শূদ্রকের নাট্য কৃতিত্ব বিচার করো।

সংস্কৃত সাহিত্যের একটি অনন্যসাধারণ নাটক ‘মৃচ্ছকটিক’। গ্রন্থের প্রস্তাবনা অংশে নাট্যকার রূপে রাজা শূদ্রকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু শূদ্রকেই এই নাটকের প্রণেতা কিনা এবং তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় কী, তা নিয়ে পণ্ডিত সমাজে মতভেদ রয়েছে।


‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকটিকে সংস্কৃত সাহিত্যের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি বলে মনে করেন। কারণ এর বিষয়বস্তুতে রয়েছে সাধারণ মানুষের কথা যা ইতিপূর্বে সংস্কৃত সাহিত্যে সম্পূর্ণ অনাদৃত ছিল। নাট্যকার শূদ্রকের যে পরিচয় নাটকের প্রস্তাবনা অংশে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন বহুগুণান্বিত ব্রাহ্মণ নরপতি। প্রথম জীবনে তিনি অশ্বক দেশের অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তী কালে শূদ্রক উজ্জয়িনীর রাজা হন। শেষ জীবনে পুত্রকে সিংহাসন দিয়ে একশ বছর বয়সে আগুনে প্রবেশ করে আত্মবিসর্জন দেন। এই ঘটনাটিই প্রমাণ করে নাটকের প্রস্তাবনায় অংশটি নাট্যকারের নিজের রচনা নয়। কারণ তা হলে তিনি নিজের মৃত্যুর কথা লিখে যেতে পারতেন না। তাছাড়া কোনো ব্রাহ্মণ সন্তান শূদ্রক নাম গ্রহণ করবেন, একথাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর থেকে মনে হয়, প্রস্তাবনায় নাট্যকারের যে পরিচয় তা সঠিকভাবে নির্ভরযোগ্য নয়। কেউ কেউ মনে করেন, রাজা শূদ্রকের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর কোনো সভাসদ্ এই নাটকটি রচনা করে প্রভুর তুষ্টি বিধানের জন্য তাঁর নামে প্রকাশ করেছিলেন। তবে এটাও নিছক অনুমান মাত্র। সুতরাং ‘মৃচ্ছকটির’ নাটকের রচয়িতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে শূদ্রক নামক এক রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। স্কন্দপুরাণে শূদ্রককে অন্ধবংশীয় রাজা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। 'কথাসরিৎসাগর’-এ শূদ্রককে অন্ধবংশীয় রাজা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘কথাসরিৎসাগর’-এ শূদ্রককে শোভাবতীর রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 'বেতাল পঞ্চবিংশতি’-তে শূদ্ৰককে বর্ধমানের রাজা এবং 'কাদম্বরী'তে 'বিদিশা'র রাজা ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তথ্যগুলি প্রমাণ দেয় যে, প্রাচীনকালে শূদ্রক বলে একজন যথেষ্ট কীর্তিমান রাজা ছিলেন। তিনি এক বা একাধিকও হতে পারেন। কিন্তু সেই রাজার সঙ্গে নাট্যকার শূদ্রকের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ এই গ্রন্থগুলিতে রাজা শূদ্রককে কোথাও নাট্যকার বলে উল্লেখ করা হয়নি। অষ্টম শতাব্দীতে বামন সর্বপ্রথম শূদ্রকের কথা বলেছেন। সুতরাং এই বিষয়ে অনুমান করা যায় ‘মৃচ্ছকটিক’ নাট্যকটির রচনাকাল অষ্টম শতাব্দীর পূর্বে এবং সেই সূত্রে তিনিও অষ্টম শতাব্দীর পূর্বে জীবিত ছিলেন বলে ধরে নেওয়া যায়।


‘মৃচ্ছকটির নাটকের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে প্রবেশের পূর্বে আমরা এই নাটকের আর একটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব। শূদ্রকের ব্যক্তি পরিচয় যাই হোক না কেন, তিনি যে এই নাটকের মৌলিক রচয়িতা—এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না। কিন্তু ভাসের ‘নাটক চক্র' আবিষ্কারের পর দেখা গেল সেখানে চার অঙ্ক বিশিষ্ট ‘চারুদত্ত' নামে একটি নাটক রয়েছে আর সেই নাটকের সঙ্গে ‘মৃচ্ছকটিকে’ নাটকের সাদৃশ্য অত্যন্ত বিস্ময়কর। যেমন ‘চারুদত্ত'-এর অধিকাংশ শ্লোক ‘মৃচ্ছকটিক' নাটক পাওয়া যায়। এই সাদৃশ্যকে আকস্মিক যোগাযোগ বলে মেনে নেওয়া যায় না। এই নাটকে কেউ কেউ মনে করেন ভার্সের ‘চারুদত্ত' নাটকের সম্প্রসারিত রূপ হচ্ছে ‘মৃচ্ছকটিক'। আবার অপরপক্ষে এই কথাও মনে করেন যে ভাসই ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকটিকে সংক্ষিপ্তাকারে ‘চারুদত্ত’ নাম প্রকাশ করেছিলেন। যাই হোক ভাস ও শূদ্রক—কে যে কার কাছে নাটক রচনার জন্য ঋণী সে প্রশ্নের মীমাংসা করে নেওয়া সম্ভব নয়।


কাহিনি : উজ্জয়িনীর বণিক পল্লিতে বসবাস করতেন ব্রাহ্মণ চারুদত্ত। ব্যাবসা করে একসময় তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। কিন্তু দানধ্যান করে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। সংসারে আজ তার স্ত্রী ধৃত এবং বালক পুত্র রোহসেন। উজ্জয়িনীর সেরা নটী বসন্তসেনা জন্মসূত্রে গণিকা হলেও অতিশয় হৃদয়বর্তী। তিনি চারুদত্তের দানধ্যানের কথা শুনে ইতিমধ্যে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তারপর বসন্ত উৎসবের দিনে কামদেবের মন্দিরে চারুদত্তকে দেখে তিনি তার প্রতি প্রেমাসক্ত হন। মন্দির থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে চারুদত্তের বাড়ির সম্মুখে রাজার শালক দুর্বৃত্ত শকার বসন্ত সেনাকে আহ্বান করলে, বসন্ত সেনা ভীত হয়ে চারুদত্তের গৃহে আশ্রয় নেন। চারুদত্ত তাঁকে যথেষ্ট খাতির করেন এবং পরে অন্ধকার রাত্রিতে নিজে গিয়ে বসন্ত সেনাকে স্বগৃহে পৌঁছে দেন। যাওয়ার সময় বসন্তসেনা নিজের সোনার অলংকারগুলি সেই রাতের জন্য চারুদত্তের গৃহে রেখে যান। ঘটনাচক্রে সেই দিনই শর্বিলক নামক এক ব্রাহ্মণ নিজের প্রেমিকা মদনিকার মুক্তিপণ সংগ্রহের জন্য চারুদত্তের গৃহে চুরি করে। মদনিকা ছিলেন বসন্তসেনারই পরিচারিকা। সোনার অলংকারগুলি বসন্তসেনার হাতে ফিরে আসে এবং তিনি সবকিছু জানতে পেরে মদনিকাকে মুক্তি দেন।


এদিকে চারুদত্ত যখন নিতান্ত নিরুপায় তখন তাঁর স্ত্রী ধৃতা নিজের গলার রত্নহার খুলে বসন্ত সেনার কাছে পাঠিয়ে দেন। বলে পাঠান যে, চারুদত্ত পাশা খেলার সমস্ত কিছু খুইয়ে দিয়েছে বলেই অন্য একটি রত্নহার তাকে পাঠানো হয়েছে। বসন্তসেনা সবকিছুই বুঝতে পারেন এবং সেদিনই চারুদত্তের গৃহে উপস্থিত হয়ে রত্নহারটি ধৃতাকে ফিরিয়ে দিতে চান। কিন্তু সেই রত্নহারটি নিতে অস্বীকার করে ধৃত। সেই সময়ে রোহসেন তার বন্ধুর একটি সোনার গাড়ি নিয়ে খেলা করছিল। বন্ধুটি তার সোনার গাড়ি নিয়ে চলে যেতে রোহ সেনকে একটি মাটির গাড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু রোহ সেন সোনার গাড়ির জন্য কান্না শুরু করে। তখন সেখানে উপস্থিত বসন্তসেনা তাঁর শরীরের সমস্ত গহনা খুলে সেই মাটির গাড়িতে বোঝাই করে দেন। চারুদত্তের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বসন্তসেনা ভুলক্রমে শকারের গাড়িতে চড়ে বসেন। শকার প্রথম তার মনঃতুষ্টির চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর হত্যার উদ্দেশ্য গলা টিপে ধরে। বসন্তসেনা অচৈতন্য হয়ে গেল তাঁকে মৃত ভেবে মাঠের মধ্যে ফেলে দিয়ে শকার চলে যায়। এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বসন্তসেনার প্রাণ ফিরিয়ে আনেন।


এদিকে শকার রাজদরবারের উপস্থিত হয়ে বসন্তসেনাকে হত্যার অপরাধে চারুদত্তকে অভিযুক্ত করে। রাজা চারুদত্তকে মৃত্যুদণ্ড দেন। চারুদত্তকে যখন শ্মশান ভূমিতে নিয়ে আসা হয়েছে, তখন সেই বৌদ্ধ ভিক্ষু সংবাহক বসন্তসেনাকে নিয়ে সেই স্থানে উপস্থিত হন। চারুদত্ত মুক্তি লাভ করেন। রাজা আর্যক সব কথা শুনে বসন্তসেনাকে চারুদত্তের বধূরূপে স্বীকৃতি দেন।


নাট্য বিচার : সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যে নানান দিক থেকে ‘মৃচ্ছকটিক' নাটকটি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আলংকারিক পরিভাষায় এটি প্রকরণ। কারণ এর নায়ক ব্রাহ্মণ হলেও তিনি ব্যবসায়ী এবং দুই স্ত্রীর মধ্যে একজন নটী। নাটকের কাহিনি সম্পূর্ণভাবে লৌকিক। নাটকের প্রধান রস শৃঙ্গার এবং কাহিনির মধ্যে চৌর্যবৃত্তি, জুয়াখেলা, হপ্তা, মিথ্যাচারিতা প্রভৃতি বিষয়গুলি রয়েছে। 'প্রকারণ'-এর প্রয়োজনীয় সমস্ত গুণেরই সমারেশ ঘটেছে এখানে।


‘মৃচ্ছকটিকে’ নাটকের নামকরণের বিষয়টিও বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। নাটকের অন্তর্গত একটি ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র নাটকের নাম দেওয়ার রীতি পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্যে আর দেখা যায় না। তবে সাংকেতিকতার দিক থেকে এই নামকরণের একটা পৃথক মর্যাদা রয়েছে। মাটির গাড়িতে নিজের সমস্ত অলংকার তুলে দিয়ে রাজ নটী বসন্তসেনা নিজেকে চারুদত্তের সমকক্ষ করেছেন।


নাটকের বিষয়বস্তুতে নরনারীর হৃদয় দানের বিষয়টিকে প্রাধান্য লাভ করলেও তৎকালীন রাষ্ট্র বিপ্লবের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। কারণ প্রজাগণ নিজেদের রাজা কুমার চক্রবর্তী বলেছেন-“সংস্কৃত সাহিত্য বলতে সাধারণত বোঝায় অভিজাত শ্রেণির সাহিত্য। জনসাধারণের জীবনচিত্র সেখানে বিরল। ‘মৃচ্ছকটিক' গণজীবন-বিচিত্র গণ অভ্যুত্থান এই নাটকের একটি মূল ঘটনা। এখানে রাজা সাব্যস্ত হইয়াছেন ঘোচ পল্লির আর্থক, এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুকের কুলপতি নিযুক্ত হইয়াছেন একজন জুয়াড়ি, মন্ত্রী হইয়াছেন এক চৌর্যবিদ্যা বিশারদ ব্রাহ্মণ। আর কুলবধূর মর্যাদা লাভ করিয়েছেন একজন গণিকা। সমাজের অতি সাধারণ মানুষের এখানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছেন।”


পরিশেষে এই নাটকের ভাষারীতি সম্পর্কে দু-এক কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। এটি সংস্কৃত নাটক, অথচ মাত্র ছ'জন পাত্র-পাত্রী ছাড়া আর সকলেই প্রাকৃত ভাষার কথা বলেছেন। ভাষার ক্ষেত্রে লোক প্রচলিত রীতির ব্যবহার নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। সব মিলিয়ে ‘মৃচ্ছকটিক' সংস্কৃত সাহিত্যের একটি দিক্ নির্দেশক।