চৈতন্যচরিত সাহিত্য : রঘুনাথদাস গোস্বামী

রঘুনাথদাস গোস্বামী :

রঘুনাথভট্টের মতো চৈতন্যসঙ্গ লাভের দুর্লভ সৌভাগ্য এবং বৈরাগ্যের জন্মদত্ত অধিকার রঘুনাথদাস পাননি, অর্জন করেছেন। রামকেলি যাবার পথে অবস্থিত অদ্বৈত-ভবনে করুণাময় মহাপ্রভুর কিশোরের প্রতি আচরণ তুলনামূলকভাবে বেশ রূঢ় বলে মনে হয়

“স্থির হৈয়া ঘরে যাও না হও বাতুল।

ক্রমে ক্রমে পায় লোকে ভবসিন্ধু কূল ।।

মকর্টবৈরাগ্য না কর লোক দেখাইয়া।

যথাযোগ্য বিষয় ভুঞ্জ অনাসক্ত হইয়া ।।”


সম্ভবত কায়স্থকুল ও ধনীপরিবারের জন্মই এর জন্য দায়ী। প্রসঙ্গত স্মরণীয় ছয় গোস্বামীর মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্রাহ্মণেতর ব্যক্তি। সপ্তগ্রামের ভূস্বামী গোবর্ধনের একমাত্র পুত্র রঘুনাথ। বাল্যকালেই অদ্বৈত শিষ্য ও চৈতন্য ভক্ত কুলগুরু যদুনন্দন এবং হরিদাস ঠাকুরের সঙ্গলাভ। তাঁকে “বাল্যকাল হৈতে তিহোঁ বিষয়ে উদাস” দেখে পিতার আদেশে নজরবন্দী অবস্থায় গৃহে “একাদশ জন তারে রাখে নিরন্তর”। শুরু হল ইন্দ্র সম ঐশ্বর্য এবং অপ্সরা-সম স্ত্রী দিয়ে তাকে সংসারী করার চেষ্টা। কিন্তু সকলের যাতে সাধ তাতে ‘না’ করার জন্যই সাধকের সাধনা। সিদ্ধার্থকে ধরে রাখতে পারেননি শুদ্ধোধন, রাখতে পারেননি জোসাফটকে রাজা আবেন, পারলেন না ‘চৈতন্য বাতুল' রঘুনাথকে ধরে রাখতে গোবর্ধন। পানিহাটীতে নিত্যানন্দের কাছে উপনীত হলেন, দিলেন তার নির্দেশে ‘ভাণ্ডারা’ ভোগ, গেলেন তারপর রক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে চৈতন্যদর্শনে, গ্রামের পথে—

“পঞ্চ দশ ক্রোশ চলি গেলা একদিনে”।


অবশেষে এতদিনে উপবাসী ক্ষীণ ক্লান্ত রঘুনাথকে দেখে মহাপ্রভু “স্বরূপেতে কহে কৃপা—আর্দ্রচিত্ত হঞা। এই রঘুনাথে আমি সঁপিনু তোমারে। পুত্র ভৃত্যরূপে তুমি কর অঙ্গীকারে ৷৷” রঘুনাথভট্টের মতোই মহাপ্রভুর কাছ থেকে রঘুনাথ দাস পেলেন গুঞ্জমালা আর কৃষ্ণশিলা। স্বরূপ দামোদরের কাছ থেকে রঘুনাথের প্রাপ্তি ঘটল বৈষ্ণবদর্শন ও চৈতন্য-তত্ত্ব, মহাপ্রভুর কাছ থেকে হল ‘শিক্ষাষ্টক’ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন। তারপর শুরু হল কঠিন বৈরাগ্যে অভাবনীয় ব্যক্তি সাধনা। কখনো পুরীর মন্দির পরিত্যক্ত ভাতের কণা মাত্র ধুয়ে খেয়ে, কখনো “ছিণ্ডা কাণি কাথা” পরে, বিনিদ্র থেকে “সাড়ে সাত প্রহর” ধরে নাম-গান করে রঘুনাথ যেন তার ধনী-জীবনের গ্লানি ও অপরাধকে নিঃশেষে মুছে দিতে চাইলেন। বৈষ্ণবীয় আদর্শের এত নিখুঁত অনুসরণ দেখেই তাঁর শেষজীবনের সঙ্গী কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন “বৈরাগ্যের কথা তাঁর অদ্ভুত কথন।” দামোদর ও চৈতন্যদেবের তিরোধানের শোকে তিনি দেহত্যাগে পর্যন্ত উদ্যত হন, কিন্তু সনাতন রূপ “নিজ তৃতীয় ভাই করি নিকটে রাখিল।” বৈষ্ণবশাস্ত্র ও ভক্তিবোধে নিষ্ণাত রঘুনাথ বেশ কিছু সংস্কৃত স্তোত্র-কবিতা নাটকেরও রচয়িতা রূপে চিহ্নিত। “চৈতন্যাষ্টক’, ‘গৌরাঙ্গ স্তবকল্পবৃক্ষ’, ‘স্তবমালা’ এবং রূপগোস্বামীর ('দানকেলি কৌমুদী'র আদর্শে রচিত’) 'দানকেলিচিন্তামণি’ নাটক ও ‘মুক্তাচরিত্র’ চম্পুকাব্য তাঁরই সৃষ্টি। তাঁর চৈতন্যস্তবগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব মহাপ্রভুর, নীলাচল-লীলার শেষ ক’বছরের বিবরণদানে। মুরারিগুপ্ত, কবি কর্ণপুর, বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ, লোচনের লেখায় যে লীলা বর্ণনা অনুপস্থিত, একমাত্র এখানেই তার বর্ণনা উপস্থাপিত।


'শ্রীগৌরাঙ্গস্তবকল্পতরু’তে কৃষ্ণবিরহে বিহুল মহাপ্রভুর মধ্যে অষ্টাবিকার বর্ণনা প্রসঙ্গে রঘুনাথ মুখঘর্ষণে ক্ষত ও রক্তপাত পর্যন্ত বর্ণনা করেছেনঃ “ দধাদ্ভিভৌ শশদ্বদনবিধুঘর্ষেণ রুধিরং ক্ষতোথং গৌরাঙ্গো হৃদয় উদয়ন্মানং মদয়তি” (ষষ্ঠ শ্লোক) তার ‘স্তবকমালা’য় লক্ষ্যণীয়, প্রথমতঃ শ্রীরূপ-প্রমুখ গোস্বামীদের প্রতি অনুরাগের প্রকাশ, যেমন ‘প্রার্থনাশ্রয়-চতুৰ্দ্দৰ্শক’, ‘দ্বিতীয়তঃ’ ‘ব্রজবিলাসস্তব’, ‘বিলাসকুসমাঞ্জলি’ প্রভৃতির মধ্যে রঘুনাথের ব্যক্তিজীবনের কিছু বিষণ্ণ উদ্ঘাটন যেমন— “আমি বাৰ্দ্ধক্যরূপ দাবানলে দগ্ধ হচ্ছি ও ভয়ানক অন্ধতা রূপ কালসর্প আমাকে দংশন করছে এবং পরাধীনতা রূপ শাণিত শরে ও ক্রোধাদিরূপ সিংহসমূহে আবৃত হয়েছি।”


তাঁর নাটকগুলির মুখ্য লক্ষ্য, কৃষ্ণ ও গোপীদের আদিরসাত্মক ও ভক্তিভাব-নির্ভর লীলা-বর্ণনা। তবু চৈতন্যপ্রাণ এই গোস্বামীর নাটকের মঙ্গলাচরণে বা অস্তে শ্রীচৈতন্যের নাম বিস্মরণ চোখে না পড়ে পারে না। খুব সম্ভবত রূপ গোস্বামীর অনুসরণেই এই অনুল্লেখের কারণ। কেননা ‘মুক্তাচরিত্রে’র মধ্যে শ্রীচৈতন্যের ঈশ্বরত্ব বর্ণিত। এই নাটকে তিনি তাঁর কুলগুরু যদুনন্দনের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদনেও অকুণ্ঠিত, শ্রীরূপের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গ্রন্থটি সমাপ্ত। কিন্তু দুটি নাটকের কোথাও নিত্যানন্দ মহাপ্রভু বা বৃন্দাবন দাসের নাম নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বৃন্দাবন দাসের রচনাতেও রঘুনাথ দাসের নাম নেই, আছে শুধু “রঘুনাথ বৈদ্য আইলেন ততক্ষণে”। রঘুনাথ দাস গোস্বামীর জন্ম বা মৃত্যুর সঠিক তারিখ জানা যায় না। সনাতনরূপ ও রঘুনাথ ভট্টের পর সম্ভবত তাঁর দেহত্যাগ, ‘চৈতন্যচরিতামৃত' রচনা পর্যন্ত তার জীবিত থাকাও অসম্ভব নয়।