ধ্বনি কাকে বলে? “শ্রেষ্ঠ কাব্যের আত্মধ্বনি”–আলোচনা করো। “রসের ব্যঞ্জনাই বাক্যকে কাব্য করে।”—আলোচনা করো। “ধ্বনি বা ‘ব্যঙ্গ’ হচ্ছে কাব্যের আত্মা, তার সারতম বস্তু”—আলোচনা করো। কাব্যের আত্মা হচ্ছে তার বাচ্য নয় ‘ব্যঞ্জনা’, কথা নয় ‘ধ্বনি'—তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।

মহাকবিদের বাণীতে রমণীদেহের লাবণ্যের মতো এক প্রতীয়মান অর্থ আছে— এই প্রতীয়মান অর্থকেই ‘ধ্বনি’ বলা হয়েছে। ধ্বনিবাদীদের মতে—এই প্রতীয়মান অর্থই (অর্থাৎ ধ্বনি) কাব্যের আত্মা।

রূপনারায়ণের কুলে

জেগে উঠিলাম,

জানিলাম এ জগৎ

স্বপ্ন নয়।


পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত রূপনারায়ণ নদী এখানে বাচ্যার্থ, কিন্তু কবির ইপ্সিত বা প্রতিপাদ্য বক্তব্য এই বাচ্যার্থকেন্দ্রিক নয়, জগতের সার্বিক রুপময় সত্তা কবির মনোভূমিতে কেমনভাবে উপলব্ধ, কবির ইঙ্গিত সেদিকে। এই ইঙ্গিত বা ব্যঞ্জনা দিয়েই আমরা বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে যাই ; (শব্দের ব্যঞ্জনা শক্তি দিয়ে যে অর্থ পাই—তাকে ব্যাঙ্গর্থ বলে)। কাব্য বাচ্যার্থে কখনও নিঃশেষ হয় না, অন্য এক নিগূঢ় অর্থের তথা আনন্দের ব্যঞ্জনা প্রকাশ করে। তাই সংক্ষেপে ‘ধ্বন্যালোক’ গ্রন্থে ধ্বনির এই রকম সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে—যেখানে কাব্যের শব্দ ও অর্থ নিজস্বতা ত্যাগ করে ব্যাঙ্গার্থকে প্রকাশ করে তাকেই ধ্বনি বলে।


ধ্বনিবাদীদের বিরুদ্ধেও কিছু কিছু সমালোচনা করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে কবিতার সুধাময় মনোরম বস্তু কিছু নেই, চতুর বচনবিন্যাসে যা রচিত নয় এবং অর্থ যার অলংকারহীন, জড়বুদ্ধি লোকেরা গতানুগতিকের প্রীতিতে তাকেই ধ্বনিযুক্ত কাব্য বলে প্রশংসা করে।


এতে ধ্বনিবাদীরা বিচলিত হননি। তাঁর স্বীকার করেন কাব্যের 'ধ্বনি' তার বাচ্যার্থের মতো এত স্পষ্ট জিনিস নয় যে, ব্যাকরণ ও অভিধানে জ্ঞান থাকলেই তার প্রতীতি হবে। কিন্তু যার কিছু কাব্যবোধ আছে, তাকেই দেখানো, বা বোঝানো যায় যে, কাব্যের আত্মা হচ্ছে ধ্বনি, ব্যাচ্যাতিরিক্ত এক বিশেষ বস্তুর ব্যঞ্জনা।


‘কাব্যজিজ্ঞাসা’ গ্রন্থের লেখক শ্রদ্ধেয় অতুলচন্দ্র গুপ্ত উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। মদনের দেহ ভস্ম হয়েছে, কিন্তু তার প্রভাব সমস্ত বিশ্বময়—এইভাবের যে দুটি সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন—সে দুটিতে বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনা না থাকায় তাদের কাব্য বলেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘মদন ভস্মের পরে' কবিতাই এই বিষয়টির কাব্য হয়ে উঠেছে—

পঞ্চশরে দগ্ধ ক'রে করেছ এ কী সন্ন্যাসী।

বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে 

ব্যাকুলতার বেদনা তার বাতাসে ওঠে নিশ্বাসি,

অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।


এ কবিতার কথা তার বাচ্যকে ছাড়িয়ে, মানব-মনের যে চিরন্তন বিরহ, যা মিলনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তারই ব্যঞ্জনা করছে, তাই এটি কাব্য।


সর্বশেষে ধ্বনিবাদীরা বলেছেন যে কাব্যের আত্মা হচ্ছে তার বাচ্য নয়, ব্যঞ্জনা, কথা নয়, ধ্বনি—এ ব্যঞ্জনা এবং এই ধ্বনি হচ্ছে রসের ধ্বনি, ধ্বনিবাদীরা এই কথাও বলেছেন। রসের ব্যঞ্জনাই বাক্যকে কাব্য করে। কাব্যের ধ্বনি হচ্ছে রসের ধ্বনি।


ধ্বনিবাদীরা কাব্যের আত্মা ‘ধ্বনি' বলে আরম্ভ করেছেন, কিন্তু কাব্যের আত্মা রস বলে তাঁরা উপসংহার করেছেন।