'একেই কি বলে সভ্যতা' প্রহসনটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।

মধুসূদন তাঁর সৃষ্টি কর্মের নামকরণের ক্ষেত্রে যে সকল বিষয়ের প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছেন তাহল চরিত্র এবং ঘটনা। তিনি যে দুটি প্রহসন লিখেছিলেন সেদুটির মধ্যে একটিতে প্রধান চরিত্রকে ‘বুড়ো শালিক' বলে উল্লেখ করে নাম দিয়েছেন—'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' এবং অন্যটিতে তৎকালীন যুগের একশ্রেণির উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের লাম্পট্য, বেশ্যাসক্ত ও নানা কেচ্ছা কাহিনির বর্ণনা করে নাম দিয়েছেন—'একেই কি বলে সভ্যতা'? বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের দিক দিয়ে ভিন্ন হলেও নামকরণের ক্ষেত্রে উভয় প্রহসনের একটা মিল আছে। দুটি প্রহসনের সমাপ্তিতে নামরকণের ব্যাখ্যার পদ্ধতি একই ধরনের। যেমন—'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো' এই প্রহসনের শেষ দুটি পঙ্ক্তি হল—

“শিক্ষা দিলে কিলে চোটে, হাড় গুঁড়িয়ে যোয়ের মোয়া,

যেমন কর্ম ফললো ধর্ম, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁয়া।।”


অন্যদিকে “একেই কি বলে সভ্যতা”র শেষ দুটি বাক্য হল— “মদ মাস মেয়ে ঢলাঢলি কল্লেই কি সভ্য হয় ?–একেই কি বলে সভ্যতা?” এই শেষ উক্তিটির সাহায্যেই প্রহসনটির নামকরণ করা হয়েছে। উক্তিটি শুধু নবকুমারের দুর্ভাগিনী স্ত্রী হরকামিনীর নয়—এ যেন নাট্যকারের জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা। আধুনিক সভ্যতা যে বিকৃত সভ্যতা তা বোঝাবার জন্যই নাট্যকার সুকৌশলে এই জিজ্ঞাসা চিহ্নের ব্যবহার করেছেন।


‘জ্ঞানতরঙ্গিনী’ সভায় গিয়ে নবকুমারের এবং তার বন্ধুরা আকণ্ঠ মদ্যপান করেছে, গোমাংস ভক্ষণ করেছে এবং বারাঙ্গনা নিয়ে নাচ গান ও ফুর্তি করেছে। এসবই তারা করেছে আধুনিক সভ্যতার নামে। এদের না ছিল কোনো উচ্চ আদর্শ, না ছিল জ্ঞান স্পৃহা, না ছিল উচ্চ ধরনের প্রতিভা। সমাজ সংস্কারের নাম করে তারা অবাধে চালিয়েছে স্বেচ্ছাচার লাম্পট্য ও মদ্যপান। ইংরাজি সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোকে উদ্ভাসিত 'ইয়ং বেঙ্গল' দলের অক্ষম অনুকারী এরা। এরা ছিল স্বল্প শিক্ষিত আদর্শহীন, এবং ভোগাবিলাসে মত্ত। ধনীপিতার সন্তান হিসাবে এদের হাতে ছিল অঢেল অর্থ এবং সেই অর্থ তারা ব্যয় করেছে অসংযত জীবনাচরণে। মদ ও মাংস ভক্ষণকেই তারা জীবনের পরমার্থ বলে মনে করত এবং বেশ্যা গমনকে আধুনিক সভ্যতার অঙ্গ বলে বিশ্বাস করত। রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘সেকাল ও একাল' গ্রন্থে বলেছেন “যেমন পান দোষ বৃদ্ধি পাইতেছে তেমনি বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহা কিন্তু সভ্যতার চিত্র।” রাজনারায়ণ যে সভ্যতার কথা বলেছেন তা বিকৃত সভ্যতা। কারণ পান দোষ ও বেশ্যাগমন কখনই প্রকৃত সভ্যতার চিহ্ন হতে পারে না।


নবকুমার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এই উচ্ছৃঙ্খলতা ও বেলেল্লাপনাকে অন্দরমহলেও টেনে এনেছে। মাতাল নবকুমার একদিন নিজের বোনকে সাহেবদের অনুকরণে চুম্বন করেছে। বৈঠকখানা ঘরে বন্ধু কালীনাথকে মদ খেতে দিয়েছে। নাটকের শেষে দেখা গেছে মদের নেশায় চুর হয়ে সকলের সামনেই ‘মদ ল্যাও' বলে চিৎকার করেছে এবং নিজ স্ত্রীকে ‘পয়োধরী' বলে সম্বোধন করেছে। নবকুমারদের এই কীর্তি দেখে তার বোন নৃত্যকালী রেগে গিয়ে বলেছে— “ও মা ছি। ইংরেজি পড়লে লোক এত বেহায়া হয় গো"। ইংরেজি শিখলেই কেউ মাতাল হয় না বা অধঃপাতে যায় না। কিন্তু নৃত্যকালী ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত দুশ্চরিত্র মাতাল নবকুমারের চরিত্রকেই চোখের সামনে দেখেছে তাই তার মনে হয়েছে ইংরেজি শিক্ষাই তার দাদাকে অধঃপতনের শেষ ধাপে নামিয়েছে।


এই শ্রেণির চরিত্র তাদের দাম্পত্য জীবনকে কীভাবে কলুষিত ও ধ্বংস করেছে তা হরকামিনীর একটি উক্তিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অসহায় নারী জীবন যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে চলেছে—“এইসব দেখে শুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দিয়ে মরি”। তার শেষতম উক্তি—“মদমাংস খেয়ে ঢলাঢলি করলেই কি সভ্য হয় ? একেই কি বলে সভ্যতা" ? তাঁর এই সংক্ষিপ্ত সারগর্ভ, উচ্চকিত উক্তি উদ্যত তীক্ষ্ণধার বর্শাফলকের মতো যেন এই ভয়াবহ বিকৃত সভ্যতাকে বিদ্ধ করতে চাইছে। এইখানেই ‘একেই কি বলে সভ্যতা'র নামকরণের সার্থকতা নিহিত।