বেঙ্গল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা ও অভিনীত নাটকগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বেঙ্গল থিয়েটার

নানা কারণে ন্যাশানাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাবার কয়েক মাসের মধ্যেই ‘বেঙ্গল থিয়েটার' প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯ নং বিডন স্ট্রিটের বিখ্যাত ধনী সতুবাবুর বাড়ির সামনের মাঠে ৫ হাজার টাকার অধিক ব্যয়ে এই থিয়েটার বাড়ি তৈরি হয়। তখনকার কলকাতায় চালু ‘লাইসেয়াম’ থিয়েটারের অনুকরণে এই নাট্যশালাটি তৈরি হয়। ম্যানেজার হলেন সতুবাবুর দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ। অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন প্যারীমোহন রায়। নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন ও উমেশচন্দ্র দত্ত, হরিবৈব, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দেবেন্দ্রনাথ মিত্র, অক্ষয়কুমার মজুমদার প্রমুখ।


'বেঙ্গল থিয়েটার' অভিনয় শুরু করলো মধুসূদনের 'শর্মিষ্ঠা' নাটক দিয়ে। ১৮৭৩-র ১৬ আগস্ট, অভিনয় করলেন যযাতি শরৎচন্দ্র, শুক্রাচার্য বিহারীলাল, দেবযানী– এলোকেশী। দেবিকা—জগত্তারিণী। প্রথম অভিনয় থেকেই বেঙ্গল থিয়েটার মঞ্চে অভিনেত্রী গ্রহণ করল। প্রথমে চারজন অভিনেত্রী নেওয়া হয় শ্যামা, জগত্তারিণী, এলোকেশী ও গোলাপ পরে আরও অভিনেত্রী নেওয়া হয়। মঞ্চে অভিনেত্রী গৃহীত হলে সমাজে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বেঙ্গল থিয়েটার বারাঙ্গনা পল্লি থেকে এই অভিনেত্রীদের জোগাড় করে। তাতেই সমাজপতিদের দুশ্চিন্তার মাত্রা বেড়ে যায়। এর বিরুদ্ধাচরণ করতে নানা সংবাদপত্রে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু অভিনেত্রীদের মঞ্চ থেকে বিদায় করা যায়নি। বাংলা মঞ্চে অভিনেত্রীরা পাকাপাকিভাবে নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলো। মধুসূদনের এ ব্যাপারে উৎসাহ থাকলেও, বিদ্যাসাগর কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।


প্রায় দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার গৌরবের সঙ্গে তার অভিনয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। প্রথম দিকে শরৎচন্দ্র এবং দ্বিতীয় অংশে বিহারীলাল এই দুই কাণ্ডারির নেতৃত্বে বেঙ্গল থিয়েটার বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছে। ১৯ শতকের শেষ দশক থেকে বেঙ্গলের অবস্থার অবনতি হয়। শরত্চন্দ্রের মৃত্যুর পর আর্থিক দায়-দায়িত্ব বিষয়টি প্রাধান্য পায়। ওই সময় দেখা মিলল ভালো নাটকের। তেমনি খ্যাতিমান অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা বেঙ্গল ছেড়ে চলে যেতে থাকে। বিহারীলাল একা কতদিক সামলাবেন। এছাড়া যে জমিতে বেঙ্গলের পাকা থিয়েটার বাড়ি তৈরি হয়েছিল সেই জমি নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়। শরৎচন্দ্র বিহনে বেঙ্গল সেই দায় সামাল দিতে পারেনি। তার ওপরে দলের ভেতরেই আত্মকলহ ও বিবাদ বেঙ্গলের পতনকে ত্বরান্বিত করে। বিহারীলাল একা সবদিক সামাল দিতে পারছিলেন না। একদিকে অভিনয়ের জন্য নাটক রচনা, নিজে অভিনয় করা, এবং অভিনয় শিক্ষাদান করা, তার ওপরে দলের নানা গোলমাল, নটনটী জোগাড় করা, আর্থিক দায়, জমির বিবাদ, ভালো অভিনেতা অভিনেত্রীর অভাব সব মিলিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার ১৯ শতকের শেষের দশ বছর বেশ কাহিল হয়ে পড়ে। অবশেষে, ১৯০১-এর ২০ এপ্রিল বিহারীলালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বেঙ্গল থিয়েটারের পাদপ্রদীপের আলো নির্বাপিত হয়ে যায়।


বেঙ্গল থিয়েটারের অবদান :

১। বাঙালির থিয়েটারে প্রথম নিজস্ব স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহ বেঙ্গল থিয়েটার থেকেই শুরু। ২। প্রথম যথার্থ সাধারণ রঙ্গালয় এবং পেশাদারি থিয়েটার এই বেঙ্গল থিয়েটার। ৩। ১৮ জন সদস্যের টাকা নিয়ে শেয়ার ভিত্তিক থিয়েটার পরিচালনা শুরু করে বেঙ্গলই প্রথম।৪। থিয়েটার পরিচালনার যৌথ দায়িত্ব বেঙ্গলই প্রথম তৈরি করে। ৫। সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রথম অভিনেত্রী গ্রহণ করে বেঙ্গল থিয়েটার অভিনব ও দুঃসাহসিক কাজ করছিল। ৬। বেঙ্গলের স্থায়ী মঞ্চ তৈরিতে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই স্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে অভিনয় প্রচেষ্টা শুরু করেন। ৭। বিদেশি থিয়েটারের মডেলে রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে বেঙ্গল থিয়েটার বাংলা বিলিতি রঙ্গমঞ্চের স্থায়ী প্রতিষ্ঠার সূচনা করে। ৮। সে যুগের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত করে প্রচুর জনসমর্থন পেয়েছিল। ৯। বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠার কাল থেকেই বঙ্কিমের উপন্যাসগুলি প্রকাশ পেতে থাকে। ১০। নাট্যকার হিসাবে বিহারীলাল, রাজকৃষ্ণ রায়, উপেন্দ্রনাথ দাস, অমৃতলাল বসু এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইত্যাদি।


সবমিলিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার প্রায় ত্রিশ বছর ধরে বাংলা নাট্যাভিনয়ের ধারাবাহিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল। সমসাময়িক ও পরবর্তী থিয়েটারের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছে বেঙ্গল থিয়েটার।