একরাত্রির গল্পের রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব প্রেমভাবনা কীভাবে রূপায়িত হয়েছে, তা আলোচনা করে দেখাও।

লিরিকধর্মী গল্প একরাত্রি। এর নায়ক ও নায়িকা সুরবালার অতি শৈশবে বর-বউ খেলত। উভয় পক্ষের অভিভাবকদের কল্পনানেত্রে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের একটা মিলনমান্দের ছবি আপনা থেকেই গড়ে উঠেছিল। অভিভাবকদের প্রশ্রয়েই নায়কের মনে সুরবালার ওপর একটা অধিকার বোধ অতি শৈশবেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু কৈশোর ও তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে নায়কের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রামীণ জীবনের ও সুরবালার পরিমণ্ডল অতিক্রম করে শহরাশ্রয়ী হয়ে উঠল। কলকাতায় পৌঁছে দেশসেবার কাজে আত্মনিবেদন করে পরিপূর্ণভাবেই ভুলে গেল তার মর্মসহচরী সুরবালাকে।


এমনকি সুরবালার সাথে তার বিবাহ সম্বন্ধ সে বিনা দ্বিধায় কেটে দেওয়ায় সুরবালার বিবাহ হয় গ্রামের উকিল রামলোচন বাবুর সঙ্গে। এরপরেই শুরু নায়কের ভাগ্য বিপর্যয়। পিতার মৃত্যুর বাস্তবের নগ্নমূর্তির প্রচণ্ড আঘাতে বেসামাল হয়ে মফস্সলের একটি ছোটো স্কুলে সেকেন্ড মাস্টারির চাকরি গ্রহণ করতে বাধ্য হয় সে। কিন্তু নায়কের মনে সুরবালা মৃত নয়, সে ছিল ভীষণভাবে জীবিত। নায়কের শৈশব স্মৃতির মগ্নচৈতন্যে তার উপস্থিতি দিব্যলোকের মতই স্পষ্ট ও উজ্জ্বল। মগ্ন চৈতন্যের আবরণ সেদিন উন্মুক্ত হয় যেদিন নায়ক রামলোচনবাবুর বাড়িতে তার সাথে দেখা করতে গিয়ে অনুভব করে সুরবালার উপস্থিতিকে।


মনের ক্যানভ্যাসে ফুটে ওঠে সুরবালার চিত্র, সাথে সাথে চলতে থাকে হৃদয়ের যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা আপন কৃতকর্মের—আপন অবিমৃশ্য কারিতার। এ যন্ত্রণা অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মতই বাড়ে কমে কিন্তু থামে না। শৈশব স্মৃতির ওপর তারুণ্যের চঞ্চলতা যে বিচ্ছেদ টেনে দিয়েছে মধ্য যৌবনের নিঃসঙ্গতায় সেই শৈশব স্মৃতি মগ্নচৈতন্যের গভীর থেকে ফিরে এল। এর থেকে নায়কের মুক্তি নেই। গল্পের অন্তিম পর্যায়ে নায়কের এই ব্যর্থ জীবনের হতাশা, অশান্ত অনুশোচনা সবই অন্তর্হিত হয়েছে। মহাপ্রলয়ের সন্ধিক্ষণে সব আত্মার একত্র সমাবেশ হয়ে উঠেছে গভীর ব্যঞ্জনাধর্মী। এই মৃত্যুরূপী মহাপ্রলয়ের মধ্যে জীবনের শ্বাশ্বত রূপকে প্রত্যক্ষ করে নায়ক উপনীত হয়েছে চৈতন্যের শীর্ষ সীমায়।


দেহ তৃষ্ণার অতীতে কামনা বাসনার সীমিত গন্ডির বাইরে আপাতদৃষ্টিতে কিছু না পাবার বেদনার ঊর্ধ্বে সব পাওয়ার। এক অনিবচনীয় আনন্দে নায়িকার শূন্যভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে উঠেছে। সুরবালা থাক তার স্বামী পুত্র নিয়ে, নায়ক অপেক্ষা করুক শ্বাশ্বত অনন্ত জীবনে তার নায়িকার জন্য। ধরার ধুলার খেলা শেষ করে সুরবালা আবার তার কাছে ফিরে আসবে। এ অধিকার সুরবালার দেহের ওপর পর, তার আত্মার ওপর। রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রেম চেতনা কিছুটা অধ্যাত্মবাদী। নায়ক ও সুরবালার প্রেম সম্পর্কও অধ্যাত্মবাদে পরিণত হয়েছে।