স্বাধিকারবোধ ও বিপ্লবের আর এক নাম ধানী মুন্ডা—চরিত্রটির বিশ্লেষণ করে তোমার অভিমত দাও।

‘ধানী মুণ্ডা’-র চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।


বৃদ্ধা ধানী, অভিজ্ঞতায় প্রবীণ। মুণ্ডাদের স্বাধীকারের দাবিতে—“বহু বহুদিন ধরে ও লড়ছে। সাঁওতালদের ‘হুল’-এ তির ছুঁড়েছে, সর্দারদের ‘মুলকি’ লড়াই-এ শামিল হয়েছে। বীরসার উলগুলানে যোগ দিয়েছে।” অবশেষে ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে রাঁচি জেলে বন্দি হয়ে অন্যান্য বন্দি মুণ্ডাদের সঙ্গে অত্যাচার আর অবিচারের মধ্য দিয়ে জীবনের অন্তিম প্রহর গুনে চলেছে। ধানী উপন্যাসের মধ্যে কথক চরিত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তার কাছেই মুণ্ডাদের সমগোত্রীয় হয়ে পাঠকরা বীরসার এবং বীরসার পূর্বপুরুষদের অতীত ইতিহাস শুনতে সচেষ্ট হয়। “জেলে বসে ধানী মুণ্ডা, ভরমি মুণ্ডা বীরসার কথা বলত।" পাঠক ধানীর মুখে গল্প শুনতে শুনতে বুঝতেই পারেনা, কখন বীরসার জীবন কাহিনি অবলম্বনে রচিত অরণ্যের অধিকার পরিণতির দিকে যাত্রা করেছে।


যৌবনে ধানী মুণ্ডা বড়োদের কাছে গল্প শুনেছিল একদিন মুণ্ডাদের জীবন থেকে সকল দুঃখকষ্ট দূর করতে মুণ্ডাদের ঘরেই আবির্ভূত হবে তাদের ত্রাতা। একদিন সে যখন জানতে পারল সিধু আর কানু দুই ভাই-এর নেতৃত্বে সাঁওতালরা সংঘটিত হয়ে একযোগে ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, তখন—“সে এসেছে বলে বড়ো আশায় ১৮৫৫ সালে ছেচল্লিশ বছরের ধানী মুণ্ডা চলে গিয়েছিল বারাহাইত হয়ে ভাগননাদিহির মাঠে সিধু আর কানুর সাঁওতালদের দলে যোগ দিতে।" তবে ধানী শুধু সাঁওতালদের সঙ্গে 'হুল'-এ অংশগ্রহণ করে ক্ষান্ত থাকেনি, তার আরও কাজ ছিল। সবাইকে সে বলেছে—“কুচিলা তৈরি করতাম, তিরের ফলায় মাখাতাম বিষ কণ্টিকারির ফল জলে ভিজিয়ে ক্বাথ করতাম। সে ক্বাথে তির ডুবাতাম, শুকাতাম, এই করতাম।" সেদিন ধানীরা অবশ্য জিততে পারেনি। পরাজিত হয়ে বিশ বছর ধরে আত্মগোপন করেছিল।


দশ বছর ধরে চলেছিল ধিমা ধিমা তালে মুলুক লড়াই, চালকাড়ে আসার পরে ধানী যোগ দিয়েছিল সর্দারদের সঙ্গে। ওখানেও কুচিলা তৈরি করে তিরের মাথায় তা লাগানোর কাজে সে আত্মনিয়োগ করেছিল। ধিমা ধিমা তালে মুলুক লড়াই চলতে লাগল। এদিকে‌ সুগানা মুণ্ডার ঘরে শসীকলার মতো বাড়তে বাড়তে বিশ বছর বয়সে ধরতি আবা হয়ে বীরসা উলগুলানের ডাক দিল। লড়ায়ে, বিদ্রোহে ধানীর একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল। ধানীরা মুলুক লড়াই ছেড়ে বীরসার উলগুলানে যোগ দিল। “বুড়ো হলে কী ? তির ধনুকে ওর নিশানা পাকা। ওর মতো দেশ বিদেশ দেখেছে কে ?” ধানী সম্পর্কে মা করমি ছেলে বীরসাকে বোঝায়—“ওর কথা শুনিস না বাপ, জীবনকালে দশটি ছেলেকে ও লড়াই-এ নামিয়েছে।” তবে ধানী যে নির্ভীকের মতো অরণ্যে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় কেন বীরসা তা মায়ের কাছে জানতে চাইলে করমি উত্তর দেয়—“ও ভগবান খুঁজেরে বীরসা।” ধানী যে বীর ভগবানের সন্ধান করে বেড়াচ্ছিল, সেই বীর ও ভগবানকে সে আবিষ্কার করেছে বীরসার মধ্যে। তাইতো বীরসার উলগুলানের ডাকে ধানী আত্মহারা হয়ে সর্বাগ্রে সাড়া দিয়েছিল।


বীরসা যে মুণ্ডাদের ভগবান এতো, তা সবার আগে ধানীর চিন্তায় ধরা পড়েছিল। বীরসা তাই বড়ো হতে ধানী তার পশ্চাতে ছায়ার মতো অনুসরণ করে ফিরত। মিশনে ধানীকে আসতে দেখে তার আগমনের হেতু কি বীরসা জানতে চাইলে ধানীর সোচ্চার কণ্ঠ গর্জে ওঠে—“আসব না ? চাইবাসা কী তোর কিনা ? ধানী যে বীরসাকে খুব ভালোবাসত, আপনজন বলে মনে করত এই শ্লেষপূর্ণ বাক্যে তা প্রমাণ করে। পরিশেষে ধানী তার ছদ্ম আবরণ খুলে ফেলে বীরসার কাছে নিজের উদ্দেশ্য পেশ করে একদিন। যেদিন ফাদারের সঙ্গে ঝগড়া করে বীরসা মিশন ছেড়ে বাড়িতে চলে এসেছিল, ধানী তখন বীরসাকে বলেছিল—“সর্দারদের মুলকি লড়াই থেমে যায়রে বীরসা। মিশন ছাড়লি, তুই জোলা যা। নাকি তুই মুণ্ডাটা নোস?” ধানী একরকম প্রচ্ছন্ন ডাক দেয় বীরসাকে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য।


ধানী বীরসার সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইংরাজ পুলিশ কর্তৃক ধরা পড়ে জেলে গিয়েছিল। কিন্তু জেলের মধ্যে পাথর কাটার কাজ করতে করতে একদিন সেখান থেকে পালিয়ে সোজা সালীর বাড়িতে এসেছিল। সালীর তৎপরতায় ধানী পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করে এবং বীরসার অবর্তমানে বিদ্রোহের কাজ গোপনে চালিয়ে যাবার জন্যে বলোয়া দিয়ে গাছের ডাল কেটে তির বানায় এবং তিরের মাথায় কুচিলা বিষ মাখিয়ে সালীকে দিয়ে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিতে থাকে গোপনে। পলাতক ধানীর সংবাদ জানতে ভরত দারোগা সালীর পিছু নিলে ধানী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে ভরত দারোগাকে খতম করতে সংকল্প করে। যুদ্ধবিদ্যায় ধানী বিশেষ পারদর্শী। তাছাড়া—“ধানীর হাতে বলোয়া সুন্দর চলে। বলোয়া আর চকমকি থাকলে ধানীর আর কিছু দরকার হয় না। বর্ষাকাল হলে ধানী জঙ্গলে ঝোপ কাটতে কাটতে ঢুকে যাবে। বলোয়া দিয়ে গাছের ডাল ছুঁচলো করে তাই ছুঁড়ে শুয়োর বা বা হরিণ গেঁথে ফেলবে।” মুলকি লড়াই-এর সময় ধানী জোতদারদের ঘর খামার মারাই জ্বালিয়ে দিয়ে সেবার জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল। তখন তো বলোয়া দিয়ে ডালপালা কেটে গাছের মগডালের কাছাকাছি সুন্দর মাচা বেঁধে বেশ কিছুদিন সেখানে আত্মগোপন করেছিল। তবে এবারে গুহার মধ্যে আত্মগোপন করে থাকতে তার বিশেষ কষ্ট হয় না কারণ, ফাঁদ পেতে খরা মেরে ধানী সুন্দরভাবে উদরপূর্তি করছে।


দীর্ঘ দু'বছর জেল খেটে যখন বীরসা চালকাড়ে ফিরছিল তখন ধানী তার গুহার মধ্যে অন্তরীণ বাস ভঙ্গ করে সর্বসমক্ষে এসে বীরসাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। বীরসা ধানীকে দেখে জানতে চাইল কেন সে জেল থেকে পালিয়েছে। ধানী উত্তর দিয়েছে নির্ভীক ভাবেই—“ভাত দিল না কেন ? ঘরেও খাটো যাব, জেলেও খাটো ? তা বাদে ওয়ার্ডার আমারে শিয়াল বলল কেন ?” ধানী মুণ্ডা উপজাতী হলেও তার আত্মজ্ঞান যে সুপ্রচুর ওয়ার্ডারের কথায় জেল পালিয়ে এসে সে প্রমাণ করেছে। এরপর তাদের নেতা ধরতি আবা বীরসাকে অগামী বিদ্রোহের প্রস্তুতি সম্পর্কে নানারকম পরামর্শ দাতার কাজে কর্মী অগ্রণী ভূমিকা নেয়। সে বীরসাকে জানায় আইনের কথা, জেকবের কথা, মুণ্ডাদের বেটকোরীর কথা এবং জমিদার সাহেবদের অত্যাচারে কেন মুণ্ডারা গ্রাম ছেলে দলে দলে জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে যায়, সমস্তই সে বীরসাকে অবগত করতে থাকে। সুষ্ঠুভাবে এতদিন তারা বাঁচতে পারেনি তাই বীরসাকে জানিয়ে দিল সমগ্র মুণ্ডাদের বর্তমান মানসাভিলাস—“এখন মুণ্ডারা জেলে গিয়েছে তুমি বিনা তাদের গতি নাই।" একরকম ধানীর কথায় উদ্বোধিত হয়ে বীরসা আগামী বিদ্রোহের কর্মপদ্ধতি স্থির করতে সালীর বাড়িতে সভার অহ্বান করে।


বীরসার উলগুলানে অংশগ্রহণ করে ধানী অন্যান্য বিদ্রোহী মুণ্ডাদের সঙ্গে আবার জেলে গিয়েছিল। বীরসার মৃত্যুর পর অসুস্থ সুনারাকে কোলে নিয়ে তাকে সেবা করেছিল, সান্ত্বনা দিয়েছিল। তারপর সুনারার মৃত্যু ঘটলে ধানী বিষাদ ভারাক্রান্ত চিত্তে বেশ কিছুদিন জেলের মাঝেই অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে অবস্থান করেছিল। অবশেষে ইংরেজ সরকারের দাক্ষিণ্যে ধানী বেকসুর খালাস পায়। অমূল্য যখন জেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চালকাড় বোর্তাদিতে বেড়াতে গিয়েছিল তখন ধানী তার সঙ্গে ছিল। ধানী অমূল্যকে একের পর এক পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সালীর কাছে, পরিবার কাছে, চিনিয়ে দিয়েছিল বীরসার বাবা সুগালা ও মা করমিকে। অর্থাৎ গ্রামের প্রাচীন বৃক্ষের মতো যাবতীয় স্মৃতি বুকে নিয়ে ধানী তার জীবন অতিবাহিত করেছিল। সকল ঘটনার বিশেষত আদিবাসীদের যাবতীয় লড়াই-এর সাক্ষী এবং অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা সে। অতএব ধানী যে একজন প্রতিবাদী চরিত্র রূপে অরণ্যের অধিকার উপন্যাসে বিচরণ করেছে তা স্বীকার করতে কোনো সংশয় থাকে না।