'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' নাটকের ফতেমার চরিত্রটি নিরূপণ করো।

‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকের প্রধান নারী চরিত্র ফতেমা। নারীর নারীত্ব সম্পর্কে মাইকেলের মনে যে ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে ছিল তার কিছুটা অংশ ফতেমার মাধ্যমে আভাসিত হয়ে উঠেছে। তাঁর নাটক ও কাব্যে তিলোত্তমা, প্রমীলা) নারীর যে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে, ফতেমাকে তাঁদের সঙ্গে তুলনা করা না গেলেও চরিত্রটি বিশেষ স্মরণযোগ্য। ভক্তপ্রসাদ নিতান্ত লঘুভাবে তার প্রতি যে বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন, তা লক্ষণীয়। নারীর দৈহিক রূপের সঙ্গে Abstract সৌন্দর্যের একটি সমীকরণ ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখকদের মনে ধরা পড়েছিল। এর সঙ্গে তাঁরা সরলতাকে যুক্ত করে নিয়েছিলেন। মাইকেলের কৃষ্ণকুমারী তার এক ফলশ্রুতি। দৈহিক রূপের সঙ্গে সরলতা ওই চরিত্রে যুক্ত হয়েছিল। সেটাই সেখানে ট্র্যাজেডির মূল কারণ হয়েছিল। কিন্তু ফতেমার ক্ষেত্রে সেই সরলতা লক্ষিত হয় না।


হানিফের অভিনয় দক্ষতার সঙ্গে ফতেমার অভিনয় দক্ষতা মিলে তাকে জটিল করে তুলেছে। আপন সতী ধর্ম রক্ষায় তাকে যতখানি সক্রিয় অভিনেত্রী রূপে দেখা যায়, আপন রূপ মহিমা ও আস্তর সারল্যের মহিমায় সে ততখানি দাগ কাটে না। হয়তো প্রহসন নাটকের চরিত্র বলেই মাইকেল সে দিকে সচেতন ছিলেন না। ভক্তপ্রসাদ নারী সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে কাব্য-কবিতা আউড়েছেন এবং কবিদের কল্পনার কথা বলেছেন। ফতেমা সাধারণভাবে আপন ইচ্ছেয় চালিত হয়নি। শিবমন্দিরে তার আচরণের সবটাই হানিফের নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত। সেদিক দিয়ে সে হানিফের সহযোগী চরিত্র।


সে যে পুঁটির কাছে আগাগোড়া অভিনয় করে যাচ্ছে, কখনোই তা বোঝা যায়নি। ঠান্ডা মাথায় সে সব কিছু করতে পারে। পুঁটির কু-প্রস্তাবের কথা শুনে হানিফ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলে সে শান্ত গলায় বলে—“আরে মিছে গোঁসা করো কেন ?....চল, মোরা একটু তফাতে দাঁড়াই....” এই শান্তভঙ্গি শেষে ব্যঙ্গের রূপ নিয়েছে। যেন হানিফের নির্দেশের গন্ডিরেখা অতিক্রম করে এইবার স্ব ইচ্ছায় চলতে আরম্ভ করল। ভক্তপ্রসাদকে সে বলে—“কেন কত্তাবাবু ? ন্যাড়ের মেয়ে কি এখনে আর পছন্দ হবে না ?....এই মুই আপনার কল্জে হচ্ছেলাম, আরও কী কী হচ্ছেলাম ; আবার এখন মের দূর কত্তি চাও” ?


শিব মন্দিরের প্রাঙ্গণে এসে নৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও নৈসর্গিক ভয়ের সব কথা ফতেমা বলেছে, তার মধ্যে নৈসর্গিক ভয়টাই একমাত্র হয়তো সত্য ; নয়তো পরিকল্পনার কথা তো তার জানাই ছিল। পুঁটির কু-প্রস্তাব সে নাচক করেনি এবং দত্তুরির টাকা কেটে নিলে রীতিমতো দর-দস্তুরি করেছে। হানিফ বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও সে পুঁটিকে বলে, হানিফ ‘খেতে লাঙ্গল দিতি গেছে। পুঁটি তাদের সতীত্ব নিয়ে কটাক্ষ করলে সেও উপযুক্ত জবাব দিতে পারে ; ‘মোরা রাঁড় হল্যি নিকা করি, তোরা ভাই কী করিস বল দেখি? রাতের বেলায় যে এক কৌতুক জনক ঘটনা চলেছে, সে বিষয়ে তার সানন্দ উক্তি : ‘দেখি, আজ রাত্তিরবেলা কী তামাসা হয়। অর্থাৎ তার পূর্বাপর উক্তি ও কর্ম বিচার করলে তাকে একজন ষড়যন্ত্রকারিণী এবং অভিনেত্রী বলা যায়। অতএব নির্দ্বিধায় বলা যায়, ফতেমা যথার্থই একজন প্রহসনের উপযুক্ত চরিত্র।