‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগী চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

পৃথিবীর নিপীড়িত, অত্যাচারিত মানবগোষ্ঠীর মধ্যে চেতনা সঞ্চারিত করা এবং তাদের উদ্বোধিত করাই ছিল ধনঞ্জয় বৈরাগীর মূল আদর্শ। সে বিজিত অত্যাচারিত জাতির আত্মিক প্রতীক। এ সম্পর্কে সমালোচক কনক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত— ”ধনঞ্জয় বৈরাগী অত্যাচারিত জাতির অপরাজেয় আত্মার প্রতীক। আত্মার শক্তি যে অত্যাচার অপমানে নিঃশেষিত বা নিষ্পেষিত হইবার নয় তাহা প্রমাণ করিয়াছেন ধনঞ্জয়। তিনি সত্যের পূজারি, আনন্দময় পুরুষ, কল্যাণকে প্রতিষ্ঠিত করিবার দুরস্ত আকাঙ্ক্ষা তাহার মনের গভীরে। ধনঞ্জয় নির্ভীকতা ও সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি। রাজশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে অসহায় দরিদ্র মূক প্রজার মুখপাত্র— তাহাদের অনুপ্রেরণা। নিপীড়িত জাতির মুক্তি সাধন তাঁহার লক্ষ্য এবং নৈতিক শক্তির ওপর নির্ভর করিয়া সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার সাধনা তিনি করিয়াছেন। অহিংসা প্রতিরোধের ভিতর দিয়া তিনি অসহায় নিপীড়িত জনগণকে মুক্তিস্বর্গের দিকে চালিত করিতে চাহিয়াছেন।"


মূলত, আত্মার শক্তি জড় শক্তি নয়। শারীরিক বল বা যন্ত্রের শক্তি নয়—সে শক্তি বৃহত্তর নীতির শক্তি। শত অত্যাচার শত অপমান অন্তরাত্মাকে নিষ্পেষিত করতে পারে না। অত্যাচার হয় দেহী মানুষের ওপরে, তার অন্তর থাকে অক্ষত। ধনঞ্জয়ের প্রকাশ সত্যের মধ্যে—সত্য ভাষণে, সত্য চিন্তা ও কল্যাণ কর্মে। ধনঞ্জয় সমগ্র অত্যাচারিত জাতির অন্তরাত্মাকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেছে, আর তার এই সংগ্রাম শুরু হয়েছে বৃহত্তর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তির দ্বারা। তার সংগ্রাম স্থূল ও জড়ের সঙ্গে সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয় শক্তির, হিংসার সঙ্গে অহিংসার।


ধনঞ্জয় অত্যাচারিত হয়েও জড়শক্তির, দৈহিক বলের আশ্রয় নেয়নি, নির্ভয়ে সত্য কথা বলেছে, মানুষের অন্তরতম সত্তার কাছেও সে আবেদন জানিয়েছে, ন্যায়নীতি ধর্মের দোহাই দিয়েছে। সে তার অনুচরদের কাছে, রাজার কাছে নীতি ব্যাখ্যা করে বলেছে—“জগৎটা বাণীময় রে। তার যেদিকটাতে শোনা বন্ধ করবি সেই দিক থেকেই মৃত্যুবাণ আসবে। এ সম্পর্কে রবীন্দ্র সমালোচক প্রমথনাথ বিশীর অভিমত–“ধনঞ্জয় মারখানেওয়ালার ভিতরকার মানুষ। সে বলে আমি মারের দ্বারা মারকে জয়ের চেষ্টা করি না, আমি মারকে ছাড়াইয়া উঠিয়া মারকে জয় করি।”


রাজার সঙ্গে ধনঞ্জয় বৈরাগীর বিরোধ অহিংস সংগ্রামের, সত্যের যুদ্ধের, আত্মিক শক্তির দ্বারা ন্যায়বোধ ও মনুষ্যত্ব উদ্বোধনের চেষ্টায়। সমস্ত তত্ত্ব না জেনেও প্রেমের আবেগে কর্মক্ষেত্রে নেমে অভিজিৎ ধনঞ্জয় বৈরাগীর আদর্শকেই অনুসরণ করেছে। ধনঞ্জয় বৈরাগী এবং অভিজিৎ উভয়ের মিলনে ঘটেছে পূর্ণতা। একজন আছে জ্ঞানের পথে আর একজন আছে কর্মের পথে। যখন আঘাত নেমে আসে তখন ধনঞ্জয় বৈরাগী গান গেয়ে ওঠে—“আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে।” কিন্তু শুধু দুঃখ দিনের রক্তকমল নিয়ে মারের সাগর পাড়ি দিলেই চলবে না, বিশ্বাস থাকা চাই।–“পথ আমারে সে দেখবে যে আমারে চায়।” পথ তিনি দেখিয়ে দেন সত্য, কিন্তু তার জন্য মানুষকেও কর্তব্য করতে হয়। সে নিজে কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করে না তাকে পথ দেখাবার দায়িত্ব কারোর নেই—“আমি অভয় মনে ছাড়বো তরী এই শুধু মোর দায়।"


ধনঞ্জয় বৈরাগীর আগমন হয়নি কোনো বিশেষ নাটকীয় মুহূর্তে। অভিজিৎ যে পথে চলেছে সেই পথকে মহান রূপ দেবার জন্যই ধনঞ্জয় বৈরাগীর আগমন অভিজিৎ অভয় মনে তার তরী ছেড়ে দিয়ে দায় পালন করেছে, এরপর বন্দিশালায় উভয়ের মিলন। সেই মিলনের পরেই বন্দিশালায় আগুন লেগেছে। মুক্ত অভিজিৎ বাইরে এসে উচ্চারণ করেছে, “আমাকে আজ কিছুতেই বাঁধতে পারবে না। না ক্রোধে না স্নেহে।” অভিজিৎ সম্ভবত ধনঞ্জয়ের সংস্পর্শে এসে এই বিপুল জ্ঞানলাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন নাটকে যে বৈরাগী জাতীয় চরিত্র অঙ্কন করেছেন ধনঞ্জয় বৈরাগী তারই অন্যতম প্রতিরূপ। রবীন্দ্রনাথের গভীর বিশ্বাস যেন এখানে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।


অভিজিৎ এবং ধনঞ্জয় উভয়েই সাধারণ মানুষের মধ্যে কর্মক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছে। প্রত্যেক মানুষ এক গভীর বিশ্বাসের দ্বারা চালিত হয় এবং আত্মিক জগৎ ও জড়জগৎ উভয় ক্ষেত্রেই তাদের সৃষ্টির বেদনা সহ্য করতে হয়। আর সেই বেদনা যখন সবচেয়ে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে তখনই তার সময় আসে। রবীন্দ্রনাথ যে মানবাত্মাকে জ্ঞানে, কর্মে এবং প্রেমে জাগ্রত করতে চেয়েছেন এই নাটকে অভিজিৎ ও ধনঞ্জয়ের মিলনে তাই সার্থকভাবে সমন্বিত। আকাশে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জেগেছে, কিন্তু ভিতরের মুক্তি কী তা সাধারণের বোধগম্য হয়নি। এই জাগরণের জন্য মহৎ প্রাণের বলি চাই। অভিজিৎ সেই মৃত্যুকে বরণ করে মানুষের আত্মউদ্বোধন ঘটিয়েছে আর ধনঞ্জয় তাকে চেতনার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে।


পরাধীন ভারতের অহিংসা স্বাধীনতা সংগ্রামী মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে ধনঞ্জয় বৈরাগীর চরিত্রের বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে প্রথম এই জাতীয় সত্যদর্শী সিদ্ধ সাধক পরমভক্ত, আনন্দময় পুরুষকে পাওয়া যায় এবং 'মুক্তধারা' নাটক পর্যন্ত এই জাতীয় চরিত্রের ধনঞ্জয় বৈরাগীর রূপ ধরে অপরিস্লান যাত্রা। ধনঞ্জয় বৈরাগীর অনেক উক্তিতে পরাধীন ভারতের মনোবেদনা, যন্ত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা প্রভৃতি প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিকে যারা দেবতা তৈরি করতে চায় ধনঞ্জয় তাদের দুর্বলতাকে নিন্দে করেছে, পরনির্ভরশীল অনুচরদের ভর্ৎর্সনা করেছে। ধনঞ্জয়ের এই সমস্ত উক্তিতে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মতের ছায়াপাত ঘটেছে।


সবমিলিয়ে, যন্ত্রবিজ্ঞান মানুষের বৈজ্ঞানিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ দান হলেও সেই যন্ত্র মানুষের ওপর আধিপত্য স্থাপন করেছে এবং যেন অভিসম্পাতরূপে পরিগণিত হয়েছে। ধনঞ্জয় বৈরাগী যন্ত্রের সেই প্রমত্ততাকে জীবনে গ্রহণ করেনি আর এইখানেই রবীন্দ্রনাথ এবং ধনঞ্জয় বৈরাগী যেন অবিচ্ছেদ্য সত্তায় পরিণত হয়েছে। মূলত, রবীন্দ্র সাহিত্যে ধনঞ্জয় বৈরাগী বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে।