মা মেনকা মাঝে মাঝে স্বপ্ন এবং জাগ্রত অবস্থায় কন্যার মধ্যে জগজ্জননীর প্রকাশ লক্ষ্য করে কীভাবে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন 'আগমনী' পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট শাক্তপদ অবলম্বনে তার পরিচয় দাও।
শাক্তপদাবলি শক্তিতত্ত্বের কাব্যরূপ বলে পদাবলির বিভিন্ন পদে তান্ত্রিক যোগসাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়। যোগসাধনা তন্ত্রসাধনা ব্যতিত সফলতা লাভ করা যায় না। ফলে স্বাভাবিক ভাবে তান্ত্রিক যোগসাধনার কথা এসে পড়ে। পুরাণের শাক্ত। দেবীকে কল্যাণী জননী মূর্তিতে দেখে মাতার মহিমা বন্দনা করা হয়েছে।
শাক্ত পদাবলির এই কল্যাণী দেবীমূর্তি স্নেহময়ী জগজ্জননী হলেও বিভিন্ন পুরাণের যে বিবরণ পাওয়া যায় তা ভয়ঙ্করী, দিগম্বরী ও চামুণ্ডারূপিনী। দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগ, ঊমারূপে হিমালয় গৃহে তার জন্ম, ইন্দ্রের বজ্র ভয়ে মৈনাক পর্বতের সমুদ্রে আশ্রয় গ্রহণ, নীলকণ্ঠ শিবের বৈভব ইত্যাদি বিষয়ের বহু পুরাণ কথিত চিত্র শাক্ত পদাবলির মাতৃকা মূর্তি নির্মাণের উৎসরূপে উল্লেখ্য। মঙ্গলকাব্যে দেখা যায় হর-পার্বতীর দারিদ্র লাঞ্চিত সংসার চিত্র শাক্ত পদাবলির দেবীর কায়ারূপে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। অর্থাৎ শাক্তদেবী শাস্ত্র পদাবলিতে কল্যাণী জননীরূপে মূর্তিমতী।
তবে বাঙালি কবির ভাবনায়, চিন্তায়, ধ্যানে এবং বাংলার নিবিড় ছায়ায় এবং জলহাওয়া প্রলেপে শক্তিদেবী এখানে বরাভয়দায়িনী মাতা। বেদ উপনিষদে শক্তিদেবীর উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে পুরাণ ও তন্ত্রাদিতে দেবী মাহাত্ম্যপূর্ণ ভাবে প্রকাশিত। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে দেবী জলন্ত পর্বতের মতো তেজস্বিনী অথচ কৃপাময়ী বলা হয়েছে। তন্ত্রে দেবীকে চামুণ্ডা ভয়ংকরী কালী করালবদনা নরমালা বিভূষণা, আরক্ত নয়না বলা হয়েছে তন্ত্রে দশমহাবিদ্যার বর্ণনাটি শাক্ত সাহিত্যের প্রেরণাসুক্ত হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।-
“কালী তারা মহাবিদ্য ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।।
ব্যালা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা
এতা দশমহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীর্তিতাঃ ॥”
ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর 'ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য' গ্রন্থে বলেছেন “বাঙালি কবিগণ বৈষ্ণুবই হোন আর শাক্তই হোন, সকলেই মধুর রসের উপাসক।” এই মস্তব্যের সত্যতা অনুভূত হয় 'ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পদসমূহে। সংসার প্রতিপালক পিতার নিকট তাড়িত হয়ে সন্তান যেমন মায়ের আশ্রয়ে নিজেকে সমর্পণ করে আশ্বস্ত হয় এখানেও সেইরূপ বর্তমান। শাক্তপদকর্তাগণ বিশ্বজননীকে আপন মাতার ভূমিকায় স্থাপন করে তাঁর কাছে অভাব-অভিযোগ এবং আবদার জারি করেছেন।
মা গো তারাও শংকরী,
কোন্ অবিচারে আমার 'পরে করলে দুঃখের ডিক্রিজারি ?
জননী কল্যাণময়ী রূপ 'ভক্তের আকৃতি' পর্যায়ের পদে বারবার প্রকাশিত। জননীর সঙ্গে সস্তানের সম্পর্ক গভীর জননী কল্যাণময়ী বলেই রামপ্রসাদ এবটি পদে বলতে পেরেছেন–
“কিছু দিলে না পেলে না নিলে না খেলে না সে দোষ কি আমারই?
যদি দিতে পেতে নিতে খেতে দিতাম খাওয়াইতাম তোমারই।”
জননী যদি কল্যাণী না হয়ে ভয়ংকরী হতেন, তবে কি আর রামপ্রসাদ এমনভাবে বলতে পারতেন ? জননী কল্যাণী বলেই সস্তান সর্ব অবস্থাতেই তাঁর নিকট আশ্রয় কামনা করেন। মানবজন্ম মানেই দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ। চিরতরে দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে মায়ের চরণে আশ্রয় নিতে হয়–
“জন্ম মৃত্যু যে যন্ত্রণা, যে জন্মে নাই সে জানে নাই
তুই কি জানিবি সে যন্ত্রণা, জন্মিলে না মরিলে না।
তবু রব মায়ের চরণে আর তো ভবে জন্মি না।”
‘আগমনী-বিজয়া’ পদে মেনকা কন্যা উমার মূর্তি স্বপ্নে দেখে চমকে উঠল –
কুম্বপ্ন দেখেছি গিরি, উমা আমার শ্মশানবাসিনী
অসিত বরণা উমা মুখে অট্ট অট্টহাসি।
এখানে দেবতা প্রিয় হয়ে উঠেছে। আবার শক্তিদেবী যেখানে স্ব-মূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত। সেখানে কবি দেবী কালিকার রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে প্রশ্ন করেন –
“ঢলিয়ে ঢলিয়ে কে আসে, গলিত চিকুর আসব আবেশে,
বামা রণে দ্রুতগতি চলে, দলে দানব-দলে, ধরি করতলে গজর গরাসে।।”
তবে শেষপর্যন্ত কবি এই ব্রহ্মময়ীকে করুণাময়ী জননীরূপে আবাহন করেছেন।
উমা গিরিপুরে উপস্থিত হলেও মাতা মেনকা প্রাণের উমাকে—
কৈ হে গিরি, কৈ সে আমার প্রাণের উমা নন্দিনী।
সঙ্গে তব অঙ্গনে কে এলো রণরঙ্গিনীর
দ্বিভুজা বালিকা আমার উমা ইন্দুবদনী
কক্ষে লয়ে গজানন গমন গজ গামিনী
রণরঙ্গিনী, দ্বিভূজা, চন্দ্রমুখী গণেশজননী উমার পরিতে
এ যে করি-অরিতে করি' ভর করে করিছে রিপু-সংহার,
পদ-ভরে টলে মহী মহিষনাশিনী
প্রবলা প্রখরা মেয়ে, তনুর্কীপেদরশনে,
জ্ঞান হয় ত্রিলোকধন্যা ত্রিলোক-জননী। [ দশরথি রায় ]
সিংহপৃষ্ঠে চরণ আরোপনকারিণী, শত্রু বিমর্দিতা দেবী আবির্ভূতা, তার পদভারে পৃথিবী কম্পিতা। প্রবলা প্রখরা কন্যাকে দর্শন করে হৃদয় কম্পিত। কন্যারূপে নয় রণরঙ্গিনী মূর্তিতে উমার আগমনে মেনকা বিস্মিত।
“দশভূজে পাশ শোভা পায় :
বলে গেলে হে গিরি, যাই–
আনিগে গিরিজায়,
সে মেয়ে রেখে এলে কোথায়।"
মেনকা উমাকে তাঁর আদরের ধন বলে বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ, এই দেবী মূর্তির সঙ্গে উমার কোনো সাদৃশ্য নেই। উমার এই মূর্তি অপরূপ, দশভূজা, লোকে তাঁর চরণকমলে পুষ্প চন্দন দানে পূজা করেছে। পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী দণ্ডায়মান। চন্দ্র সূর্য তাঁর পদে যেন উদিত। এই পরমাশ্চর্যময়ী দেবী ঘরের মেয়ে হতে পারে না। চতুর্ভূজা উমা কীভাবে দশভূজা হল মেনকা তা বুঝতে না পেরে গিরিরাজের ছলনা বলে মনে করেছেন। অতএব আলোচ্য পদে উমা পৌরাণিক দেবীমূর্তিতে রূপান্তরিতা।
অতএব শাক্তপদাবলি উমার যে দেবীরূপের অন্তরালে কল্যাণীয়া জগজ্জননীরূপে প্রতিষ্ঠা তা বড়োই বিস্ময়কর। অষ্টাদশ শতাব্দীর যুগমানসে কবিদের সমস্ত যন্ত্রণার অবসানের জন্য কল্যাণময়ী জননীরূপে শক্তিকে একান্তভাবে আশ্রয় করতে চেয়েছে। চন্দ্রনাথ দাসের একটি পদে মাধুর্যমণ্ডিতা কল্যাণময়ী জননী রূপটি পরিগ্রহ করেছে—
“সারাদিন করেছি মাগো সঙ্গী লয়ে ধূলা খেলা,
ধূলা ঝেড়ে কোলে নে মা এসেছি সন্ধ্যেবেলা।”