“মুকুন্দরামের সম-সাময়িক বা পরবর্তী বহু কবি চণ্ডীমঙ্গল আখ্যান অবলম্বন করিয়া কাব্য রচনা করিয়াছেন। কিন্তু মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল আপন বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল।” এই মন্তব্যটির বিচার করো।

মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের বৈশিষ্ট্য

মঙ্গলচণ্ডী দেবীর ব্রতকথা অবলম্বনে কাব্য রচনা মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যশাখার একটি বিশিষ্ট ধারা। মাণিকদত্তকে চণ্ডীমঙ্গলের আদিকবি বলে ধরা হয়। মুকুন্দরাম পূর্ববর্তী কবি মাণিকদত্তকে তাঁর কাব্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলিয়াছেন-

মাণিকদত্তের আমি করিয়ে বিনয়।

যাহা হৈতে হৈল গীতপথ পরিচয় ৷


মাণিকদত্তের কাব্য বিশেষ কোনো গৌরব দাবী করতে পারে না। তার ভাষা ও ছন্দের ত্রুটি অতিশয় প্রকট।


অতঃপর দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্যের 'চণ্ডীমঙ্গল গীত' কাব্যখানির উল্লেখ করেতে হয়। দ্বিজ মাধব ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ মুকুন্দরামের সম-সাময়িক কালে তাঁর কাব্য রচনা করেন। মাধব উচ্চতর ক্লাশক্তির অধিকারী ছিলেন বলে মনে হয় না। কবি কাহিনীটিকে পাঁচালী বা ব্রতকথার ভঙ্গীতে বিবৃত করেছেন, তাকে নাটকীয়তা ও কথাসাহিত্যের রসে ভরে তুলতে পারেন নি। চরিত্রাঙ্কনেও তাঁহার দক্ষতা এমন কিছু বিস্ময়কর নয়। তথাপি আনুপূর্বিক সঙ্গতি রক্ষা করে পূর্ণাঙ্গ চরিত্র সৃষ্টির এমন মৌলিক প্রয়াস তাঁর পূর্বে খুব বেশী কবি দেখাতে পারেননি।


শুধু চণ্ডীমঙ্গল ধারার নয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুকুন্দরাম নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ কবি। মুকুন্দরামের পূর্ববর্তী দুজন কবি মাণিক দত্ত ও দ্বিজ মাধব চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেছেন। মুকুন্দরাম মাণিকদত্তের কাব্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন কিন্তু চট্টগ্রামের কবি দ্বিজ মাধবের কোনো খবরই তিনি রাখতেন না। তবে তিনি যেখানে থেকেই উপাদান সংগ্রহ করুন না কেন, সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রতিভার দ্বারা তিনি তাঁর কাব্যকে অপরূপ করিয়া তুলেছেন। মুকুন্দরাম কালকেতুর কাহিনীর উদ্ভাবক না হলেও এর বৈচিত্র্যসাধনে তাঁর দান অপরিসীম। ব্যাধের জীবনযাত্রা, ব্যাধ কর্তৃক রাজধানী স্থাপনের কৌতূহল প্রদ বিবরণ, হিন্দু-মুসলমানের বিভিন্ন শ্রেণির কুল পরিচয় প্রসঙ্গে কবির অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, মুরারি শীল ও ভাঁড়ুদত্তের কাহিনীর তির্যকতা মামুলী কাহিনীর মধ্যে বৈচিত্র্য সম্পাদনে সহায়তা করেছে।


মুকুন্দরামের প্রধান বৈশিষ্ট্য—চরিত্র পরিকল্পনা। বস্তুতঃ মধ্যযুগে বাস্তব জীবনচিত্রাঙ্কনে মুকুন্দরামের সমান প্রতিভাশালী কবি আর একজনও পাওয়া যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে ভারতচন্দ্রের কথা মনে হবে। ভারতচন্দ্র চরিত্রচিত্রণে ততটা সার্থক নন, যতটা মণ্ডনকলায় কুশলী। মুকুন্দরামের রচনারীতিতে চারুত্ব ও বক্রতার অভাব আছে, কিন্তু বিচিত্র চরিত্রচিত্রণে সে ত্রুটি ঢেকে গেছে। কাহিনীকেন্দ্রিক রচনায় চরিত্র প্রাধান্য আধুনিক সাহিত্যের লক্ষণ। প্রায় চারশ বৎসর পূর্বে আবির্ভূত এই কবির চরিত্র পরিকল্পনায় আধুনিকতার স্পর্শ পাওয়া যায়। তিনি দেবদেবীর চরিত্রগুলিকে যথাসম্ভব মানবধর্মের দ্বারা জীবস্ত করেছেন। কিন্তু সে জন্য তাঁর প্রশংসা নয়। তিনি মর্ত্যের মানবচিত্র অঙ্কনে যে সহানুভূতি, বাস্তব জ্ঞান ও সূক্ষ্ম দর্শনশক্তির পরিচয় দিয়েছেন, তাহা মধ্যযুগের ভারতীয় সাহিত্যেই দুর্লভ।


ইন্দ্র-পুত্র নীলাম্বর ও তাঁহার পত্নী ছায়া মর্ত্যলোকে ব্যাধের ঘরে জন্মোলি। রত্নমালা ও মালাধর যথাক্রমে খুল্লনা ও শ্রীমন্ত রূপে মর্ত্যভূমি স্পর্শ করেছিল এবং মর্ত্যলীলাবসানে ও দেবীর পূজা প্রচারের পর স্বর্গের দেব-দেবী স্বর্গে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু যত দিন তারা মর্ত্যে ছিল, ততদিন এক মুহূর্তের জন্যও তারা জাতিস্মর হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় শ্রেণির কবি হলে এই ব্যাপার নিয়ে কিছু না কিছু লিখে ফেলতেন।


কালকেতু ও ফুল্লরাকে আমরা যেন চোখের সম্মুখে দেখতে পাই। ব্যাধ নন্দন কালকেতু ভোজনে বসেছে,–ফুল্লরা নারিকেলের খোলে জল ভরে দিয়া হরিণের ছাল পেতে দিল, বীর হাত পা ধুয়ে খাতে বসল—

মোচারিয়া গোঁফ দুইটা বান্ধিলেন ঘাড়ে। 

এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে ৷৷ 

চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ-জাউ। 

ছয় হাঁড়ি মুসুরী-সুপ মিশ্যা তথি লাউ ৷৷ 

ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া। 

কচুর সহিত খায় করঞ্জ আমড়া॥

শয়ন কুৎসতি বীরের ভোজন বিটকাল।

ছোটো গ্রাস গেলে যেন তেয়াটিয়া তাল ॥


এখানে ব্যাধ-বীরের ভোজনের বর্ণনায় ডাইনিং-হলে আসীন বিলাসী ভব্য-সম্প্রদায় যে আঁতকে উঠেবেন, তাতে সন্দেহ নাই। কালকেতু দেব কৃপাপুষ্ট হলেও বুদ্ধি বিবেচন য় সভ্য-ভব্যতার ধার দিয়েও যায় না। দেবীর আশীর্বাদে সে সাতঘড়া ধন পেল। বাঁকে করে দুই দিকে দুই ঘড়া নিয়ে তিনবার ছয় ঘড়া ধন ঘরে তুলল, বাকি রহল এক ঘড়া। ফুল্লরা ঘরে বসে ঘড়া পাহারা দিচ্ছে। শেষে কালকেতু দেখল বাঁকে করে প্রতিবারে দুই ঘড়া নিলে এক ঘড়া অবশিষ্ট থাকে। তখন সে দেবীকে অনুরোধ করল, “এক ঘড়া ধন মাতা নিজ কাঁখে করো।” দেবী কি আর করবেন, ভক্তের জন্য ধনঘড়া কাঁখে করে বীরের পিছনে পিছনে চললেন! তার পরের কাহিনী—

পশ্চাতে চণ্ডিকা যান আগে কালু যায়। 

ফিরি ফিরি কালকেতু পাছু পানে চায় ৷৷

মনে মনে কালকেতু করেন যুকতি। 

ধন ঘড়া নিয়া পাছে পালায় পার্বতী৷


কবি কালকেতুর চরিত্রটাকে আমাদের সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তার অশিক্ষিত, অমার্জিত ব্যাধচরিত্রের বন্য সরলতা ও গ্রাম্য সংশয় এখানে চমৎকার ফুটেছে আদিকবি বাল্মীকি বেদ-বেদান্তে পারঙ্গম মারুতির চরিত্র বর্ণনায় এই একই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। যে হনুমান রামসেবক মহাপণ্ডিত তিনিও মাঝে মাঝে বানরস্বভাব ব্যক্ত করে ফেলতেন।


কবিকঙ্কণ নায়ক চরিত্র বা নেতৃস্থানীয় প্রধান পুরুষ চরিত্রাঙ্কনে খুব একটা কৃতিত্ব দেখাতে পারেন নি কৃতিত্ব দেখাতে পারেন নি—যেমন ধনপতির চরিত্র। ধনপতির চরিত্র নিতান্তই বিলাসী নায়ক চরিত্র হয়ে গেয়েছে। তাঁহার চণ্ডী-বিরোধিতা মনসামঙ্গলে চাঁদসদাগরের মনসা বিরোধিতার পার্শ্বে অত্যন্ত ম্লান মনে হয়। দুই পত্নী নিয়ে তাঁহার গার্হস্থ্য জীবনটি স্নিগ্ধ মধুর, কখনও কখনও কৌতুক রসে বেশ উজ্জ্বল হয়েছে, কিন্তু কোথাও একটা ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য ফুটে ওঠে নি। তবে কাব্যের সমাপ্তিটি তাঁর বিলাপে মিলনের মধ্যেও বিষণ্ণতার সুর ধ্বনিত করেছে। পুত্র ও তার পত্নী স্বর্গের দেবদেবী; তারা শাপের অবসানের পর স্বর্গে চলে গেল, আর ধনপতি শূন্য স্মৃতি বুকে আঁকড়েই মর্ত্যভূমিতে পড় রইলেন।


খুল্লনা প্রণাম করে পতির চরণে। 

চরণে ধরিয়া বামা করে নিবেদনে৷ 

অনুমতি দেহ নাথ যাই সুরপরী। 

ইন্দ্রের নর্তকী আমি রহিতে না পারি ৷ 

এত শুনি ধনপতি কান্দে উভরায়। 

যাইবে ছাড়িয়া আমি না দিব বিদায় ৷

এই বিলাপ প্রেম-প্রীতি ব্যাকুল একটি সাধারণ মানুষের অন্তর হতে উত্থিত হয়েছে বল আমরাও ধনপতির দুঃখে সহানুভূতি বোধ করি।


মুকুন্দরাম পুরুষ চরিত্রে, বিশেষতঃ প্রধান চরিত্রে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাতে না পারলেও স্ত্রীচরিত্র এবং পুরুষের তির্যক চরিত্রে অসাধারণ কুশলতা দেখিয়েছেন। ফুল্লরা, লহনা ও খুল্লনার চরিত্র যেন প্রতিদিনের দেখা-চরিত্রে পরিণত হয়েছে। ফুল্লরার সরলতা, খুল্লনার শান্তভাবে, সাময়িক দুর্ভাগ্যের নিকট আত্মসমর্পণ এবং বিপদ কেটে গেলে সতীনকে বেশ দু'কথা শুনিয়ে দেওয়া—ইত্যাদি বর্ণনাসমূহ পরিপক্ক শিল্পীর লেখনী হতেই বোরে হয়েছে, কিন্তু লহনার প্রতি আমাদের অধিকতর সহানুভূতি রহেছে। স্বামী তরুণী সপত্নী এনেছে—তার লজ্জা, দুঃখ ও শঙ্কার সীমা নেই। অবশ্য পরে ধনপতি বিগতযৌবনা জ্যেষ্ঠা পত্নীকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করতে চাইলেও সে বুঝেছে তার যৌবন গেয়েছে, দিনও গিয়াছে। এই যৌবনদীনা স্বামী প্রেমবতিা বন্ধ্যা নারীর ক্ষুদ্ধ উক্তিতে কবির বিশেষ সহানুভূতি সঞ্চারিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত—ডক্টর অসিতুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।


মুকুন্দরামের চরিত্রাঙ্কন দক্ষতা অপ্রধান চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় ! মুরারি শীল মুকুন্দরামের মৌলিক সৃষ্টি। ধূর্ত বণিকের যে চরিত্র মুকুন্দরাম অঙ্কন করেছেন তা বর্তমান যুগের ঔপন্যাসিকেদের ঈর্ষার বস্তু। ভাঁড়ুদত্তের চরিত্রেও মুকুন্দরাম উজ্জ্বলতার প্রলেপ লাগিয়েছেন।


মুকুন্দরামের বাস্তবতাবোধও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে এক লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। কবির আত্মপরিচয় প্রসঙ্গ, হরগৌরীর সংসার চিত্র, বনের পশুদের দুঃখের কাহিনীর মধ্যেও বাস্তবতার প্রলেপ, কালকেতুর জীবনযাত্রা, রাজধানী পত্তন, মুরারী শীল ও ভাঁড়ু দত্তের প্রসঙ্গ প্রভৃতি চিত্রের মধ্যে মুকুন্দরামের প্রখর বাস্তবতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। মুকুন্দরাম যে সমাজে বাস করতেন সেই সমাজে আধুনিক যুগের বাস্তবতাবোধ বিদ্যমান ছিল একথা আশা করা যায় না। কবি প্রসন্ন মধুর দৃষ্টির সাহায্যে বাস্তবতাকে রমণীর করে তুলেছেন এবং তুচ্ছ ক্ষণস্থায়ী বিবর্ণ ব্যপারকেও রচনার গুণে সুখপাঠ্য করে তুলেছেন। মোট কথা বাস্তবতা, সূক্ষ্ম দর্শনশক্তি, অভিজ্ঞতা, সহানুভূতি এবং নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য মুকুন্দরামকে নিঃসন্দেহে শুধু চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারার নয় তাবৎ মধ্যযুগের বাংলা সাহিতে শ্রেষ্ট কবির আসন দেওয়া যায়।