চার্লস ডিকেন্সের ঔপন্যাসিক চেতনার পরিচয় দাও।

বহু বিচিত্র চরিত্র সৃষ্টিতে, ঐকান্তিক সংবেদনশীলতায়, সামাজিক সংমিশ্রণে ডিকেন্স ইংরাজি উপন্যাস সাহিত্যের এক কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজি উপন্যাসে ক্রম পরিণতি ডিকেন্সের রচনায় সমৃদ্ধি ও জনপ্রিয়তার এক নবদিগন্তে উপনীত হয়েছিল উনিশ শতকের ভিক্টোরিয় ইংল্যান্ডে। রিচার্ডসনের আবেগাতিশয্য, ফিলডিং-এর বিস্তৃতি এবং স্মলেটের উৎকেন্দ্রিকতা এসে মিশেছিল মানবতন্ত্রী জীবন শিল্পী ডিকেন্সের উপন্যাস মোহনায়, অজস্র সহস্ৰ সজীব নারী পুরুষের এমন এক বিচিত্র ও মর্মস্পর্শী জগৎ ডিকেন্স উপহার দিয়েছেন যে, কেবলমাত্র শেকসপিয়রের পাশেই তাঁর স্থান। নানারকম পেশা, পশ্চাদপট ও সামাজিক অবস্থানের নারী পুরুষদের চরিত্র নির্মাণে ডিকেন্সের কুশলতা একাতীত, বাইরের সাজপোশাক চলন বলনের সঙ্গে সঙ্গে এদের মনোজগতের দিকচিহ্নগুলিও ডিকেন্স আলোচিত করেছিলেন। আর এর পাশাপাশি পাঠকদের আরও মুগ্ধ করেছিল ডিকেন্সের সরসতা তথা পরিহাস ও অশ্রু মিশ্রণ তাঁর সমাজ সংস্কারের স্পৃহা এবং সর্বোপরি তাঁর জীবনবোধের গভীরতা ও আন্তরিকতা, এছাড়া গল্প বলার ব্যাপারে ডিকেন্স ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সাধারণ মধ্য ও নিম্নবিত্ত জীবনের স্বাভাবিক পরিবেশের ছোটোখাটো আনন্দ বেদনার মুহূর্তগুলিকে ঔপন্যাসিক ডিকেন্স যেভাবে পরিস্ফুট করেছেন মানবিক অনুভূতির ছোঁয়ায় তা স্বভাবতই পাঠক হৃদয়ের আবেগ তন্ত্রীতে তীব্র অনুরণন তুলেছিল। সেই অনুরণন আজও অব্যাহত।


ডিকেন্সের রচনাসমূহ :

দারিদ্র্যতা, ব্যর্থ প্রেম, অমানুষিক পরিশ্রম ইত্যাদির দ্বারা প্রহৃত হয়েও ডিকেন্স চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নিজস্ব দক্ষতার গুণে ১৮৩২-এ সংসদীয় সংবাদদাতার কাজ পেলেন। পত্রিকার নাম 'The True Sun', তাঁর সাংবাদিক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা অবলম্বনে লিখতে শুরু করলেন ছোটো নকশাধর্মী কিছু রচনা 'Boz' এই ছদ্মনামে, ১৮৩৬ ৩৭-এ ধারাবাহিকভাবে রচনা করেন 'Sketches by Boz', এরপর তিনি লেখেন ১৮৩৬ এ সরস ধারাবাহিক নকশা Pickwick poper যার অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি ডিকেন্সকে দিয়েছিল লেখকের মর্যাদা। এরপর আর তাঁকে পিছনে তাকাতে হয়নি। একে একে প্রকাশিত হয়েছে—'Oliver Twist' (1838), Nicholas Nickleby (1839). The Old Curiosity Shop (1841) Barnaby Redge (1841) এ সমস্তই পাঠক দরবারে উপস্থিত হয়েছিল মাসিক কিস্তিতে ধারাবাহিকভাবে। এরপর ১৮৪২-এ ডিকেন্স গেলেন আমেরিকা ভ্রমণে, যার ফলশ্রুতি American Notes (1842). A Chrismas Caral (1843) সুইটজারল্যান্ডে ভ্রমণকালে Domby and Son (1848) Devid Copperfield (1849), এরপর একে একে বেরুতে লাগল Black House ( 1853) Hard Times (1854) Little Dorrit (1857), Tale of Two Cities (1850), Great Expectations (1861), Our Mutual Friend (1861) ইত্যাদি, ১৮৭০-এর ৮ জুন লিখতে লিখতে তিনি অসুস্থ ও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। পরের দিন তাঁর জীবনাবসান হয়।


ডিকেন্সের অবদান :

(১) মানবতন্ত্রী ডিকেন্স: পাঠক সাধারণের কাছে ডিকেন্সের ধারাবাহিক রচনার জনপ্রিয়তা ছিল প্রবাদপ্রতীম। তাঁর উপন্যাসের জগৎ এক বিচিত্র, উদ্ভট, মনোরম জগৎ যা বহু মানুষের বেশভূষা, আচার-আচরণ, স্বভাব মানসিকতার বিভিন্নতায় অতীব আকর্ষণীয়। ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ হাস্য পরিহাসের যে কমেডি জগৎ নির্মাণ করেছেন ডিকেন্স সেখানে বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণার ঘোর লেগেছে কদাচিৎ মানবতন্ত্রী ডিকেন্স তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির উদারতায় জীবনবোধের ব্যাপ্তিতে, পর্যবেক্ষণের আন্তরিকতায় এক রসময় স্পন্দমান মানব জগৎ উপহার দিয়েছেন।


(২) চরিত্রশিল্পী ডিকেন্স : ডিকেন্সের বাস্তবতাবোধ ও প্রখর পর্যবেক্ষণ শক্তি সর্বজন স্বীকৃত। সংখ্যায় ও বৈচিত্র্যে অবিস্মরণীয় ডিকেন্সের চরিত্রসমূহ তার সাক্ষর বহনকারী। যে কোনো জনপ্রিয় কথাশিল্পীর জনপ্রিয়তা তাঁর সৃষ্টি চরিত্রগুলির অমরত্বের ওপর নির্ভরশীল। এ বিষয়ে ডিকেন্সের সাফল্য পৌঁছেছিল কিংবদন্তীর পর্যায়ে। তিনি বেশ কয়েক শ্রেণির চরিত্র নির্মাণ করেছেন। 


  • (ক) নিরপরাধ জিশু চরিত্র যেমন—অলিভার টুইস্ট, পল্‌ ডোম্বী, পেল ইত্যাদি। 

  • (খ) কয়েকটি দুবৃত্ত চরিত্র যেমন—ক্যাডিন, উরীয়া হীপ, বিলসাইকস ইত্যাদি।

  • (গ) হাস্যোদ্দীপক চরিত্র যেমন—মিকবার, স্যামওয়েলার। 

  • (ঘ) সেইসব চরিত্র যারা একদা অতি সাধারণ মানুষ ছিল পরে অসাধারণ হয়ে উঠেছে। অবশ্য তাঁর উপন্যাসে অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় অনুপস্থিত।


(৩) সংলাপ রচনায় ডিকেন্স : এক ভাবে ডিকেন্স তাঁর চরিত্রগুলিকে সজীবতা দিয়েছিলেন তা হল সংলাপের চমকপ্রদ ব্যবহার। নাট্য ও নাট্যাভিনয় সম্পর্কে ডিকেন্সের বিশেষ আগ্রহ ছিল আর সেই আগ্রহের প্রতিফলন ঘটেছিল সংলাপ রচনায়। মিকবার ও উরিয়া হিপের মতো চরিত্র তো তাদের সংলাপের বৈশিষ্ট্যেই স্মরণীয়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের যে ঘাটতি ডিকেন্সের ছিল তার অনেকখানিই পূরণ হয়েছিল সংলাপের মনোহারিত্বে।


(8) হাস্যরস ও করুণরসের মিশ্রণ : বৈপরীত্য বা স্ববিরোধ যা থেকে কমেডির হাস্যরসের জন্ম, তাকে ডিকেন্স প্রকাশ করেছেন কল্পনার সংবেদনে, ভাষা ও সংলাপের প্রাথর্য ও সরসতা পরিণত হয়েছে তাঁর গদ্যশৈলীর একান্ত বৈশিষ্ট্যে। ডিকেন্সের হাস্য পরিহাস তাঁর চরিত্রসমূহের বাহ্যিক বা আচরণগত উৎকেন্দ্রিকতাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে এবং তাতে আতিশয্য যথেষ্ট স্পষ্ট। তবে চারিত্রিক উৎকেন্দ্রিকতা ছাড়াও পরিস্থিতি ও সংলাপে ডিকেন্সের রচনায় হাস্যরসের অন্য দুই উৎস।


(৫) সমাজ সংস্কারক ডিকেন্স : ব্যক্তি মানুষের বহুবিচিত্র বৈশিষ্ট্যের প্রতি ডিকেন্সের যে আগ্রহ তার বৃহত্তম পটভূমি মানুষের সামাজিক জীবন, আর তাঁর সময়কার সমাজজীবনের বাস্তবানুগ চিত্র ডিকেন্সের উপন্যাসের অন্যতম সম্পদ। দরিদ্র ও দলিত মানবাত্মার ক্রন্দন ও তার নিরসনের দাবি সর্বদা প্রতিধ্বনিত হয়েছে ডিকেন্সের রচনায়। নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও সামাজিক আবেগের আলোকে সামাজিক অন্যায়, দমন পীড়ন অনাচারকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এই সংস্কার প্রবণতা কোথাও খুব উচ্চাকিত প্রচারে পরিণত হয়ে তাঁর উপন্যাস শিল্পের ক্ষতিসাধন করেনি। তাঁর চরিত্রের ও ঘটনার বাস্তবতা সর্বদাই অক্ষুণ্ণ থেকেছে।


(৬) রচনাশৈলী : ডিকেন্সের ভাষা ও শৈলী পরিপাটি বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ নয়, কিন্তু মোটের উপর পরিচ্ছন্ন ও সাবলীল, তাঁর গদ্যের প্রাণ তাঁর রসবোধের বিশিষ্টতা যা নাটকীয়তার প্রসাদগুণ সমন্বিত, তাঁর নিখুঁত ও বাস্তব পর্যবেক্ষণলব্ধ বর্ণনা এই সরসতায় মণ্ডিত, আবার এই সররতার প্রান্ত ছুঁয়ে তাকে অশ্রু ও বেদনা। তাঁর গদ্য আড়ম্বরপূর্ণ না হলেও তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য, প্রাঞ্জলতা, কাব্যিকতা ও সর্বোপরি সরসতা পাঠকমনে চির ভাস্বর হয়ে থাকে।


তবে পরিশেষে বলতে হয়, ডিকেন্সের ভাবাতিশয্য ও অতিনাটকীয়তা এবং একমাত্রিক চরিত্র সৃষ্টির প্রবণতা কিছুটা ত্রুটির সঞ্চার করলেও তা এত বাহ্য আর আদর্শবাদী ঝোঁকে বিষয়ে এটুকু বলা যায় যে কেবলমাত্র বস্তুতান্ত্রিকতা ডিকেন্সের লক্ষ্য কখনোই ছিল না। বরং বলা যায় এধরনের রোমান্টিকতা, জীবন সম্পর্কে এক আশাবদ্ধ তাঁর সমস্ত চরিত্র তথা ঘটনা ও দৃশ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, শেষ বিচারে ডিকেন্স তাই এক মানবতাবাদী জীবনশিল্পী।