কীটসের কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।

সংক্ষিপ্ত কবিজীবনে সৌন্দর্যের পিয়ালি কীট্স সময় প্রবাহের দুর্যোগ দুর্বিপাকের মধ্যেও নিরন্তন সন্ধান করেছেন চিরন্তনের, অমরত্বের। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ধারাবাহিক বিপর্যয় তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে যতই ভারাক্রান্ত করেছে, ততই মৃত্যুর ছায়াপড়া জীবনের তরুণ কবি অনন্ত তথা সুন্দরের ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায়, শিল্পের মাধুর্যে। নশ্বর ঘরজগতের অপূর্ণতা ও অবিনশ্বর সৌন্দর্য লোকের চিরায়ত পরিপূর্ণতা—এ’ দুয়ের দ্বন্দ্ব কীট্সের সমগ্র কাব্য সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয়। শেলীর কাব্যে দূরবর্তী আনন্দলোকে পৌঁছাতে না পারার যে হাহাকার শোনা যায় কীট্সের কাব্যে সে ধরনের আত্মবিলাপের চিহ্ন নেই; বরং কল্পনার আকাশ মিনার থেকে কীট্স ফিরে এসেছেন রূঢ় বাস্তবে, উপলব্ধি করেছেন সরল রৈখিক মানব জীবনে ক্ষয় ও মৃত্যুর অনিবার্যতা। শেলীর রাজনৈতিক তথা সামাজিক আবেগের দাহ কিংবা ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রশান্ত আনন্দানুভব কীট্সের কাব্য কবিতায় পাওয়া যায় না। প্রকৃতি ও মানুষের সর্ববিধ রূপ ও বর্ণের মাঝে সৌন্দর্যের অন্বেষণে ব্রতী কীট্সের কবিতার সারাৎসার সুতীব্র সংবেদনশীলতা যার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্য সন্ধান ও ইন্দ্রিয়ময়তাকে কীটস শিল্পসুষমার এক ঈর্ষণীয় উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন চিত্রকল্পের রূপময়তা প্রকরণের দক্ষতা ও ছন্দ তথা ধ্বনির অনুপম মাধ্যমে।


কীট্সের সমস্ত রচনার মধ্যে তাঁর ওডগুলি (Odes) সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি যদি তাঁর ওডগুলি লিখে আর কিছু না লিখতেন তাহলেও কবি হিসাবে তাঁর সমান স্বীকৃতি থাকত। কল্পনা এবং আবেগের অপূর্ব সমন্বয় এবং বেদনা বিহ্বল চিত্তের অবর্ণনীয় প্রকাশ কীট্সের ওড়কে মহীয়ান করে তুলেছে। মৃত্যুর পদধ্বনি যখন সুস্পষ্ট শোনা গিয়েছিল, প্রেমের শিখা যখন নির্বাণোন্মুক, জীবন যখন শুকিয়ে এসেছে, তখন গীতি সুধারসে জারিত ওডগুলি রচিত হয়েছিল। আঙ্গিকের উৎকর্ষ সরলতা, অলংকারের আতিশয্য বিহীন চিত্রকল্প চিত্রময়তা বর্ণের বিন্যাস, আবেগের অকপটতা, কল্পনার প্রসার, গ্রিক কবিসুলভ প্রাঞ্জলতা, সৌন্দর্যের আবাহন, অকৃপণ মাধুর্য আর সুরের আলিঙ্গন ওডগুলিকে মৃত্যুঞ্জয় করে রেখেছে। কীট্স ‘ওড’ রচনায় কারুর কাছে ঋণী নয়। হৃদয়ের রক্ত দিয়ে কাব্য লক্ষ্মীর চরণে জীবনের অন্তিম প্রণতি। তাঁর আঠারোখানি ওডের মধ্যে—Ode to Autumn, Ode to Nightingale, Ode on a Grecian Unn, Ode to Melancholy, Ode on Indolence, 4 Ode to Psyche বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শরৎ ঋতুকে গ্রীষ্মের পূর্ণতা ও পরিপক্কতার সম্প্রসারণ রূপে কবি প্রকাশ করেছেন Ode to Autumn 3 Ode to Nightingle-এ রয়েছে মধ্যরাত্রির রহস্য, অপার্থিব সৌন্দর্য আর না পাওয়ার গ্লানি, Ode on a Gecian Unn-এ কবি বলেছেন মানুষের জীবন নম্বর, কিন্তু আর্ট আর সৌন্দর্য কালজয়ী Ode to Malancholy-তে কবি উপলব্ধি করেছেন যে, আনন্দের অমিয় সাগরে বেদনার শতদল প্রস্ফুটিত।


কীট্সের যে সকল সনেটগুলি রচনা করেছেন তাতে স্পষ্টতই ইতালীয় প্রভাব বিদ্যমান। এছাড়া তাঁর এন্ডিমিয়ন (Endimion) একটি রোমান্সধর্মী রূপক কাব্য। কবি এখানে অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রকাশ চেয়েছেন। এন্ডিমিয়ন একজন তরুণ মেষপাল, তারই সঙ্গে প্রেমে পড়েছেন চন্দ্রদেবী, দুজনের মিলনের মধ্যে চিরসৌন্দর্যের বন্দনা সূচিত হয়েছে। এণ্ডিমিয়ন সাধারণ মানুষ, চন্দ্রদেবীর উদ্দেশ্যে প্রেমাভিসার চিরন্তন সৌন্দর্য এবং আদর্শের জন্য জীবন উৎসর্গ। লাময়া (Lamia) কবিতার গল্পাংশে নায়ক এবং নাগিনী লামিয়ার ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। ইজাবেলা (Isabella) কবিতায় কীকীট্সেরনায়িকা ইজাবেলার জীবনের ট্র্যাজেডি বর্ণনা করেছেন। The Eve of St. Agnes (দি ঈভ অব সেন্ট অ্যাগনিস) কবিতায় কীট্স রোমিও এবং জুলিয়েটের ছায়া অবলম্বনে অপূর্ব প্রেমের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। হাইপেরিয়ান (Hyperion) কাব্য মহাকাব্যের একটি অংশ। মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট (Paradise lost)-এর প্রেরণায় এই অসম্পূর্ণ কবিতাটি রচিত। ঈভ অব সেন্ট মার্ক (Eve of St. Mark) কবিতাটি আবেগময় এবং চিত্রপ্রধান। লা বেল ডেইম স্যান্স মার্সি (labelle dame Sans Merci) কবিতায় কী করে একটি সুন্দরী হৃদয়হীনা তরুণী প্রেমের ছলনায় বহু লোককে বিভ্রান্ত করেছে তারই করুণ কাহিনি। এছাড়া কীট্স দুটি কাব্যনাট্য লিখেছিলেন—ওদো দি গ্রেট (Otho the Great) এবং কিং স্টিফেন (King Stephen) অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ওদো দি গ্রেট-এর গল্পাংশের জন্য কবি বন্ধু ব্রাউমিং-এর কাছে ঋণী আর দ্বাদশ শতাব্দীর পটভূমিকায় রচিত কিং স্টিফেন নাটক হিসাবে সার্থক।


কীটসের কবিতায় বৈশিষ্ট্যসমূহ :

(১) প্রকৃতি প্রেম : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপময় ও বর্ণময় ছবি কবি কীটসের কবিতায় বড়ো আকর্ষণ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো প্রকৃতির বাহারূপের গভীরে কোনো অন্তর্জীবনের সন্ধান করেননি কীট্স ; কিংবা বিশ্ব প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের ঊর্ধ্বে কোনো দর্শন লোকের উদ্দেশ্যে ধাবিত হতে চাননি। শেলীর মতো কীট্সের কাব্য কবিতায় প্রকৃতির চিত্ররূপময় জগৎ নিবিড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতায় চিত্রিত। এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীন গ্রিকদের মতো যাঁরা প্রকৃতির নানাবিধ রূপ ও শক্তিকে মানবীয় সৌন্দর্যের আলোকে দেখেছিলেন।


(২) সৌন্দর্যচেতনা : A thing of beauty if a Joy forever, লিখেছেন কীটস। কাব্য সাধনায় সৌন্দর্য ছিল কীট্সের ধ্রুবতারা, শিল্পে কিংবা প্রকৃতিতে কিংবা প্রেমে তিনি নিরন্তর সন্ধান করেছেন সৌন্দর্যের, রূঢ় বাস্তবের দুর্দশা পীড়নকে বিস্তৃত হতে তিনি কল্পনার আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। আশ্রয় নিতে চেয়েছেন মধ্যযুগীয় রোমান্স আর গ্রিক পুরাতত্ত্বের জগতে। ধর্মীয় কিংবা সামাজিক দর্শন চিন্তার মাধ্যমরূপে নয়, কবিতাকে কীট্স দেখেছিলেন সৌন্দর্যপ্রীতির প্রকাশ রূপে। কবিতায় প্রচার মুখীতার ঘোর অপছন্দ ছিল তাঁর।


(৩) ইন্দ্রিয় পরশ : সৌন্দর্যপ্রেমী এই কবি তাঁর কাব্য কবিতায় প্রাকৃতিক তথা মানব সৌন্দর্যের যে সকল ইন্দ্ৰিয়ঘন শব্দচিত্র উপহার দিয়েছেন তা সমগ্র ইংরাজি সাহিত্যে দুর্লভ। দৃশ্য, শব্দ, ঘ্রাণ, স্পর্শ ও স্বাদের জগৎ যেভাবে কীট্সের কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে তা এককথায় অতুলনীয়।


(৪) চিত্ররূপময়তা : কীট্সের কবিতার জগৎ এক আশ্চর্য চিত্ররূপময় জগৎ। শব্দচিত্রের এমন সুন্দর ও সঙ্গীর ভাণ্ডার রোমান্টিক কাব্যে বিরল। শেলীর বিমূর্ততা কীট্সের এই সকল ছবিতে নেই। তাঁর চিত্র কল্পগুলি আবেগময়, মূর্ত ও ইন্দ্রিয়ঘন।


(৫) কাব্যশৈলীর বিশিষ্টতা : টেনিসনের কবিতায় কীটসের কাব্যশৈলীর বিশিষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রাথমিক পর্বে স্পেনসার এবং উত্তর পর্বে শেকসপিয়র ও মিলটনের কাব্যের প্রভাবে এক বিস্ময়কর পরিণতি অর্জন করেছিলেন কীটস। গঠন সৌন্দর্যে, রূপক ও চিত্রকল্পের নিবিড়তায় শব্দবন্ধের গীতিমাধুর্যে রোমান্টিক প্রজন্মের সর্বাপেক্ষা শিল্পবোধ সম্পন্ন ও আধুনিক কাব্যরূপে গণ্য হয়ে থাকেন।


সর্বোপরি, কীট্স সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের একটি পত্র উদ্ধৃত করা যেতে পারে—“আমি যত ইংরাজ কবি জানি সবচেয়ে কীট্সের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আমি বেশি করে অনুভব করি। কীসের ভাষার মধ্যে যথার্থ আনন্দ সম্ভোগের একটি আন্তরিকতা আছে। কীটসের লেখায় কবি হৃদয়ের স্বাভাবিক সুগভীর আনন্দ তার রচনার কলানৈপুণ্যের ভিতর থেকে একটা সজীব উজ্জ্বলতার সঙ্গে বিচ্ছুরিত হতে থাকে।" এই বক্তব্যেই সুপ্রকট আপন প্রতিভা গুণে কবি কীটস সমগ্র ইংরেজি সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে চির অমর আসনে অধিষ্ঠিত। সৌন্দর্যময় কাব্য কবিতার জগতে তিনিই মূল পথিকৃত।