বিদ্রোহের শেষ নেই।

অরণ্যের অধিকারে মহাশ্বেতা দেবী জাতির জীবনে বিদ্রোহ সম্পর্কিত একটা নতুন দর্শন স্থাপন করেছেন। বিদ্রোহ ঘনীভূত হয় অসন্তোষ ও অপ্রাপ্তী জনিত কারণে। মানুষ সুবিধাভোগী। চাওয়ার পরিধি বিস্তৃত কিন্তু প্রাপ্তির পরিমাণ সীমিত। যুগযুগ ধরে মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে জানিয়ে এসেছে দাবি, কিন্তু বিনিময়ে প্রবঞ্চিত আশাহত হয়ে শিকার হয়েছে অসন্তোষের। ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের ফলে মন হয়ে উঠেছে প্রতিবাদী। প্রতিবাদী মানুষ যখন জোটবদ্ধ হয়ে চিৎকার করে উঠেছে তখন ধূমায়িত হয়ে উঠেছে বিদ্রোহের অগ্নি। যুগে যুগে মানুষ তার দাবি-দাওয়া আদায়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বিদ্রোহের বিষয়গত দিক কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। অধিকাংশ বিদ্রোহ সংগঠনের মূলে ছিল জাতীয়তাবোধ। দৈনতা, বিদ্রোহ কখনো শেষ কথা বলেনি। বিপ্লব আনে শান্তি, শান্তি মানুষের মধ্যে বাড়ায় চাহিদা বোধ, চাহিদা থেকে সৃষ্ট হয় অশান্তি। আর পুঞ্জীভূত অশান্তিই তো জন্ম দেয় বিদ্রোহের বিপ্লবের। তাইতো পৃথিবী আছে যতদিন, বর্তমান থাকবে সৃষ্টি, আর সৃষ্টি প্রার্থনা জানাবে ধ্বংসের, এই ক্রমিক বিবর্তনের মাঝে বিদ্যুচ্চমকের মতো মানবের মনে জেগে উঠবে বাঁচার নেশা, এটাই প্রত্যাশিত।


অরণ্যের অধিকার এর দাবি নিয়ে অসভ্য আদিবাসী উপজাতি বীরসা মুণ্ডা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল দিকুদের বিরুদ্ধে। সাহেবদের বিরুদ্ধে। ১৮৯৫-১৯০০ খ্রিস্টাব্দের বীরসার ওই বিদ্রোহে নতুনত্ব কিছুই ছিল না। কারণ নিজেদের খুঁটকাটি গ্রামের অধিকার নিয়ে বীরসার আন্দোলনের বহু পূর্বে আদিবাসীরা বহু আন্দেলেন করেছিল। যা আদিবাসী আন্দোলন নামে পরিচিত। বীরসার আন্দোলনের যা উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববর্তী আদিবাসী বিদ্রোহগুলিরও সেই উদ্দেশ্য ছিল। উভয়ের বিদ্রোহের মূলে ছিল স্বাধীনতা। সহজ সরল আদিবাসীরা অরণ্য প্রকৃতির কোলে নির্ভয়ে বিচরণ করত। কিন্তু কোম্পানির শাসন বলবৎ হবার পর তাদের সেই সহজ, স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হল, আদিবাসী অঞ্চলের চাষযোগ্য জমি, অরণ্য বিলিব্যবস্থা হয়ে পড়ল, এবং আদিবাসীরা হয়ে পড়ল অপাংক্তেয়। বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার, মালিকরা এসে আদিবাসীদের জমি দখল করে বসল এবং আদিবাসীদের কাছে ‘দিকু’ নামে পরিচিত হল।


শ্বাপদসংকুল অরণ্য পরিষ্কার করে যারা গড়ে তুলেছিল বসতবাড়ি সেই অরণ্যে তাদের কোনো অধিকার রইল না। ফলে তাদের মনে জাগতে লাগল সরকার, দিকুদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ। আক্রোশ, স্বাধীনতা অর্জনে তাই একে একে সংঘটিত হতে থাকে বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহ। যেমন ১৭৮৯ খ্রিঃ মুণ্ডা বিদ্রোহ, ১৮৮৯ খ্রিঃ আদিবাসী বিদ্রোহ, ১৮২০ খ্রিঃ মুণ্ডা বিদ্রোহ, ১৮৩১–৩২ খ্রিঃ কোল বিদ্রোহ ১৮৫৭ খ্রিঃ সাঁওতাল বিদ্রোহ ইত্যাদি। এরপর ১৮৯৫–১৯০০ খ্রিঃ পর্যন্ত সংঘটিত হয় বীরসা বিদ্রোহ। মূলত পূর্বের বিদ্রোহগুলিরও লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অগ্রণি। যদিও বীরসা ধরা পড়ে এবং জেলখানার অকথ্য অত্যাচারে রক্তবমি করে মারা যায় কিন্তু ১৯২৯ খ্রিঃ পর থেকে মুণ্ডাদের জীবনে অনেকটা উন্নতি সাধিত হয়েছিল। এইসময় ইংরাজ সরকার তিন আইন ও পাঁচ আইন চালু করায় মুণ্ডা জীবনে সুস্থিরতা ফিরে এসেছিল। কিন্তু বীরসার বিদ্রোহের পরিসমাপ্তিতে তো বিদ্রোহ থেমে থাকেনি। কারণ আজও ছোটোনাগপুর অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীরা, দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের গোর্খারা, স্বাধীন ভারতের নাগরিক হয়েও নিজেদের ভাষাগত, কিংবা স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে চলেছে। অর্থাৎ কোনো দেশে, কোনো কালে বিদ্রোহ শেষ কথা বলে না। যেমন বীরসার উলগুলান বা গণবিদ্রোহ কালে কালে যুগে যুগে অপরিবর্তিত ধারায় বিরাজ করবে—“উলগুলানের শেষ নাই” এই কথাটির মধ্যে দিয়ে লেখক তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন।


বীরসা তার জাতির কাছে ছিল ধরতি আবা, ভগবান। আজও বীরসার সন্তান যারা ওড়িষা, পশ্চিমবঙ্গ, আসামের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে তারা বীরসাকে ভগবান বলে মানে প্রতিবছর বীরসার জন্মদিন পালন করে। লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী বোধকরি বীরসার বিপ্লবী সত্ত্বায় আপ্লুত হয়েছিলেন। বোধহয় তারই যথাযোগ্য মর্যাদা পোষণে রচনা করলেন তারই জীবনালেখ্য 'অরণ্যের অধিকার । প্রসঙ্গক্রমে অন্যত্র তিনি লিখেছেন—“একটি দিনের কথা বলি, পুরুলিয়াতে খেড়িয়া শবর আদিবাসীদের সম্মেলন সেরে ১৫/১/১৮৮৩ খুব ভোরে বাসে চেপেছি। পুরুলিয়া থেকে মেদিনীপুরের অখ্যাত গ্রাম শালবনী আবোরী যাব। সেখানে মুণ্ডাদের আমন্ত্রণ, বীরসা ভগবানের জন্মদিন পালন করব।” এই প্রবন্ধের শেষাংশে লেখিকা জানিয়েছেন—“পঁচিশ বছর না পুরতে চলে যায় ধরতি আবা, বীরসা মুণ্ডা, কিন্তু দেহ অবসানে তো বিদ্রোহী বীর মরে না।"


অরণ্যের অধিকার জমির অধিকার, 

শোষণ নেই এমন একদিন

এমন একদিন

এসবের জন্য যতদিন আদিবাসী লড়বে

ততদিন উলগুলানের শেষ নেই

ধরতি আবার মরণ নেই।


বীরসার মরণ নেই। ধরতির আবার কি মরণ থাকে? সে যে এই মাটির মানুষের রক্তের। আজ বীরসা নামটি শুধু মুণ্ডাদের নয়, দেশের দেশবাসীর।” অর্থাৎ অধিকার আদায়ে যারা লড়বে ততদিন উলগুলানের শেষ নেই।


সরকারি পুলিশের অত্যাচারে বীরসার মৃত্যু হলে বীরসার সামাজিক সংস্কার না মেনেই বীরসাকে নদীর তীরে দাহ করা হয়েছিল। বীরসার দাহ কার্যে নিযুক্ত ছিল শিবন মেথর, বীরসাকে দাহ করে শিবন ফিরল উন্মাদ অবস্থায়। মুখে কেবল তার একটাই বাক্য স্ফুরিত হচ্ছে—“উলগুলানের শেষ নাই! ভগবানের মরণ নাই!” শিবন উন্মাদ, সমানে বলে চলেছে–“উলগুলানের শেষ নাই! ভগবানের মরণ নাই রে, মুণ্ডারা, আমি জেনে এলাম।” শিবনের পূর্বে ধানী বলেছিল—“উলগুলানের শেষ হয় না। ভগবান মরে না। ভগবান আবার মুণ্ডা হয়ে মুণ্ডা মায়ের কোলে ফিরে আসে।” অধিকার আদায়ে আবার বিদ্রোহে সামিল হয়। ধানীর কোলে শুয়েছিল মৃত্যুমুখী সুনারা। সে ধানীর কাছে জানতে চেয়েছিল তাদের ভগবান মারা গেল উলগুলানের ডাক দিয়ে এখন উলগুলানের কী হবে? উত্তরে ধানী বলে—“উলগুলানের শেষ নাই। ভগবানের মরণ নাই। শিবনের মুখে শুনিস নাই?”


ধরতি আবা হয়ে বীরসা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিল কিন্তু সেই বিদ্রোহ সফল হয়নি। ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর তৎপরতায় এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের অগ্নি নির্বাপিত হয়েছিল। মুণ্ডারা একে একে ধরা দিয়েছিল সরকারের হাতে। বীরসা আত্মগোপন করেছিল অরণ্য, পাহাড়ের গুহায়। বিদ্রোহী ডোনকাকে ধরিয়ে দিয়ে মানী পোহনী পেয়েছিল সরকারের কাছ থেকে কুড়ি টাকা বখশিশ। বীরসা মানী পোহনীর কথামতো সালী ও পরমী সঙ্গিনীকে নিয়ে সেনত্রার জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকে। বীরসার মনে ক্ষোভ যে উলগুলানের ডাক দিয়ে সালীর ছেলে, মরদ সব নিয়েছে পরমীর ও সব নিয়েছে অথচ ওদের জন্য কিছু করে যেতে পারল না। তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল–কতজন নাই, কতজন রবেনা, বুঝি আমার এ শরীর রবেনা। কিন্তু উলগুলানের সফল না হলেও উলগুলানের শেষ নাই। মোর মরণ নাই; অর্থাৎ বীরসা যে আগুন তার জাতির মধ্যে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে তা নেভবার নয়। জেলখানার গারদের মধ্যে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যখন বন্দি মুণ্ডারা মারা গেল তখন বীরসা বিদ্রোহী মুণ্ডাদের উদ্দেশ্যে এমন একটা সত্যবাণী উচ্চারণ করেছিল—“সকল হাতিহার তোমাদের দিয়াছি, চিনায়ে দিয়াছি কে তোমাদের দুশমন। সে হাতিহার তোমরা সঁপে দিও না, একদিন তোমরাই জিতবে।”


বীরসার যে মরণ নেই, উলগুলানের শেষ নেই বহুদিন পর জেলখানার ডাক্তার অমূল্য তা উপলব্ধি করেছিল। বীরসার মৃত্যুর পর ইংরাজ সরকারের প্রতি ঘৃণাবশত সে জেলখানার চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেড়াতে এসেছিল বীরসার আশৈশব বিচরণ ক্ষেত্র ছোটোনাগপুর অঞ্চলের চালকাড়, বোর্তাদি প্রভৃতি স্থানে। সেখানে সাক্ষাৎ হয়েছিল ডোনকার স্ত্রী সালীর সঙ্গে। সালী ছিল বীরসার যুদ্ধের সঙ্গিনী। ছাতিম গাছের নীচে সালী বসেছিল। তার ছেলে পরিবা অদূরেই ধুলা মাখছিল। স্বামী ডোনকা নেই, কী করে তার সংসার চলে ? অমূল্য জানতে চেয়েছিল, সালীর অকপট উত্তর—“ভগবান শিখায়ে দিয়া গেছে উলগুলানের শেষ নাই, ভগবানের মরণ নাই। মুণ্ডার জীবনের কষ্ট ফুরালে তো ভগবানের মরণ উলগুলানের শেষ মেনা নিতে হয়।” উলগুলান সম্পর্কে সালী সার সত্য উচ্চারণ করেছে। জীবনে চাওয়া এবং পাওয়ার যদি মেলবন্ধন ঘটে তাহলে তো অশান্তি ক্রোধ নির্বাসিত হবে, কিন্তু সভ্যতার চোখে তাদের মতো অবহেলিত মুণ্ডা জাতির পক্ষে তা তো কখনোই সম্ভব হবে না। শুধু মুণ্ডা কেন সকল মানুষের ক্ষেত্রে তা সমানভাবে প্রযুক্ত। প্রতিনিয়ত মানুষের মনে অভাব অনটন জমতেই থাকবে আর তা থেকে সৃষ্টি হবে নানা বিদ্রোহের। বিপ্লবের। সালীর কথার অর্থ অমূল্য যথাযথ অনুধাবন করতে পেরেছিল। তাই তার নোটবইয়ের অন্তিমাংশে লিখেছে —“আমরা যেমন চিরকালের সংগ্রাম, বীরসার সংগ্রামও তাই। কিছুই ফুরোয় না পৃথিবীতে—মুণ্ডারী দেশ-মাটি-পাথর-পাহাড়-বন-নদী ঋতুর পর ঋতুর আগমন সংগ্রাম ফুরায় না, শেষ হতে পারে না। পরাজয়ের সংগ্রাম শেষ হয় না। থেকে যায়, কেননা মানুষ থাকে, আমরা থাকি।”