গীতিকবি পি. বি. শেলীর কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।

রোমান্টিক যুগে শ্রেষ্ঠ গীতিকবি হলেন শেলী। ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির বন্দনা করেছেন তাঁর কাব্যে। কোলরীজ তাঁর ব্যালাডে অতীন্দ্রিয় রাজ্যের বারতা নিয়ে এসেছেন। বায়রণ ব্যাঙ্গাত্মক কাব্যেই তাঁর স্বকীয়তা খুঁজে পেয়েছিলেন। কীট্স সৌন্দর্যের পূজা করেছেন তাঁর ওডগুলিতে, আর শেলী তাঁর অপূর্ব সুরেলা গীতিকবিতায় স্বাধীনতা আর প্রেমের বন্দনা করেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি গীতিকবিতায় চিত্রকল্প উপমা ভাষার মাধুর্য এক সংগীতের মূর্ছনায় সমাবেশ। শেলীর স্কাইলার্কের সংগীতের মতো তাঁর গীতি কবিতাগুলিও স্বতঃস্ফূর্ত। শেলীর জীবন ছিল অত্যন্ত বেদনাময়। তাই তাঁর অধিকাংশ গীতি কবিতায় অশ্রুসজল কন্ঠের আভাস। শেলী সম্পর্কে সুইনবার্ন বলেছিলেন “The Perfect Singing God' তাঁর প্রত্যেকটি গীতিকবিতায় রয়েছে অপূর্ব সংগীত। গীতি কবিতা সাধনার ধন নয়। এ হল স্বতঃস্ফূর্ত। শেলীর প্রত্যেকটি কবিতায় রয়েছে সরলতা ও তীব্র আবেগ। ভাব ও ভাষার মণিকাঞ্চণ যোগ, আর রয়েছে নিজের মনের মাধুরী। জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছিলেন বলেই কোথাও কোথাও বিষাদের সুর ধ্বনিত, এই বিষাদের সুরকে বলা হয়েছে Lyriccry।


রচনাসমূহ : শেলীর প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনা Queen Mab (1813)। এতে রুশো ও গডউইনের চিন্তাধারার প্রভাবে বিশেষভাবে নজর পড়ে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি কবিতাটি রচনার কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ এই কবিতাখানি তাঁর নাস্তিকতার দর্শনভাবনায় সমৃদ্ধ হয়ে এই কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন। বৈভব, সমরশক্তি ও কুসংস্কারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে Queen Mob ছিল এক বিক্ষুদ্ধ তরুণ, যা কবিমানসের আর্ত প্রতিবাদ।


শেলীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাব্য Alastor (1816) এক রূপকধর্মী আত্মচর্বিত যার দ্বিতীয় শিরোনাম। গ্রিক শব্দ 'অ্যালাক্ষর' এর অর্থ প্রতিহিংসা পরায়ণ দানব। শেলীর কাব্যে নির্জনতা তথা নিঃসঙ্গতা সেই দানব এই কবিতার মুখ্য চরিত্র ভাববাদি ও আত্মসর্বস্ব কবিকে তাড়না করে হতাশা ও মৃত্যুর দিকে। নির্জনতা প্রিয় ও নির্বান্ধব নায়ক কবির দুঃখজনক পরিণতি নিয়ে। লেখা স্বপ্নরূপকে শেলী সম্ভবত নিজের অধ্যাত্ম জীবনে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন। সামগ্রিক অর্থে চিত্রকল্পের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যে Alastor-এর স্থায়ী আসন রোমান্টিক কাব্য সাহিত্যে।


১৮১৭ খ্রিঃ গ্রেট মার্লোয় বনবাসকালে শেলী নানাবিধ সামাজিক দুর্দশা ও পীড়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। এই সমস্ত রচিত হয় তাঁর “The Revolt of Islam. এটি অংশত দুর্বোধ্য এক প্রতীকি কাহিনি বীরাঙ্গনা সিয়না তার প্রেমিক ল্যাওনের বিপ্লবী প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয় এবং এক নিরুত্তেজ গোষ্ঠীসত্তায় বিদ্রোহের স্পৃহা সঞ্চার করে। মূলত কাহিনি বিন্যাসে ও গঠন প্রকরণে এখানে শেলীর দুর্বলতাই ফুটে ওঠে।


বিদ্রোহের আগ্নেয় আবেগ ও স্বাধীনতার জন্য অনিঃশেষ আকাঙ্ক্ষা সর্বোত্তম রূপ পেয়েছে শেলীর শ্রেষ্ঠ কীর্তি Prometheus Unbound (1820)। চার অঙ্কে সম্পূর্ণ এটি একটি নাটক। গ্রিক নাট্যকার ঈসকিলাসের নাটকের স্মরণীয় চরিত্র প্রমিথিউস এখানে বিপ্লবপ্রাণীত যুগমানসে বিচিত্র তাৎপর্যে প্রতিভাত হয়েছিল। শেলীর কাব্যে বীর প্রসিথিউস দেখা দিলেন এক অনমনীয় বিদ্রোহী সত্তারূপে যার মুক্তি এবং নায়িকা এশিয়ার সঙ্গে মিলন উদ্বোধন করল এক বিশ্বব্যাপী শান্তিপর্ব। এশিয়া এ কাব্যে প্রেমের আত্মস্বরূপ। এটি শেলীর শ্রেষ্ঠ নাট্যপ্রতিভার স্বাক্ষর।


পিশাতে বসবাসকালে শেলী পুনরায় উত্তীর্ণ হলেন রোমান্টিক কল্পনার জগতে। লিখলেন "The Witch of Atlas (1820), কিংবা Epipsy chidion (1821) এবং বেশ কয়েকটি লিরিক কবিতা। প্রথমে কবিতাটি এক সুন্দরী ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ডাকিনীর রূপকধর্মী কাহিনি ও দ্বিতীয়টি আদর্শ নারীত্বের প্রতি কবির আধ্যাত্মিক আবেগ চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ পেয়েছে।


পিশা পর্বেই শেলী লিখেছিলেন এক শোকগাথা Adonais (1821)। কবি কীটসের মৃত্যুতে এটি রচিত। কিছু বিয়োগের বিলাপ এখানে শেষপর্যন্ত রূপান্তরিত হয়েছে এক অমরত্বের দর্শনে। মৃত্যু যেখানে সর্বজনীন, অনন্ত শক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। পার্থিব জগতের প্রতিকূলতায় যে অ্যাডোনাইসের মৃত্যু ঘটেছে সে-ই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক এক অনন্ত শক্তির অংশে পরিণত হয়েছে।


গ্রিক স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দীপনায় শেলী লিখেছিলেন Hellas (1821) নাটকটি। এই গীতি নাটকের মুখ্য আকর্ষণ বন্দি গ্রিক নারীদের অনবদ্য গীতিময় সংলাপ। তাঁর সমসাময়িক স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি কবির সহমর্মিতা এই কাব্যে মিশে গেছে প্রাচীন গ্রিসের প্রতি তাঁর প্রশংসার শ্রদ্ধার মনোভাবে।


শেলীর সর্বশেষ রচনা ‘The Triumph of Life (1822)। একটি দুর্বোধ্য ও অসম্পূর্ণ কাব্য। এই অসম্পূর্ণতার কারণ শেলী ঝড় বৃষ্টিতে সমুদ্রে ডুবে আকস্মিক মৃত্যু। পাঁচ শতাধিক চরণের এই খণ্ডিত কাব্য রূপে গতিময়তায় বিশেষ দুরধিগম্য।


'Prometheus Unbound' রচনা করে কবি শেলী প্রতিভার শীর্ষে উপনীত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু বিশেষভাবে জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি সংক্ষিপ্ত কবিতায় তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বরমাধুর্যের জাদুকরি বৈশিষ্ট্যে আমাদের চমৎকৃত হতে হয়। ফ্লোরেন্সের নিকটবর্তী এক অরণ্য গোধূলি যখন আচ্ছন্ন হয়েছিল বৃষ্টিগর্ভ ঝোড়ো পশ্চিমা বাতাসে তখনই শেলী রচনা করেছিলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লিরিক—(Ode to the West Wind' উদ্ভাসিত স্বর্গলোকের বাসিন্দা বিদেহী স্কাইলার্কের আনন্দ সংগীত এবং তার বিপরীত সীমায়িত ও দুঃখময় মানবজীবন এ’ নিয়েই শেলীর ‘Toa Skylark' এই স্কাইলার্ক কবিকে তার স্বর্গীয় আনন্দের অংশীদার করলে পরই কেবলমাত্র কবি উজ্জীবিত করতে পারবেন সেই প্রেরণায় গোটা বিশ্বকে। আর 'The Cloud' শেলীর এক বিস্ময়কর ও নিখুঁত কবিতা—এক অসামান্য প্রকৃতি পুরাণ যাতে পৃথিবী ও সমুদ্রের কন্যা মেঘের নিত্য নব লীলারূপ এবং তার অমরত্বের রহস্য বিবৃত করেছেন কবি।


অবশেষে বলতে হয়, শেলী ছিলেন মানবদরদী। সমাজ, ধর্ম আর মানুষের গড়া সহস্র প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষের কণ্ঠ রোধ করে রেখেছে, শেলী সেই পুঞ্জীভূত আবর্জনার মাঝ থেকে নিয়ে আসতে চাইলেন মানুষকে উদাত্ত আলোকে, মুক্তির বাতাসে। শেলী তাঁর প্রত্যেকটি কবিতায় দূর শূন্যে দৃষ্টি রেখে ক্রমাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি আশাবাদী, চিরদিন তিনি এই আশাই পোষণ করেছেন যে বর্তমান যুগের সত্যাচার, অনাচার, একদিন দূর হয়ে যাবে। আজ দুঃখ দারিদ্র্যের শীত রয়েছে সত্য, কিন্তু বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। একদিন এই অপরিমেয় শূন্যতার পরিবর্তে বসন্ত তার মোহন ডালি নিয়ে এসে উপস্থিত হবে। বিশ্বে আবার স্বর্গরাজ্য নেমে আসবে। তাইতো, ম্যাথু আর্নল্ড শেলীকে বর্ণনা করেছিলেন এক সুন্দর ও ব্যর্থ দেবদূত রূপে। যিনি শূন্যে ঝাপটাচ্ছেন তাঁর উজ্জ্বল দুটি ডানা। তবে এই হতাশার নিরালোক, বিপন্নতা থেকে শেলী যাত্রা করেছেন নতুন আশার সূর্যালোকে।


জীবনী : অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণ করে শেলী (১৭৯২) ইটন স্কুলে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি সর্বপ্রকার অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন বলে তাঁকে উন্মাদ শেলী বলা হত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি ছাত্র ছিলেন তখন বেনামিতে দি নেসেসিটি অব অ্যাথইজম 'The Necessity of Atheissm) প্রকাশ করেন। নাস্তিক্যবাদের জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বিতাড়িত হন। তাঁর পিতাও তাকে বিতাড়িত করেন। হ্যারিয়েট পয়েষ্টব্রুক নামক একটি দরিদ্র কন্যাকে তিনি ভালোবেসে বিবাহ করেন। কিন্তু সংসারে তাঁর মন বসল না, সৌন্দর্য কল্পনা আর কবিতার জগতে তিনি আশ্রয় খুঁজলেন। ইংল্যান্ডে ভ্রমণকালে গডউইন অস্টিনের সপ্তদশী কন্যা মেরী শেলীর প্রেমে পড়েন। হ্যারিয়েট করে আত্মহত্যা। শেলী মেরীকে বিবাহ করে বার হয় ইউরোপ ভ্রমণে। পরিচয় ঘটে বায়রনের সঙ্গে। একদা বন্ধু উইলিয়ামস-এর সঙ্গে একটি নৌকা করে সমুদ্রে বেড়াতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ ঝড় শুরু হলে নৌকা গেল ডুবে। শেলীর মৃতদেহ কয়েকদিন পরে তীরে এসে পৌছাল (১৮২২)। সমুদ্রের তীরে তাঁর মৃতদেহ দাহ করা হল।