বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্যযুগ : বলরাম দাস

বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্যযুগ : বলরাম দাস


বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অভিন্ন নামে একাধিক কবি থাকার সম্ভাবনা দেখা গেছে। বৈষ্ণব সাহিত্যে কবি চণ্ডীদাসের মতো বলরাম দাসকে নিয়েও সে সমস্যা ঘটেছে। এই দুই বলরাম দাসের মধ্যে একজন ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে, অন্যজন সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে আবির্ভূত হন বলে অনুমান করা হয়। এই দুই কবির মধ্যে প্রথম জনের কৃতিত্বই সর্বাধিক। ইনি সখ্য ও বাৎসল্য রসের পদ রচনা করেন। তাঁর রচিত পদগুলি ব্রজবুলি ও বাংলা ভাষায় রচিত হয়।


এই বলরাম দাসের জন্মস্থান, কৃষ্ণনগরের অন্তর্ভুক্ত দোগাছিয়া গ্রাম (মতান্তরে শ্রীহট্টে)। ইনি ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত। এঁর গৌর গুণগানে মুগ্ধ হয়ে নিত্যানন্দ নিজের শিরোভূষণ উপহার দিয়েছিলেন। নিত্যানন্দের সখ্যভাবের উপাসনা কবি বলরাম দাসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। বৃন্দাবন দাস তাঁর ‘চৈতন্যভাগবত' গ্রন্থে নিত্যানন্দের সাঁইত্রিশ জন পার্ষদের সঙ্গে বলরাম দাসের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন

“প্রেমরসে মহামও বলরাম দাস।

যাহার বাতাসে সব পাপ হয় নাশ ॥”


খেতুড়ী মহোৎসবের বৈষ্ণব সম্মেলনেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। ‘পদকল্পতরু’ সঙ্কলনে তাঁর নামে ১৩৬টি পদ স্থান পেয়েছে। বাৎসল্যভাব, চিত্রময়তা, আত্মসচেতনতা, বর্ণনামূলকতা, বাংলা ও ব্রজবুলির সুষম মিলন এবং ছন্দঝঙ্কার তাঁর পদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছে।


অলঙ্কার শাস্ত্রের বিভিন্ন পর্যায় অনুসরণে কবি কৃষ্ণের বাল্যলীলা, রাধাকৃষ্ণের পূর্বরাগ, অনুরাগ, মিলন, অভিসার, সম্ভোগ, রসোদগার, দানলীলা, নৌকাবিলাস, খণ্ডিতা, বিরহের পদ রচনা করেছেন। অবশ্য সব পর্যায় সমানভাবে উজ্জ্বল নয়। উল্লেখযোগ্য দু একটি অংশ; যেমন গৌরাঙ্গের বর্ণনা—

“নাচিতে নাচিতে গোরা

যেনা দিগে চায়।

লাখে লাখে দীপ জ্বলে।

কেহ হরি পায় ৷৷ 

কুলবধু সকল ছাড়িয়া হরি বলে। 

প্রেম নদী বহে সবার নয়নের জলে ॥”


নিত্যানন্দের বর্ণনা—

“আজও অবধৌত করুণার সিন্ধু 

প্রেমে গরগর মন    করে হরি সংকীর্ত্তন 

পতিত পাবন দীনবন্ধু ।।”


কিম্বা শ্রীরাধার আক্ষেপ—

“দুখিনীর বেথিত বন্ধু শুন দুখের কথা। 

কাহারে মরম কব কে জানিবে বেথা ॥

কান্দিতে না পাই পাপ ননদীর তাপে। 

আঁখির লোর দেখি কহে কান্দে বন্ধুর ভাবে ৷৷”


তার আর একটি পদ “হিয়ার ভিতর হৈতে কে কৈল বাহির” স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধ মনের বিশ্লেষণ সৌভাগ্য লাভ করেছিল।


কবি প্রধানত বাৎসল্য রসের পদ রচনায় সর্বাধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বৈষ্ণব পদাবলীতে বাল্যলীলার ক্ষেত্রে মা যশোদার সুগভীর বাৎসল্য স্নেহ পাঠকচিত্তে সঞ্চালিত। সঞ্চারিত হয়ে ওঠে মূলতঃ দুটি কারণে একদিকে আবেগের উষ্ণ উত্তাপ, অন্যদিকে সেই আবেগ-নির্ভর মুহূর্তে একটি ঘরোয়া অভিজ্ঞতার চিত্রাঙ্কন। এই পরিচয় কিছুটা পাওয়া যায় বলরাম দাসের পদে।


একদা এক সুন্দর প্রভাতে শিশু কৃষ্ণের অনভিজ্ঞ হৃদয়ে আসে বাইরের ডাক, হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে ওঠে চিত্ত। তখন আর পুরাতন পরিবেশে মন বসে না, নতুন মোহাবেশে চিত্ত হয় অধীর, ব্যাকুল হয়ে ছুটে যায় সে মায়ের কাছে, বলে

“গোঠে আমি যাব মা গো, গোঠে আমি যাব।

শ্রীদাম সুদাম সঙ্গে বাছুরি চরাব ৷৷

চূড়া বান্ধি দে গো মা, মুরলী দে মোর হাতে।

আমার লাগিয়া শ্রীদাম দাঁড়াইয়া রাজপথে ॥”


পরবর্তী অংশে দেখা যায় মা যশোদা কিভাবে “সাজায় বিবিধ বেশে” তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা। বস্তুত এই বর্ণনা চিত্ররূপে গ্রাহ্য হয়ে উঠেছে তখনই, যখন শিশুকৃষ্ণের দেহের আভরণে ও পরিচ্ছদে, রত্নহারে ও নূপুর ঝঙ্কারে, তিলক ও কাজলের অলঙ্কারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক মুগ্ধ মাতৃমূর্তি

“অঙ্গ বিভূষণ কৈল রতন ভূষণ। 

কটিতে কিঙ্কিণী ধটী পীত বসন ।। 

চরণে নূপুর দিলা তিলক কপালে। 

চন্দনে চর্চিত অঙ্গ রত্নহার গলে ।।

বলরাম দাসে কয় সাজাইয়া রাণী। 

নেহারে গোপালের মুখ কাতর পরাণি ।।”


বিলম্বিত লয়ের উচ্চারণে নিসর্গের পটভূমি এবং গোপ বালকদের গোষ্ঠ থেকে প্রত্যাবর্তনের এক পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকেছেন বলরাম দাস

“চাঁদ মুখে বেণু দিয়া    সব ধেনু নাম লইয়া

ডাকিতে লাগিলা উচ্চস্বরে।

শুনিয়া কানুর বেণু    ঊর্দ্ধমুখে ধায় ধেনু

পুচ্ছ ফেলি পিঠের উপরে ৷৷

…….

ঘন বাজে শিঙ্গা বেণু    গগনে গোক্ষুর রেণু

পথে চলে করি কত ভঙ্গে।

যতেক রাখালগণ    আবা আবা ঘনে ঘন

বলরাম দাস চলু সঙ্গে ৷৷”


বৈষ্ণব পদ রচনায় তাই কবি বলরাম দাসের স্থান অদ্বিতীয় না হোন নিঃসন্দেহে অতৃতীয়।