‘অন্তরের জিনিসকে বাহিরের ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।

‘Expression for the artist is communication' এই যে প্রকাশ করবার ক্ষমতা, তার উদ্দেশ্য হল শিল্পী মানসের ভাব এবং অভিজ্ঞতা অপরের মনে সঞ্চারিত করে দেওয়া। শিল্পী তার অনুভূতিকে বাহিরের রূপ সৃষ্টির মাধ্যমে রসাস্বাদনের উপযোগী করে তোলেন। কবি তাঁর কবিতায় বিশেষ রূপকল্পের মধ্য দিয়ে তা সার্থক করেন আর যিনি চিত্রকর তিনি চিত্র প্রকাশ করে থাকনে। কাব্যের সঙ্গে চিত্রের এইখানে সাদৃশ্য যে উভয়ে বাস্তবের অনুকরণ না করে শিল্পীর মানস জগতের চিন্তা ও অনুভূতিকে বাস্তব জগতের উপর প্রতিফলিত করেন। চিত্রে যখন একটি মুহূর্তের পরিচয় আমরা পাই তখন তা ফটোগ্রাফারের ন্যায় একটি বিশেষ ক্ষণকে অবরুদ্ধ করে না। চিরকালীন রূপবতীকে আভাসিত করে। কাব্যে ও চিত্রে যে মানুষের পরিচয় থাকে তার সমগ্র রূপের ব্যঞ্জনা প্রকাশের দিকে শিল্পীর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। তথাপি প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে সংগীত অথবা চিত্রকলায় সৌন্দর্য বিদেশিগণও উপলব্ধি করতে পারেন। কবিতার সৌন্দর্য যেন বিশেষ ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ।


কবি যা অন্তরে উপলব্ধি করেন তা তিনি বাইরে প্রকাশ করেন। এই প্রকাশ করবার উপায় হল তার ভাষা। কিন্তু যেহেতু এই ভাষার মাধ্যমে ভাবকে সংবেদনশীল পাঠকমনে সঞ্চার করে দিতে হয়, তার জন্য এই ভাষা হয়ে ওঠে কবিভাষা। যে কবিভাষা কবির অন্তরের প্রগাঢ় অনুভূতিকে ব্যক্ত করবে তা তার অন্তরের ভাষা। এই ভাষাকে রূপের ও সুরের ভাষা নামে অভিহিত করা যায়। অধ্যাত্ম জীবনে সাধক যা উপলব্ধিকে তিনি প্রকাশ করতে চান না। কিন্তু কবি সাহিত্যিকরা যা উপলব্ধি করেন তা প্রকাশ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং তার অপূর্ব নির্মাণ অক্ষম প্রজ্ঞায় তিনি তাকে ভাষা দেন। 'সেই আমির গহনে জ্বলে উঠল আলো’ ফুটে উঠল রূপ—স্রষ্টা সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মার মতো, মিলন ঘটালেন প্রজাপতি সদৃশ—রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যের বিচারক প্রবন্ধে এই কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।


বাল্মীকি যেদিন ক্রৌঞ্চীর দুঃখ হৃদয়ে অনুভব করেছিলেন সেদিন তাঁর শোকতন্ত্রী শ্লোক তন্ত্রীতে পরিণত হয়েছিল। তাই আদিম কবিতারূপে পরিচিত।


সাধারণ একজন মানুষ যা উপলব্ধি করেন তা প্রকাশ করতে পারেনা। এই অপ্রকাশের দৈন্যতার হৃদয়কে মথিত করে আর কবি সে অব্যক্ত ভাব ও ভাবনার প্রতিনিধি।


‘পুরস্কার’ নামক কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ কবির উক্তিতে বলেছেন—

‘না পারে বুঝতে, আপনি না বুঝে

মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে,

কোকিল যেমন পঞ্চম কূজনে

মাগিছে তেমনি সুর ;

কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা

কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,

বিদায়ের আগে দু'চারিটি কথা

রেখে যাব সু-মধুর


যে ভাবকে কবি ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন তা তার অন্তরের উপলব্ধ গভীর সত্য। যা সত্য তাই সৌন্দর্য। অপরপক্ষে যে সৌন্দর্য কবি হৃদয়ে উপলব্ধি করে থাকেন, তার সঙ্গে সত্যের গভীর সম্পৃক্ত নয়। এই হৃদয়ের ভাব বা অনুভূতি অন্তরের জিনিস, তা লৌকিক জ্ঞানের ন্যায় প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। ভাব এক অন্তর হতে অন্য অন্তরে সঞ্চারিত করার অভিপ্রায়ে কবি কাব্য সৃষ্টি করে থাকেন। এর উদ্দেশ্য হল পাঠককে আনন্দ দান করা। এই আনন্দ অহেতুকী, অলৌকিক, অবাঙ মানসগোচর, বাকপথাতীত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—

“ভাষার অতীত তীরে

কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে।”


সম্ভোগ এই অলৌকিক আনন্দের অধিকারী যিনি, তিনি কবি সাধক। সংসারের অনায়াস লব্ধ সুখ ও সম্ভোগ পরিহার করে তার জন্য তপস্যা করতে হয়।

“অলৌকিক আনন্দের ভার 

বিধাতা যাহারে দেয় বক্ষে তার বেদনা অপার

তার নিত্য জাগরণ "


ভাষার মাধ্যমে ভাব সর্বত্র স্পষ্ট করে প্রকাশিত হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা ও কুয়াশা থাকে। ভবভূতি লিখেছেন যে সীতার স্পর্শে সুখে আকুল রামচন্দ্র বলেছিলেন ‘সুখমিতি বা দুঃখমিতি’ এখানে ভাবের আবেগ হেতু ভাষা স্বাভাবিক রূপে অস্পষ্ট হয়েছে। বলারাম যেখানে লিখেছেন—

"আধ চরণে, আধ মুধুর হাসে"-তলায়


ভাবুকের মনে চরণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাষা সুস্পষ্ট হলে তা সম্ভব হত না। এই কারণে কবিতার অর্থ সর্বত্র পরিস্ফুট হলে তা ভাবের চরণে সীমা চিহ্নিত করে।


সাহিত্যের আদিম সত্য হচ্ছে প্রকাশ মাত্র, কিন্তু তার পরিণাম সত্য হচ্ছে, ইন্দ্রিয়মন এবং আত্মার সমষ্টিগত মানুষকে প্রকাশ যা কবির নিতান্ত একলার বস্তু। যে অনুভূতি ও‌ অভিজ্ঞতা তিনি উপলব্ধি করেছেন তা আপনার হৃদয়ে অবরুদ্ধ না রেখে তা সকলের জন্য তিনি প্রকাশ করে থাকেন।


যা ক্ষণকালের জিনিস তাকে কবি বা সাহিত্যিক চিরকালের সামগ্রী করে তোলেন। সাহিত্য স্রষ্টা যা রচনা করেন তা নিছক সাম্প্রতিককালের জন্য নয়, চিরকালের মনুষ্য সমাজকে লক্ষ্য করে তিনি সৃষ্টি করে থাকেন। তিনি যা সৃষ্টি করলেন, তা সেকালের কিছু সংবেদনশীল রসজ্ঞ ব্যক্তি গ্রহণ করেন, কিন্তু তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কাল নিরবধি শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, শ্রেষ্ঠ গতিকে কালের প্রবাহমান গতিকে উপেক্ষা করে তার বার্তা অমর করে রাখে। জনমানবের চিত্তে ভবিষ্যৎকালে একটা আবেদন সৃষ্টি করেন। ভারতচন্দ্রের কবিতা শব্দ, সংগীত ও শব্দের গুণে একদা জনপ্রিয় ছিল কিন্তু এখন তা নেই। ইংরেজি কাব্যে পোপের সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য করা চলে। কিন্তু সত্যিকার রসসৃষ্টি কবিতা অক্ষয় অমর তা বিশ্বমানবের তা চিরকালের। যে গুণে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, কীটস্ প্রভৃতি কবি প্রাচ্য সাহিত্যে কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি কবিরা অমর হয়ে আছেন। তাদের কাব্য সভ্যতার উত্থান-পতনের গরিমা প্রকাশ করে লৌকিক জীবনকে কাব্যরসের অলৌকিক ধারায় অভিসিঞ্চিত করে সেটা পুরাতন হয় না। সেই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য থেকে যুগ-যুগান্তের মানুষ পায় তাদের অন্তরের মর্মর রাগিণী। কবির ভাষায়—

“সেথায় নীরবে এস দ্বার খুলি ধীরে 

মঙ্গল কনকা ঘটে পুণ্য তীর্থ জল 

সযত্মে ভরিয়া রাখ, পূজা শতদল 

স্বহস্তে তুলিয়া আন।”