্রেট বেঙ্গল অপেরায়। দীর্ঘ তিন বছর ধরে তাঁর গবেষণাধর্মী লেখা ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নাটকের পাণ্ডুলিপিতে একদিন দেখতে পেল, গ্রেট বেঙ্গল অপেরার কুশীলবেরা তেল মাখানো মুড়ি খাচ্ছে। প্রিয়নাথের এখানে প্রথম স্বপ্ন ভঙ্গ হল। কিন্তু সে থেমে থাকার পাত্র নয়। লিখে ফেলল ইংরাজ বিরোধী নাটক ‘তিতুমীর'। দলের স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ বেঁকে বসলেন। এ নাটক মঞ্চস্থ করতে তিনি নিষেধ করায় পরিবর্তে গ্রহণ করা হল—দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী' নাটকখানি। এখানেও প্রিয়নাথের স্বপ্ন ভঙ্গ হল। আবার প্রিয়নাথ ভালোবেসেছিল ময়নাকে। তাকে মনপ্রাণ দিয়ে বসেছিল। কিন্তু সেই ময়না যখন তার প্রেমের মর্যাদা না দিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্মের রক্ষিতা হয়ে গেল, তখনও প্রিয়নাথের ঘটে যায় স্বপ্ন ভঙ্গ। অবশেষে প্রেমিক ও নাট্যকারের ভূমিকা ত্যাগ করে সে আস্তাবলের কাজে যোগ দেয়।


এইভাবে টিনের তলোয়ারের সমগ্র নাটক জুড়ে ঘটে চলে বিভিন্ন চরিত্রের স্বপ্নদর্শন ও স্বপ্নভঙ্গের পালা। তাই এই নাটককে স্বপ্ন ও বাস্তবের মেলবন্ধনের সেতুরূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে।