ক্র্যাব ও চসারের সঙ্গে তুলনা

ক্র্যাব ও চসারের সঙ্গে তুলনা


কাউয়েল সাহেব বাস্তবতার দিক দিয়ে মুকুন্দরামের কবি-মানসের সঙ্গে ক্র্যাবের কবি-মানসের সহমর্মিতা লক্ষ্য করেছিলেন "It is this vived realism which gives such a permanent value to the description. Our author is the Crabbe among Indian poets and his work thus occupies a place which is entirely its own” কেননা উভয়েই নভোচারী কল্পনার কামনায় পক্ষবিধুনন করেন নি। সচেতন ও সুতীক্ষ্ণ শব্দবোধ বা ইন্দ্রিয়ানুগ সৌন্দর্য বর্ণনায় উভয়েই ছিলেন নি:স্পৃহ। বাস্তবকে রূপায়িত করার বাসনায় প্রথানুগ ক্লাসিক রীতিরই এঁরা অনুকারী। কিন্তু আপাতসুন্দর সাদৃশ্য থাকলেও উভয়ের অন্তরাত্মার মাঝে মৌলিক অনৈক্যর সুদৃঢ় প্রাচীর বর্তমান। ক্র্যাবের মধ্যে আছে, গম্ভীর বিরস বাস্তবতা। সস্তা ভাবালুতার বিরুদ্ধে তাঁর আঘাত ছিল তীব্র। সাফোক অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতি সম্পর্কে তথ্যগত নিখুঁত পরিচয় উপস্থাপনে, এমনকি খুঁটিনাটি বিষয়েও তাঁর নিষ্ঠা ছিল সুকঠিন। অপরদিকে মুকুন্দরাম ক্র্যাবের মত নৈরাশ্যবাদী জীবনবিমুখ না হয়ে জীবনের সুখদুঃখের আকণ্ঠ অমৃতপানে হয়েছেন মুগ্ধবিবশ। ক্র্যাবের সঙ্গে মুকুন্দরামের যেখানে পার্থক্য, সেখানেই আছে চসারের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য। অবশ্য চসারের মার্জিত বাক্-বৈদগ্ধ্য, নাগর বচন-বিন্যাস, বুদ্ধিদীপ্ত রম্যরস তাঁর অনায়ও ছিল। কিন্তু চসারের শিল্পীমনের সঙ্গে মুকুন্দরামের কবি-চিত্তের ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।


E. Legouis চসারের শিল্পী মানসের সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা করেছেন: “It is well-known how dry, morose, and bitter such reproduction of reality can be. It may breed disgust, with life and men... In the 'Canterbury Tales' the element of the poet's personality has been subdued, superseded by pleasure in obser ving and understanding.” (“History of English Literature') কবিকঙ্কণের কাব্যেও এর পরিচয় পরিস্ফুট।


কৌতুকময়তা : বাঙালী দাম্পত্য জীবনের স্মরণ সুন্দর চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে শিবের গৃহত্যাগে গৌরীর আহত অন্তরের অভিযোগবাণীর মধ্যে—

“বাপের সাপে পোয়ের ময়ূর সদাই করে কেলি/

গণার মুসু্যায় কাটে ঝুলি আমি খাই গালি ॥”


কালকেতুর সঙ্গে ফুল্লরার পরিণয়োৎসবের প্রাক্-মুহূর্তে বাঙালী পরিবারের পণপ্রথার এক অনন্যসুন্দর দৃষ্টান্ত—

“একে চায় আরে পায় জায়া হীরাবতী।

সঞ্জয়কেতুর সনে নিরলে যুকতি।।”


এখানে দুঃখবাদের জ্বালাবিমথিত পঞ্জরের ক্রন্দন অশ্রুত। আবার কালকেতুর ধনবহনের সময় পার্থিব দুর্বলতা দিয়ে রচিত দরিদ্র মানুষের সহজাত সন্দেহপ্রবণতাও কৌতুকের আলোয় উদ্ভাসিত—

“পশ্চাতে চলিলা চণ্ডী লয়ে তার ধন

মনে মনে মহাবীর করেন যুকতি

ধনঘড়া লয়ে পাছে পালায় পার্বতী ।”


শঠ ব্যবসায়ী মুরারি চরিত্রের চালচিত্রে তার স্ত্রীকে স্থাপন করে কবি কৌতুকোজ্জ্বল চিত্রাঙ্কনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ধার শোধ দেবার ভয়ে বেনের আত্মগোপন, স্তোকবাক্যে বেনেনীর কালকেতুকে ভোলাবার চেষ্টা এবং কালকেতুর কাছে সোনার আটি আছে শুনে বেনেনীর মুখের চেহারা কেমন বদলে গিয়েছিল তাও সমাজসচেতন কবি যেন তার ফোটোগ্রাফিক ছবির মতো ক্ষুরধার দৃষ্টির এক্স-রে লেন্সে ধরে ফেলেছেন

“সরস করিয়া বাণী।

হাসি কয় বাণ্যানী

দেখি বাপা অঙ্গুরী কেমন।”


পরিবার তথা সমাজের চিরন্তন ছবি এখানে রেখায়িত। জীবনস্রোতে তরঙ্গিত না হয়ে স্থিতমুখে কবি তাকে দর্শন করেছেন। সম্ভবত বার্ধক্য-ক্লান্ত কবির ব্যক্তিচিত্তের নিরাসক্ত জীবনবোধই এর সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রা। তবু সন্ন্যাসী-সুলভ নির্লেপ নয়, জীবনকে ভালোবেসে তার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জন্ম-মৃত্যুতে তিনি হয়ে ছিলেন সমাসক্ত।


মুকুন্দরাম ভোগী নন, রসিক। ভোগী যে সে জীবনের লালসাপঙ্কে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে, রসিক জীবন থেকে ততটুকু দূরে যতটুকুতে বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যে স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। এই দূরত্ব ছাড়া আস্বাদ অসম্ভব। মুকুন্দরামের কৌতুকের উৎস এই নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব। তাই কবি যেমন নিপুণভাবে কালকেতুর ভোজনের বহুলতা বর্ণনা দানে উৎসুক— “ছোটগ্রাস তোলে যেন তেয়াটিয়া তাল।” তেমনি ভাড়ুর ভাঁড়ামি, মুরারির শাঠ্য, কালকেতু ফুল্লরার স্বল্পবুদ্ধি অস্ত্যজ আচরণ সবই তার কৌতুকের অংশীদাররূপে পরিগণিত। এমন কি বনের ভালুক পর্যন্ত এই কৌতুক প্রসারিত। গুজরাট নগরের মূর্খ বিপ্রের বর্ণনায় স্বজাতি সম্বন্ধে কবির মন্তব্য হাস্যোজ্জ্বল—]

“চন্দন তিলক পরে দেবপূজা ঘরে ঘরে

চাউলের কেঁাচড়া বান্ধে টান।”


আসলে, মুকুন্দরাম অভিজ্ঞতার কবি। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত পরিবার জীবনের বহুমুখী অভিজ্ঞতায় তাঁর কবি-মনের স্মৃতিভাণ্ডার হয়েছে পরিপূর্ণ। তাঁর সমাজসচেতনতা ও বাস্তবচেতনার মৌল উৎস ছিল এই অভিজ্ঞতা। সৎ কবির অন্বিষ্ট সত্যের অনুসন্ধান এবং জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার সুশৃঙ্খল সমন্বয় — “to explore reality and to order experi ence” শিল্প প্রকৃতির আর্শী নয়। এ কথা বাস্তববাদী শিল্পীর পক্ষেও প্রযোজ্য। শ্রেষ্ঠ বাস্তববাদী শিল্পীরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সীমায় বদ্ধ নন। বছর অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানসাধনায় তাঁরা আত্মস্থ করেন। তারপর কল্পনার সহায়তায় বস্তুবিশ্বের ব্যাপক ও গভীর সত্যকে রূপ দেন। এ কথা ঠিক, মুকুন্দরাম প্রত্যক্ষ বাস্তবের রূপকার। তবু গার্হস্থ্য প্রাত্যহিকের নিস্তরঙ্গ পারাবতবৃত্তি যেন তার কাব্যের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। যেমন— গৌরীর অধিবাস বর্ণনা

“কাখেতে হেম ঝারি    মেনকা মিলি নারী

জল সহে ঘরে ঘরে।

এয়ো আসি মিলি    করি হুলাহুলি 

তণ্ডুল মঙ্গলন করে ।”


গৌরী-মেনকার কলহে মেনকার অভিযোগ এবং ঘর-জামাই প্রথার চিত্র

“দুগ্ধ উথলিতে গৌরী নাহি দেহ পানি।

সখি সঙ্গে খেল পাশা দিবস রজনী ৷৷

…..

রান্ধি বাড়ি আমার কাকাল্যে হইল বাত। 

ঘরে জামাই রাখিয়া জোগাব কত ভাত ॥ ”


অভিমানী গৌরীর প্রত্যুত্তরে প্রতিবাৎসল্যের পরিচয়

“রান্ধিয়া বাড়িয়া মাতা কহ দেহ খোঁটা।

আজি হইতে তোমার দুয়ারে দিনু কাঁটা ।।”

…….

এত বলি যান দেবী ছাড়ি মায়া মোহ।

ঝলকে ঝলকে বহে লোচনের লোহ ॥ ”


অনুরূপভাবে হর-গৌরীর দাম্পত্য কলহ অংশে গৌরীর ক্ষোভ

“বাপের সাপে পোয়ের ময়ূর সদা করে কেলি।

গণার মুসু্যায় কাটে ঝুলি আমি খাই গালি ।”


অথবা “উচিত কহিতে আমি সবাকার অরি” ইত্যাদি উক্তি শুনে মনে হয়, মানবদুর্লভ আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা নয়, যুগযুগান্তকারী বাঙালীর দাম্পত্য জীবনযাপন লীলাই এই দেবখণ্ডের দর্শনীয় দিক। কেবল এই ‘দেবখণ্ডে’ নয়, প্রসূতির আহারে অরুচি, গর্ভবেদনা, নবজাতকের জন্ম ও মাঙ্গলিক ক্রিয়া-কর্ম, কালকেতুর শৈশবলীলা এবং কালকেতুর বিবাহে পণপ্রথার চিত্রটিও একই সঙ্গে সমাজচিত্র এবং কৌতুককর হয়ে উঠেছে।


কবিকঙ্কণ বিশ্বজনীন ভাবলোকের ক্লান্ত মুসাফির ছিলেন না। প্রত্যক্ষ বিষয়ের সঙ্গে নিবিড় সহানুভূতি এবং অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তার কাব্য হয়েছে বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। কল্পনাও সমাজসঙ্গী হয়েছে সেইসঙ্গে যেন কৌতুকের কবচকুণ্ডল ধারণ করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ চণ্ডীর কাছে ভালুকের কান্নার দৃশ্যটি স্মরণ করা যায়

“উইচারা খাই আমি নামেতে ভালুক।

নেউগী চৌধুরী নই না করি তালুক ॥”


একে যদি নিঃস্ব দুর্বল প্রজার শোষক জমিদারের প্রতি ক্ষোভের সুদূর সঙ্কেত বলে ভাবা হয়, তবে হাতির আক্ষেপ নিশ্চয় হাসায়

“বড় নাম বড় গ্রাম বড় কলেবর। 

লুকাইতে স্থল নাহি অরণ্য-ভিতর ।।

কি করিব কোথা যাব কোথা গেলে তরি।

আপনার দস্ত হইল আপনার বৈরী ।।”


‘মানবখণ্ড’ অংশে ব্যাধ-জীবনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেখা যায়। সেখানে আছে কালকেতু পরিবারের পশুশিকারসহ বেচা-কেনার বাস্তবচিত্র

“নিদয়া বইসে ঘাটে   মাংস নিয়া হাটে

অনুদিন বেচয়ে ফুল্লরা।

শাশুড়ী যেমন ভণে   তেমন বেচন কেনে

শিরে কাঁখে মাংসের পসরা ।।

মাংস বেচি নিয়া কড়ি    কিনে চালু ডালি বড়ি

তৈল লোন কেনয়ে বেসাতি।”

আবার হাতীর দাঁত বিক্ৰী :

“চুবড়ি মেলায়ে দন্ত বেচেন ফুল্লরা।

কৃষাণে যেমন দেই মূলার পসরা ।”


মোষের সিংঃ “শৃঙ্গের পসরা দেয় ফুল্লরা বাজারে,” আছে বাঘছালের কথা “হাটে বাঘছাল বেচে ফুল্লরা রূপসী”, কখনো বা আছে গণ্ডারের খড়্গা-বিক্রয়ের চিত্র “গণ্ডার বান্ধিয়া কাণ্ডে খড়া দিয়া ছিণ্ডে ৷৷ ফুল্লরা বেচয়ে খড়্গা দরে এক পণ” ইত্যাদি।


ঔপন্যাসিক প্রতিভা : গণসাহিত্যের প্রথম ছায়াপাত মুকুন্দরামের ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্যে দৃশ্যমান। দক্ষ-চরিত্রাঙ্কন, কুশল ঘটনা সন্নিবেশ, সংলাপ-নৈপুণ্য, ব্যাপক অভিজ্ঞতা, আশাবাদী জীবনদর্শন ইত্যাদি যে সমস্ত গুণাবলী সার্থক ঔপন্যাসিকের রচনায় পরিলক্ষ্য, তা মুকুন্দরামের কাব্যেও অভিব্যক্ত। পূর্বসূরীদের কাব্যে যা ছিল গুহায়িত,‌ মুকুন্দরামের অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতি নির্বরে তা বহুজনীনরূপে হল পরিস্নিগ্ধ। তাই তাঁর অঙ্কিত মুরারি শীল, ভাড়ু দত্ত, ফুল্লরা সময়-সাগর পেরিয়ে “বহুযুগের ওপার হতে” আজও সুবেদী পাঠকচিত্তে সমাদৃত হয়। আঙ্গিকগত গতানুগতিকতা থাকলেও চিন্তার কৌলীন্য ও ভাষার ঈশিত্ব স্বীকার করতে হয়।


ঘটনা ও সংলাপ : আখ্যানকাব্যের গঠনভঙ্গীর একটি প্রধান সমস্যা, ঘটনা, বর্ণনা ও সংলাপের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান। এই তিনটি উপাদানই অবশ্য প্রয়োজন। কিন্তু একটা আনুপাতিক মিলন ঘটা চাই। গল্প বলার আদিযুগে কাহিনীতে ঘটনার বিবরণ ছিল সমধিক। সংলাপের সঙ্গতি ছাড়া তা ছিল বিবর্ণ ও শীতল। বর্ণনার গুরুত্ব আসে কাব্যত্ব থেকে। ঘটনায় থাকে দ্রুততার ঝোঁক, বর্ণনায় মন্থরতার। কবিকঙ্কণের কাব্য ঘটনাপ্রধান, বর্ণনামুখ্য নয়। এটিও প্রথা। কালকেতুর নগর পত্তন, কলিঙ্গে ঝড় বৃষ্টি-বন্যায় বর্ণনার সুযোগ থাকলেও বর্ণনা ও ঘটনার মধ্যে রাখীবন্ধন সর্বত্র হয় নি। কিন্তু সংলাপ রচনায় এবং সংস্থানে কবির কৃতিত্ব প্রশংসার পরিচায়ক; যেমন দেবখণ্ডে ও শিবের মাহাত্ম্য নিয়ে দক্ষ সতীর বিতর্ক, ঘরে জামাই-পোষা প্রসঙ্গে মেনকা-গৌরীর কলহ, দারিদ্র্যের জন্য শিব-গৌরীর বিবাদ, সুন্দরী নারী দেখে কালকেতু ফুল্লরার বিরোধের কথাবার্তায় কিংবা হাটুরেদের উপরে ভাড়ুর অত্যাচারের বিবরণ ও বৈচিত্র্যের স্পর্শে ও সংঘাতের উত্তেজনায় নাট্যরস জমে উঠেছে।


আখ্যানভাগ নির্মাণ ও চরিত্রচিত্র : আখ্যান ও চরিত্রের মধ্যে সম্পর্কটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই অন্য সব কাহিনীর থেকে উপন্যাসের স্বাতন্ত্র্য। বলা চলে এখানেই উপন্যাসের প্রথম নিশ্চিত প্রকাশ লক্ষণ। ঘটনার উপর ঘটনা জমিয়ে প্রবাল দ্বীপ সৃষ্টির পদ্ধতিটি পুরাতন। গল্পসাহিত্যের প্রথম যুগে ঘটনাগত পারস্পর্য রক্ষাই ছিল চরম লক্ষ্য। উপাখ্যানের ভিত্তিতে যে সমস্যা, পরিণতিতে তার সমাধান, কৌতূহলকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং তৃপ্ত করতে তাই-ই তখন পর্যাপ্ত ছিল। মানুষের ভূমিকা থাকলেও তা ঘটনার ছকে দাবার ঘুঁটির চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। মানুষের ভাগ্যের বেদনাবিধুর কাহিনী থাকলেও তা নিতান্তই ছিল ঘটনার মালা গাঁথা। একটি ব্যক্তিত্বের, স্বাতন্ত্র্যের তীক্ষ্ণতা সেখানে বিরলদৃষ্ট।


মুকুন্দরামের কাব্যের মধ্যেই দেখা গেল তার প্রথম পরিচয়। তার অঙ্কিত চরিত্রগুলি এল সমতল মাটির কাছাকাছি, বাংলার পরিবার জীবনের নিত্য পরিচিত। কারণ অভিজ্ঞতা-সৃষ্ট বাস্তব কিছু তৈরি করাতেই ছিল তার আনন্দ, তার সাফল্য। কালকেতু ও ফুল্লরা অন্ত্যজ ব্যাধশ্রেণীর মানুষ। চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ, সুদূর কামনা-বাসনা প্রভৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া সভ্যতারই লক্ষণ। কিন্তু অন্ত্যজ অসভ্য সমাজে চিন্তা ও মননের অতিরেক অনুপস্থিত। তাদের জীবনে মনের ভূমিকা সামান্যই। দেহবুদ্ধিতেই এ শ্রেণীর জীবনবোধের সীমা। রবীন্দ্রনাথের ‘বসুন্ধরা' কবিতায় এই শ্রেণীর পরিচয় পরিস্ফুট—

"অরুগ্ন বলিষ্ঠ হিংস্র নগ্ন বর্বরতা-

নাহি কোনো ধর্মাধর্ম নাহি কোনো প্রথা 

নাহি কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব, নাহি ঘর পর, 

নাহি কোনো বাধাবন্ধ নাহি চিত্তা জুর…"


কালকেতু বীর এবং শিক্ষা সংস্কারহীন বর্বর। সে কুশলী সেনানায়ক নয়, অমানুষিক দৈহিক শক্তির অধিকারী এক মল্ল। দারিদ্র্য দংশনে সে হাহাকার করে না, ভোজ্যদ্রব্যের স্বল্পতায় তার দেহকে পীড়িত করে। সে চতুর না হলেও নির্বোধ নয়। সম্পদদায়িনী দেবীর প্রতি তার সন্দেহপ্রবণতা বাল-সুলভ মনেরই পরিচায়ক। কিন্তু ব্যাধজীবনের অরণ্য পরিবেশে সে জীবন্ত হলেও রাজ্য পরিচালনায়, বুদ্ধি ও মেধাপ্রধান বৃত্তিতে সে ম্রিয়মাণ। এ চরিত্র নির্মাণে দুটি মাত্র স্থানে কবির দৃষ্টি ঔচিত্যভ্রষ্ট হয়েছে। ছদ্মবেশী চণ্ডীকে স্বগৃহে প্রত্যাবৃত্ত করবার জন্য পুরাণাদির উল্লেখ কালকেতুর পক্ষে যেমন অসঙ্গত, তেমনি অসম্ভব কলিঙ্গরাজের প্রশ্নের জবাবে তার সুচতুর বাক্যে আপন চণ্ডীভক্তির মাহাত্ম্য প্রচার করা।


“বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ”— এ উক্তির অনন্য দৃষ্টান্ত ফুল্লরা চরিত্র। সে, কালকেতুর সুখ-দুঃখভাগিনী গেহিনী। সর্বত্রই তার সহিষ্ণু-সুন্দর মূর্তি অবিচল। তাই তার ‘বারমাস্যা’ দুঃখের উপাদানে গড়া নয়, সেখানে কৌতুকের সকল রসের ধারা প্রবাহিত। দারিদ্র্য অপেক্ষা সতীন নিয়ে জীবনযাপনে তার কঠিন আতঙ্ক। এই আতঙ্কই তাকে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং অশিক্ষিত পটুত্ব দান করেছে। বারমাস্যায় তার কৌতুকমিশ্রিত সুন্দর পরিচয় পরিস্ফুট। ছদ্মবেশী চণ্ডীকে বিদায় করার প্রচেষ্টায় হয়ে গোলাহাটে কালকেতুর কাছে তার বিপন্ন আগমনের মধ্য দিয়ে ফুল্লরা চরিত্রের মধ্যে নারীত্বের চিরন্তন রূপ রূপাঙ্কিত। আবার কালকেতুকে দেবীর অঙ্গুরী দানের সময় চণ্ডীর কার্পণ্যে তার কালকেতুর প্রতি যে উপদেশ—

“এক অঙ্গুরীতে প্রভু হবে কোন কাম।

সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম !!”


প্রভৃতি উক্তির মধ্য দিয়ে তার আপন বুদ্ধি সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা রেখায়িত। কিন্তু কলিঙ্গ সৈন্যের ভয়ে তার কালকেতুকে যে উপদেশ— “যদি আছে জীয়ে আশা ত্যাজিয়া দেশের বাসা / প্রাণ লয়ে চল মহাবীর” উক্তির মধ্য দিয়ে স্ত্রী-বুদ্ধি যে প্রলয়ঙ্করী তা পরে প্রমাণিত হয়। সম্ভবত ফুল্লরা চরিত্রে এই ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সাংসারিক বুদ্ধিতে আপন শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে নারী মাত্রেই যে আত্মম্ভরিতা দেখা যায় তার প্রতি কবির কটাক্ষ এখানে প্রকাশিত হয়।


মুরারি শীল কালকেতু আখ্যানের অনশ্বর চরিত্র। সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতে, স্বল্প ভূমিকায় পাঠকের মনের মানচিত্রে সে গভীর ছাপ রেখে যায়। তার চরিত্রের অসাধারণত্ব তিনটি কারণে স্বীকার্য; স্ত্রীর সাহচর্য, বাকৃবিন্যাসের পটুত্ব, কৌতুকরসের সংযোগ। মুরারি চরিত্রের-চালচিত্রে তার স্ত্রীকে স্থাপন করায় সে আরো সজীব, আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তার পাওনাদারকে ফেরাবার চাতুর্য যেমন হৃদয়গ্রাহী—

“কাষ্ঠ আন এক ভার হাল বাকি দিব ধার

মিষ্ট কিছু আনহি বদর”


তেমনি কালকেতুর কাছে আটি আছে শুনে “সরস করিয়া বাণী হাসি কয় বাণ্যানী/দেখি বাপা অঙ্গুরী কেমন” জীবনের প্রতিবেশী চিত্র হিসাবে মনোগ্রাহী। কিন্তু তুরূপের তাস এখনো দেখানো বাকি। শাঠ্যে, বাক্‌ভঙ্গীতে মুরারি সত্যই যে তার স্ত্রীর উপযুক্ত পতিদেবতা তার পরিচয় পাই যখন দেখি সে পুরাতন ধারের কথা না তুলে কালকেতুর কুশল সংবাদের জন্য আন্তরিক কাতরতা প্রকাশ করে। ছলনার পল্লবে কালকেতুর মত সহজবুদ্ধির মানুষ এই জালে সহজেই ধরা পড়ে। বিক্রেতার মনকে একটু নরম করে নিয়ে সে অপ্রত্যাশিতভাবে আসল জায়গায় আঘাত হানে—

“সোনারূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিত্তল

ঘষিয়া মাজিয়া বাপু করেছ উজ্জ্বল।”


কিন্তু চণ্ডীমঙ্গলের বিবর্ণ পাতা থেকে যে চরিত্রটি বাঙালীর মানসলোকে স্থায়ী আসন নিয়েছে তা কবির বাস্তবোচিত অভিজ্ঞতার ধারক— ‘ভাড় দত্ত'। বাংলা সাহিত্যের প্রথম ভিলেন চরিত্র। মুকুন্দরাম ভাড়ু দত্তের মধ্যে দেখেছেন কাম্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা না পাওয়ায় একটি বিপর্যস্ত চিত্তকেন্দ্র। নিজের বংশকৌলীন্য এবং বুদ্ধি ও প্রতিভা সম্বন্ধে তার আকাশস্পর্শী দত্ত— “যতেক কায়স্থ দেখ ভাঁড়ুর পশ্চাতে লেখ / কুলশীলে বিচার মহত্ত্বে / ... ঝারী থালা অলঙ্কার দিয়া করি ব্যবহার / কেহ নাহি করয়ে রন্ধন।” কিন্তু তার ক্ষমতার সীমা কতদূর, তা তার ভাষায় প্রতিফলিত—

“উঠানে ডুবিয়া মরি না জানি সাঁতার

জটে ধরি পত্নী মোরে করিলা নিস্তার।”


জীবনের কাম্য মর্যাদাপ্রাপ্তি না পাওয়ায় সামাজিক মানী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তার যে জাতক্রোধ হয়েছে ধূমায়িত, বুলান মণ্ডলকে প্রজামুখ্যের সম্মান দেওয়ায় তা আত্মপ্রকাশিত। নগরের মণ্ডল না হয়েও বহুকাম্য মণ্ডলত্বের ভূমিকাভিনয়ের ক্ষণিক আত্মপ্রসাদ সে পেতে চায়। মৌলিক চরিত্র না হলেও রচনা-সৌন্দর্যে ও সহানুভূতির আলোকে ভাঁড়ু দত্ত কালকেতু-আখ্যানের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সূক্ষ্ম মনস্তত্ববোধের মহিমায় জীবন্ত। আধুনিক যুগের ঔপন্যাসিকের মত তার কাব্যে অঙ্কিত চরিত্রের অন্তরক্ষেত্রে অরণ্যের জটিলতা নেই, নেই সরীসৃপ সন্দেহ, আছে শুধু ফলশ্রুতিতে মানবপ্রেমের কল্যাণ-স্নিগ্ধ অভিব্যঞ্জনা।


ঔপন্যাসিকের পক্ষে যা প্রধান প্রয়োজন-ব্যাপক অভিজ্ঞতা, তার উপাদান মুকুন্দরামের কাব্যে সুপ্রচুর। নিদয়ার সাধভক্ষণ, কালকেতুর জন্ম, কালকেতুর নামকরণ সর্বত্রই কবির পর্যবেক্ষণ ভাবনায় পরিস্নিগ্ধ। গুজরাট নগরের বর্ণনা চলমানতার সুরে বিধৃত। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ সেখানে উপস্থিত। তাই “মৎস্য বেচে চষে চাষ বৈসে দুই জাতি দাস / কলু নগরে পীড়ে ঘানি” যেমন আছে, তেমনি আধুনিক যুগের ঔপন্যাসিকের মতো কবি-দৃষ্টির নিরপেক্ষতায় ধরা পড়েছে— “লম্পট পুরুষ আগে বারবধূগণ বৈসে/এক ভিতে তার অধিষ্ঠান ॥”


মুকুন্দরাম রোমান্টিক কবি নন, জীবনের সূক্ষ্ম সংবেদনশীলতায় তাঁর চিত্ত নিঃস্পৃহ। কিন্তু আমাদের দিনানুদৈনিক জীবনযাত্রার ও সুপরিচিত ভাবসমূহের অভিব্যক্তিতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মঙ্গলকাব্যের কবির শিল্পবোধ শিথিল ও অপরিণত। বিষয়-মহিমায় তার চিত্ত থাকে অভিভূত। প্রকাশের মনোহারিতা তাঁর কাছে গৌণ ব্যাপার। কিন্তু একমাত্র মুকুন্দরামের কাব্যেই শিল্পবোধ ও চারুত্ব সৃষ্টি দৃশ্যমান। অতিপল্লবিত অহেতুক বাক্য বিস্তারের স্তরে অর্থঘন সংক্ষিপ্তি, অনিয়মিত ভাবাবেগ ও ভক্তিবিহ্বল অস্বচ্ছতার স্থলে মিতভাষিতা ও তীক্ষ্ণ ভাস্বরতা, নির্বিকার প্রথানুবর্তনের স্থলে বাস্তবস্বীকৃতির প্রখর মৌলিকতা, অর্ধ-যান্ত্রিক পূর্ব রোমন্থনের স্থলে নতুন অনুভূতির দীপ্ত ঝলক (দ্রষ্টব্য : ‘কবিকঙ্কণ-চণ্ডী’, ভূমিকা, ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) এইগুলি তাঁর রচনার ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। তাঁর রচনা এক সচেতন, সমগ্র প্রসারিত মননের মৌন মধুরসে অভিষিক্ত। তাঁর শিল্পবোধ মার্জিত, জীবনবাদ-সম্ভৃত রসিকতা পূর্ববর্তী গ্রাম্য ভাড়ামোর যাযাবরী অশ্লীলতা থেকে স্বতন্ত্র। তার কৌতুক কেবল কথার ঊর্ণজাল নয়, বঙ্কিম কটাক্ষে, অর্থগূঢ় মন্তব্যে ও মনোভাবে, জীবনদর্শনের নানামুক্তির বিস্তার হতে তা ময়ূরকণ্ঠীর মত সাতরঙে বিচ্ছুরিত হয়।


বায়ুমণ্ডলে বাস করে বাতাসের চাপ এড়ানো যায় না। মুকুন্দরামের ব্যক্তিগত জীবনও তাই ‘অভয়ামঙ্গল' কাব্যে ভাস্বর। সার্থক উপন্যাসে লেখকের ব্যক্তিগত জীবন প্রতিফলিত। ‘মাদাম বোভারি'-র বিশ্ব বিশ্রুত ঔপন্যাসিক ‘ফ্লবেয়ার'-এর সত্যোচ্চারণ— "Madam Boveri c'est moi (Madam Bovery is me)" 'Oliver Twist' 'David Copperfield'-এর মধ্যে আমরা পাই ডিকেন্সকে। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসেও তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন অনায়াসলভ্য। মুকুন্দরামের কাব্যেও ব্যক্তিগত জীবনরস প্রবাহিত। দারিদ্র্যের ক্রূর ব্যথার মূর্তি তাকে প্রতিনিয়ত আলিঙ্গন করতে হওয়ায় তার সেই নির্যাতীত অভিজ্ঞতা এবং গোপন বেদনা কাব্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। তাই তৎকালীন বঙ্গসমাজের বহু চেনা চরিত্র তাঁর কাব্যে একান্ত বাস্তব অনুভূতিতে ধৃত। তাদের বিচিত্র পৃথিবী সাধারণের মনে বিস্ময়ের দ্বার খুলে দেয়। যুগ ও সমাজের যে চিত্রাঙ্কন তাঁর রচনাশৈলীতে সুস্পষ্ট তা যে কোন সাহিত্যের পক্ষেই ঐশ্বর্য বিশেষ। তাই মধ্যযুগের সাহিত্যে মুকুন্দরাম এক দীপ্তিমান নক্ষত্র।