পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসে মৃত্যুর ভূমিকা | শশী কি মৃত্যুর দ্রুত? উপন্যাসে মৃত্যু ভাবনা আলোচনা করো।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের তেরোটি পরিচ্ছেদের বিভিন্ন অংশে মৃত্যুর অনিবার্য ভূমিকা জীবনের চলমানতার ছন্দকে প্রতিভাত করেছে। প্রাকৃতিক সত্যের নিত্যতা স্পষ্ট হয়েছে মৃত্যুর দ্বারা। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনায় নায়ক শশী কোনো না কোনোভাবে আলোড়িত হয়েছে। জীবনের গভীর রহস্য তার মনে বিস্ময় জাগিয়েছে। সত্য মিথ্যায় জড়ানো জগতে’ মৃত্যুর দ্বারা প্রমাণিত হয় মানুষটা এতদিন বেঁচে ছিল বা নিজের ইচ্ছামত বাঁচাতে চেয়েছিল। মৃত্যুর বিপরীতে জীবনের অদম্য আকাঙ্ক্ষা বাঁচাটাই একমাত্র সত্য বলে মনে হয়। শশী নিজে 'ডাক্তার। মৃত্যুর বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম। কিন্তু প্রজ্ঞাবান শশী জানে জীবিতের পক্ষে মৃত্যুকে কখনোই এড়ানো সম্ভব হয়না। রোগ-ব্যাধি থেকে মানুষকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মুক্ত রাখাবার জন্য সংগ্রাম করতে পারে ডাক্তার। তাই শশীর নিজেকে মনে হয় 'মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করিবার ভাড়া করা সৈনিক। মৃত্যুকে সে নিরাসক্তভাবে গ্রহণ করেছে প্রথম থেকেই। বরং মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে সে জীবন সংরাগে ভরপুর হয়ে উঠতেও চেয়েছে। ঠিকমত বাঁচা কাকে বলে সেটাই জানতে চেয়েছিল শশী।


উপন্যাসের সূচনাতেই শশী প্রকৃত অর্থে শিক্ষাশেষে জীবনারম্ভের মূহূর্তে মৃত্যুকে বহন করে গ্রামে প্রবেশ করেছে। ডাক্তারি পড়া শেষ করে অনেক আশা কল্পনা নিয়ে গাওদিয়া প্রবেশের আগে কালের ধারে গ্রামের হারু ঘোষের বজ্রহাত দেহটি দেখে নিজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দেহটি বহন করে খাল পথে গ্রামে ঢুকছে। আশ্চর্যের বিষয়, অনুভূতিপ্রবণ শশী কিন্তু সে সময় সম্ভাবনাপূর্ণ জীবনের কথাই ভেবেছে— 'জীবনটা সহসা তাহার কাছে অতি কাম্য উপভোগ্য বলিয়া মনে হয়। মনে হয় এমনটা একটা জীবনকে সে যেন এতকাল ঠিকভাবে ব্যবহার করে নাই। নিতান্ত এক শারীরিক মৃত্যুকে বহন, আর যেন তারই প্রতিক্রিয়ায় শশীর বেঁচে থাকার জগৎ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে। এর ফল স্বরূপ হারু ঘোষের মৃত্যুদৃশ্যটি উপন্যাসে ক্রমেই প্রতীকি তাৎপর্য লাভ করেছে। মৃত্যুকে বহন করে আনতে আনতেই তার চোখের সামনে আত্মমমতায় গড়া বেঁচে থাকার জগতের বিচিত্র দ্বন্দ্ব, অজস্র দ্বিধা, দুর্বার আকর্ষণ, যন্ত্রণাময় পরিণতি উন্মোচিত হয় হারু ঘোষ 'আকাশের দেবতার কটাক্ষে' সচল জীবন হারিয়েছে। চোখের পলকে লুপ্ত হয়েছে একান্ন বছরের আত্মমতায় গড়া চিন্ময় জগতটি।


শিশীর গ্রামে প্রবেশ শবদেহ বাহকদের সঙ্গে ‘জীবন প্রীতি' নিয়ে মৃত্যু ও জীবনের বিপরীত ছন্দে জীবিত শশীর ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার দ্বারা লেখক অস্তিত্ববান মানুষের জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজেছেন। মৃত হারুকে জীবিতের মতো দণ্ডায়মান দেখে লিকলিকে সাপ, শৃগাল, কাঠবেড়ালি কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছে এবং টের পেয়েছে হারু জীবিত নেই ; তারা অন্যত্র সরে গেছে। তেমনি জীবিত মানুষের প্রতিনিধি শশীও এই আকস্মিক মৃত্যু দেখে দুঃখবোধ করেছে কিন্তু দুঃখবাদী দার্শনিক তত্ত্বে আবিষ্ট হয়নি। মৃত্যুর সৎকার‌ ব্যবস্থায় দায়িত্ববান হয়েছে। তা দেখেই লেখক বলেছেন, 'নির্জন স্তব্ধ পথে শববাহী তাহারাই জীবনের সাড়া দিয়া চলিয়াছে। জীবনবাদী শশী যেন মৃত্যুর পটে জীবনমমতায় বাঁধা পড়েছে। শশী জীবন প্রেমিক। সেকথা লেখক বিভিন্ন প্রসঙ্গে একাধিকবার বলেছেন –‘মৃত্যু একজনকে এক একভাবে বিচলিত করে। আত্মীয় ও পরের মৃত্যুতে যারা মরা মানুষের জন্য শোক করে শশী তাহাদের মতো নয়।


শশী জীবন সম্পর্কে ছিল শ্রদ্ধাবান। কিন্তু দশ বছর গ্রামজীবনে বসবাস করতে করতে শশী উপলব্ধি করেছিল সমস্যাটা আসলে ঠিকমতো বাঁচতে না জানার সমস্যা। শশী চেয়েছিল জীবনটাকে নিজের ইচ্ছায় গড়ে নিতে, জীবনটাকে কবিতার মতো করে বাঁচতে কিন্তু বাস্তবে সে দেখল সে নিজে এবং তার পরিচিত যাদব পণ্ডিত, পাগলাদিদি, সেনদিদি, যামিনী কবিরাজ, বিন্দুবাসিনী, গোপাল, কুসুম সকলেই জীবনসন্ধানী হয়ে ঠিকমতো বাঁচতে না জেনে অজানা পথে বা ভুল পথে জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। শশীর মতো যে এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে থেকেছে, তার পরিণতি হয়েছে ক্লান্ত হতাশায় বিপন্ন। আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে গেছে—'মাটির টিলাটির উপর উঠিয়া সূর্যাস্ত দেখিবার শখে এজীবনে আর একবারও শশী আসিবে না।'


আমাদের স্বপ্ন হতে অশ্রু-ক্লান্তি রক্তের কণিকা ঝরে শুধু—এই চরম সত্য জেনেও জীবন প্রেমিক শশী হাসপাতালের কাজে নিজেকে সঁপে দেয়। খুঁজে বেড়ায় মানুষ ‘যারা আছে তাদের, আর যারা ছিল। জন্ম-মৃত্যুর রহস্যভেদ করে এভাবে চলার ছন্দকে অনুসরণ করেছে শশী।


শশী চিকিৎসক বলেই মৃত্যু তার কাছে একান্তভাবে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ ও বাস্তব। শশী এও জানে একজন চিকিৎসক হিসেবে মৃত্যুকে ক্ষণিকের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে পারে কিন্তু মৃত্যুর অনিবার্যতাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা তার নেই। সেকারণে বাড়ুজ্জ্যেদের ছেলে ভুতোকে বাঁচাতে পারেনি এমনকি সেনদিদিও মারা গেছে তারই সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে শশী জানে ‘দুচারজন মরিবে, দুচারজন জন্ম লইবে এই তো পৃথিবীর নিয়ম।


জৈবিক মৃত্যু রোগব্যাধিতে মৃত্যু ছাড়াও যাদব পণ্ডিতের ইচ্ছামৃত্যুর ঘটনা শশীর মনে জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা জাগায়। ডাক্তার হয়েও শশী সেই মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। গাওদিয়ার মানুষের মনে এমনকি নিজের পরিবারে সে উপলব্ধি করেছে ‘অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া মৃত্যুর আধিপত্য' শশী এদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছে 'সতেজ উত্তপ্ত জীবন ওদের সহিবে না।


শুধু দৈহিক মৃত্যু নয়, আত্মিক মৃত্যুও শশীকে আলোড়িত করেছে। কুসুম চিরকালের মতো গাওদিয়া ছেড়ে যাবার পর শশীকে জানিয়ে গেছে—'কুসুম কি বেঁচে আছে ? সে মরে গেছে। দশ বছর ধরে একা কুসুম শশীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে—'লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে আস্তে আস্তে তাও ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রেমের এই অপমৃত্যু শশীর স্বপ্নময় জীবনকে বড়ো রকম নাড়া দিয়েছে।


বিন্দুর মানসিক যন্ত্রণা, জৈবতৃষ্ট্বা শশীকে জীবনের নিদারুণ পরিণাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছে—সে ভাবিতেছিল তার আলমারীতে বোতলের পাশে লেবেল আঁটা বিষের শিশি ছিল, বিন্দু কেন সেদিন বিষ খাইল না?' বিন্দুকে বাঁচতে গিয়ে শশীকে পরাজিত হতে হয়েছে। ভীষণ রকম আত্মিক মৃত্যু দেখে শশীর স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। শশীর চোখের সামনে মৃত্যুর মিছিল একমাত্র জীবিত শশী বিপন্ন অস্তিত্বের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে গাওদিয়ার পথে মন্থর পদে হাঁটতে থাকে। তবু সে জীবন—পলাতক নয়, জীবনকে বড়ো বেশি ভালোবাসে বলেই ইচ্ছা, স্বপ্ন, সফলতা মৃত্যুর পরেও জীবনকে আঁকড়ে ধরে কাজ আর দায়িত্ব ছিল জীবনে, কাজ আর দায়িত্বের জীবনটা আবার ভরপুর হইয়া উঠিল।