বাংলা কাব্যসাহিত্যে নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭ খ্রীঃ- ১৯০৯ খ্রীঃ)

বাংলা কাব্যে নবীনচন্দ্র সেন


“আমি ‘এডুকেশন গেজেট' লিখিতে আরম্ভ করিবার পূর্বে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র বিষয়ে খণ্ডকবিতা বঙ্গভাষায় ছিল না....... 'অবকাশরঞ্জিনী' বোধ হয় বঙ্গভাষায় এরূপ ভাবের প্রথম খণ্ডকাব্য” (“আমার জীবন' ২য় ভাগ) গীতিকবিতার প্রথম রচয়িতা রূপে এই অভিমানী আত্মভাষণ কবি নবীনচন্দ্র সেনের। ১৮৪৭ খ্রীস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার নয়াপাড়া গ্রামে তার জন্ম। তারপর কলকাতায় আগমন। ১৮৬৮ খ্রীস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ লাভ করেন। সরকারী কাজে প্রতিভার পরিচয় দেন। স্পষ্টবাদী স্বভাবের জন্য উপরওয়ালার দ্বারা নির্যাতন ভোগ করেন। শেষে স্বনামধন্য মতিলাল ঘোষের সংস্পর্শে এসে স্বদেশীয়ানায় উদ্বুদ্ধ হন। কাব্য রচনায় হেমচন্দ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ‘এডুকেশন গেজেট’সহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় কবিতা লিখে খ্যাতিলাভ হয়। এই তিনটি কাব্যকে ঊিনবিংশ শতাব্দীর মহাভরত’ (Mahavarata of the Nineteenth Century) বলা হয়েছে।


নবীন সেনের কবি-পরিচয় বৈচিত্র্যময়। আখ্যানকাব্য মহাকাব্য, খণ্ডকাব্যের কবি, স্বদেশপ্রেমের কবি, রোমান্সরসের কবি, এমনকি ভক্তি বা ধর্মতত্ত্বের কবি পর্যন্ত তা বিস্তৃত হতে পারে। নব-মানবতার আদর্শ ছিল তাঁর উদ্দীষ্ট, অথচ মধ্যযুগীয় ধর্মসংস্কারও ছিল অত্যাজ্য। ফলে নব্য যুক্তিবাদ এবং ভক্তিধর্মের দ্বন্দ্বে তাঁর চিত্ত হয়েছে আলোড়িত। তাঁর মানবতাবাদী অভীপ্সা উনিশ শতকের যুগচেতনারই পরিচায়ক। মহাভারতকে অবলম্বন করে তার মানবধর্মের প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা মহাকাব্য রচনার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়। এই মানবধর্ম প্রতিষ্ঠার সংকল্প বাদে স্বদেশচেতনার তথা স্বাজাত্যবোধের আবেগধর্মী প্রকাশও তাঁর কাব্য-কবিতার মধ্যে দেখা যায়। উপরন্তু প্রাক্-রবীন্দ্রপর্বের গীতিকবিতার যথার্থ হৃদয়াবেগ তাঁর মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তাঁর প্রথম জীবনের কবিতায় বায়রনসুলভ উচ্ছ্বাস ও তেজস্বিতা স্বয়ং ‘সাহিত্যসম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্রকে পর্যন্ত মুগ্ধ করেছিল।


নবীন সেনের কাব্যসমূহ:

‘অবকাশরঞ্জিনী’ (১ম– ১৮৭১, ২য় – ১৮৭৮), ‘পলাশীর যুদ্ধ’ (১৮৭৫), 'ক্লিওপেট্রা' (১৮৭৭), 'রঙ্গমতী' (১৮৮০), ‘খ্ৰীষ্ট' (১৮৯১), 'অমিতাভ’ (১৮৯৫), ‘অমৃতাভ’ (১৯০৯), ত্রয়ী মহাকাব্য—'রৈবতক' (১৮৮৭), ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩), ‘প্রভাস’ (১৮৯৬), চণ্ডী এবং গীতার পদ্যানুবাদ' (১৮৮৯)।


উপন্যাস: ‘ভানুমতী’ (১৯০০) ।


আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ও পত্রসাহিত্য : ‘আমার জীবন’ (৫ খণ্ডে সমাপ্ত- ১৩১৬-১৩২০ বঙ্গাব্দ), ‘প্রবাসের পত্র' (১৮৯২)।


নবীনচন্দ্রের প্রথম কাব্য 'অবকাশরঞ্জিনী' গীতিকাব্যের পর্যায়ভুক্ত। এই কাব্যের দুটি খণ্ড। প্রথম ভাগে ২১টি এবং দ্বিতীয় ভাগে ৪৬টি কবিতা আছে। কবিতাগুলিকে প্রেম প্রকৃতি-স্বদেশপ্রেম-গার্হস্থ্যজীবন এই চারভাগে বিভক্ত করা যায়। তবে প্রথম খণ্ড অপেক্ষা দ্বিতীয় খণ্ডের কবিতাগুলি পরিণত চিন্তা এবং গীতিমূৰ্চ্ছনায় সমৃদ্ধ। রবীন্দ্র-পূর্ববর্তীযুগের রোমান্টিক প্রেমের নৈরাশ্য তার কোন কোন কবিতায় যথার্থই মর্মস্পর্শী :

“নিবুক নিবুক প্রিয়ে     দাও তারে নিবিবারে

আশার প্রদীপ। 

এই তো নিবিতেছিল     কেন তারে উজলিলে

নিবুক সে আলো, আমি ডুবি এই পারাবারে।"


তাঁর স্বদেশপ্রেমের কবিতাগুলির মধ্যে হেমচন্দ্রের ভাবগত প্রেরণা লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কবিস্বভাব গীতিকবির অনুগামী, কিন্তু প্রকাশরীতির শিল্পগুণ থেকে বঞ্চিত। আবেগ ছিল, কিন্তু তাকে বিশ্বগত করে তোলার ক্ষমতা ছিল না। তার ‘পলাশীর যুদ্ধ’ ঐতিহাসিক ঘটনা সমন্বিত আখ্যানকাব্য


নবীন সেনের 'ক্লিওপেট্রা'কে পূর্ণাঙ্গ কাব্য বলা যায় না। এটি একটি দীর্ঘ বিবৃতিমূলক কবিতা মাত্র। কাব্যের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নেই। ভাবকল্পনার তারল্য এবং রচনা শৈথিল্যের জন্য কাব্যের বিষয়বস্তুতে রসস্ফূর্তি ঘটেনি।


পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির রোমান্স ও স্মৃতিতে রঙীন ‘রঙ্গমতী' কাব্য। বিষয়বস্তু ও চরিত্রগুলি কাল্পনিক। বীরেন্দ্র-কুসুমিকার প্রণয়কাহিনী স্কট-অনুসারী রোমান্স বা তার চেয়েও প্রত্যক্ষতর বঙ্কিম-রোমান্স থেকেই উৎসারিত, ব্যক্তি হৃদয়ের সিঞ্চনে উত্তপ্ত। কাব্যটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা। তবে মাইকেলী-অমিত্রাক্ষরের মহিমা, ভাবগাম্ভীর্য ও প্রবহমানতা লক্ষিত হয় না। তার পরবর্তী ত্রি-পর্বিক কাব্যের বীজ এবং সর্বভারতীয় ঐক্যের প্রথম পরিকল্পনা এখানে ভূমিকারূপে ছিল।


কর্মসূত্রে পুরী ও রাজগীরে থাকার অভিজ্ঞতা, ভাগবত-গীতা-মহাভারতের প্রতি মুগ্ধ মনোভাব, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ প্রকাশের আলোড়ন প্রভৃতি ভাবপ্রেরণার ফলশ্রুতি নবীনচন্দ্রের ‘ত্রয়ী’ মহাকাব্য রচনা : ‘রৈবতক কুরুক্ষেত্র—প্রভাস’। তিনটি কাব্যের একাত্ম ভাবনার সতর্ক নির্দেশ ভূমিকাতেই আছে “রৈবতক না পড়িলে কুরুক্ষেত্রের সম্যক কাব্যের উপলব্ধি হইবে না’”—‘কুরুক্ষেত্র’।


“রৈবতক কাব্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদিলীলা, কুরুক্ষেত্রের কাব্য মধ্যলীলা এবং প্রভাস কাব্য অন্তিমলীলা লইয়া রচিত। রৈবতকে কাব্যের উন্মেষ, কুরুক্ষেত্র বিকাশ এবং প্রভাসে শেষ।”—‘প্রভাস’।


আর্য-জাগৃতি বা নব্য-হিন্দু-জাগৃতির আদর্শ স্থাপন ছিল কবির লক্ষ্য। এই আর্য জাগৃতি মূলতঃ ভক্তিকেন্দ্রিক, তবে তার মধ্যে ধর্ম, বিজ্ঞানদৃষ্টি এবং ঐতিহাসিক মানসিকতার প্রতিফলন দুর্লভ নয়।


কৃষ্ণের অন্যমনস্কতা এবং দুর্বাসার ক্রোধে ‘রৈবতকে’র কাহিনী আরম্ভ, অনার্যরাজ বাসুকির সঙ্গে ষড়যন্ত্রে কাহিনীর অগ্রগতি। সুভদ্রাহরণে কাহিনীর উপসংহার। অন্যদিকে মহাযুদ্ধে ভীষ্মের পতনের পর ‘কুরুক্ষেত্র’ কাব্যের কাহিনী-সূচনা। উত্তরার বাহুপাশ ছিন্ন করে অভিমন্যুর যুদ্ধযাত্রায় এবং জরৎকারু-বাসুকি ও দুর্বাসার মন্ত্রণায় কাহিনীর মধ্যে কৌতূহল সঞ্চার। অভিমন্যুর মৃত্যু এবং তার চিতাগ্নির দীপ্তশিখায় মহাভারতের আভাসে কাহিনীর অবসান ঘটে। আবার, কৃষ্ণের লীলা সংবরণের আভাসে ‘প্রভাসে’র কাহিনীর শুরু, যাদবগণের আত্মকলহ, যদুকুল ধ্বংস, কৃষ্ণের মহাপ্রয়াণ ইত্যাদি ঘটনা বর্ণনায় কাহিনীর অগ্রগতি। শ্রীক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় কাব্যটির সমাপ্তি ঘটে। এইভাবে দেখা যায়, ‘রৈবতক’ বিংশ সর্গে, 'কুরুক্ষেত্র' সপ্তদশ সর্গে এবং ‘প্রভাস' ত্রয়োদশ সর্গে বিন্যস্ত হয়েছে। কৃষ্ণের ভূমিকায় মানবমহিমার বাণী বিঘোষিত

“মানব চেতনাযুক্ত, বিবেকী, স্বাধীন, 

জড় ওই সূর্য হতে কত শ্রেষ্ঠতর। 

মানব! উৎকৃষ্ট সৃষ্ট, যে অনন্ত জ্ঞানে

সৃষ্ট ও চালিত ওই বিশ্ব চরাচর।

পড়েছে সে জ্ঞান-ছায়া হৃদয়ে তাহার।”


শরশয্যাশায়ী ভীষ্মও বলেছেন

“মানব! মানব তুমি। তুমিও মানব’

দেবতার ঊর্ধ্বে তবে মানবের স্থান।”


এই ত্রয়ীর নায়ক কৃষ্ণ অর্জুনের বীর্য, ব্যাসের প্রজ্ঞা, সুভদ্রার প্রীতি ও শৈলজার সংরাগের সহযোগে কবি আবার মানবতাবাদের মহামন্ত্রে “খণ্ড এ ভারতে মহাভারত স্থাপিত” করার ব্রতে প্রবুদ্ধ হয়েছেন। এই তিনটি কাব্যকে 'ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাভারত' (Mahavarata of the Nineteenth Century) বলা হয়েছে।


এই কাব্যত্রয়ের বিষয়বস্তু মহাকব্যোচিত মহৎ ও প্রশস্ত। কিন্তু আখ্যান পরিকল্পনায় এবং রচনায় তার পরিচয় বিরলদৃষ্ট। এই তিনটি কাব্যের ত্রুটি হল (ক) দীর্ঘ পরিসরে কাহিনী বিন্যাসে সংযোগ রক্ষার অভাব। কাব্যের ঘটনা বা বিষয়বস্তুর মধ্যে confor-mity নেই। আবেগের অতিবাদিতায় কাহিনীর মধ্যে অসংযমের প্রকাশ দেখা যায় (খ) কৃষ্ণ, অর্জুন, ব্যাসদেব চরিত্রগুলির মধ্যে বাস্তবতা অপেক্ষা দার্শনিক তত্ত্বের প্রাধান্য দেখা যায়। দুর্বাসাও নিছক পাষণ্ড চরিত্র মাত্র। (গ) অভিমন্যু-উত্তরা-সুলোচনার তরল-চপল আচরণ, বাঙালী পরিবার সুলভ সোহাগ মান-অভিমানের আতিশয্য মহাকাব্য ও আখ্যানকাব্যের মহিমা ক্ষুণ্ণ করেছে।


এছাড়া কৃষ্ণের স্বপ্নবিলাস, অর্জুনের প্রেমপিপাসা, দুর্বাসার ক্রোধদীপ্তির ম্লানিমা চরিত্রগুলির মর্যাদাহানি করেছে। ফলে এই তিনটি কাব্যের মধ্যে কোথাও কবি-প্রতিভার স্ফূর্তি বা দীপ্তি চোখে পড়ে না। রোমান্টিকতা ও লিরিক মাধুর্য হয়ত আছে, কিন্তু মহাকাব্যের মহত্ত্ব ও গাম্ভীর্য, চরিত্র পরিকল্পনার ঔদার্য, রচনারীতির ক্লাসিক সংযম আয়ত্ত করা ভাবপ্রবণ কবি নবীনচন্দ্রের পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল। তার লিরিক উচ্ছ্বাসের অসংগতির একটি দৃষ্টান্ত : রৈবতকে কুড়ি সর্গের মধ্যে দশটি সর্গ জুড়ে সুভদ্রা, শৈল, জরৎকারু, রুক্মিণী ও সত্যভামার পূর্বরাগের বিবরণদান। এই আতিশয্য লক্ষ্য করে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল লিখেছিলেন: "The simple truth is that ten of the twenty books must be lopped off,' if the 'Raivataka' is to take a place among the great epics of Bengal" (New Essays in Criticism' pp 95-96)। আবার ‘কুরুক্ষেত্রে’র উত্তরা-অভিমন্যুর কাহিনীতেও এই অসংগতি আছে।


নবীনচন্দ্রের ‘খ্রীষ্ট’, ‘অমিতাভ’ এবং ‘অমৃতাভ’ জীবনীকাব্যের শ্রেণীভুক্ত। এর মধ্যে প্রথমটি Gospel of St. Mathew-র অবলম্বনে যীশুর, দ্বিতীয়টির আশ্রয় ভগবান বুদ্ধদেবের জীবন, তৃতীয়টির বিষয় শ্রীচৈতন্যের জীবন। এই কাব্যগুলি রচনার উদ্দেশ্য ছিল, “আর্যধর্মাবলম্বীদের কাছে অবতার স্বরূপে পূজনীয়” (‘খ্রীস্ট’ কাব্যের ভূমিকা) ব্যক্তিবর্গের পার্থিব জীবন-বর্ণনা এবং জাতীয় জীবনে সুউচ্চ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা।


নবীনচন্দ্রের লেখা 'ভানুমতী' উপন্যাসখানি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত। বাস্তবতা ও কল্পনার সংমিশ্রণে রোমান্সমূলক ইতিবৃত্তই এর মুখ্য আকর্ষণীয় বিষয়। তাঁর লিখিত ‘আমার জীবন’ উনিশ শতকের বিচিত্র ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যে পূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ আত্মজীবনী। প্রমথ চৌধুরী বইটির পরিচয় দিয়েছিলেন এইভাবে : “এই বইখানি সেন মহাশয়ের জীবনচরিত হলেও একখানি নভেল বিশেষ। আর সেন মহাশয় হচ্ছেন এ নভেলের একমাত্র নায়ক” (উদ্ধৃত, গ্রন্থ দ্রষ্টব্য : 'বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য’, পৃষ্ঠা ৩৪৯)।


নবীনচন্দ্রের ৬১ থেকে ৮৮ বৎসর বয়স পর্যন্ত জীবনের ঘটনাসমূহ এখানে বর্ণিত। এই গ্রন্থের কাহিনী যেমন উপন্যাসের মতো মনোরম, তেমনি ভূগোল-নির্ভর নিসর্গের বর্ণনা, অকপট আত্মবিশ্লেষণ এই গ্রন্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্ত্রীর উদ্দেশে লেখা ‘প্রবাসের পত্র’ একদিকে যেমন আপন হৃদয়ের অনুভব-অভিজ্ঞতার কাহিনী, তেমনি দেশ-পর্যটনের নির্দেশিকা। মহাকবির যোগ্য প্রতিভা না হোক গীতিকবি এবং অনুভূতিপ্রবণ সংবেদী মনের পরিচয়ে নবীনচন্দ্রের সচেতন ব্যক্তিত্ব কোনমতেই বিস্মৃত হওয়ার নয়।