ঔপন্যাসিক রূপে মুন্সী প্রেমচন্দের কৃতিত্ব নিরূপণ করো।

আধুনিক হিন্দি কথা সাহিত্যের জনক রূপে মুন্সী প্রেমচন্দের অবদান অপরিসীম। তার সাহিত্য জগতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই উপন্যাসে এক নতুন ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করে। প্রাচীন পন্থী সংকীর্ণ মনোবৃত্তি, পর্দা প্রথার সমর্থন, সহশিক্ষা ও বিধবা বিবাহের বিরোধিতা ইত্যাদি প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব তখন আমাদের সমাজে বিদ্যমান ছিল। প্রেমচন্দই সর্বপ্রথম এইসব কুসংস্কার এবং প্রতিক্রিয়াবাদী শক্তির বিরুদ্ধাচরণ করে হিন্দি উপন্যাসকে বাস্তবের জমির উপর দাঁড় করালেন।


১৮৮০ খ্রিঃ উত্তর প্রদেশের বারাণসীর নিকটবর্তী লহমী গ্রামে এক সাধারণ পরিবারে তার জন্ম হয়। মাঠে ময়দানে ঘুরতে ঘুরতে অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যেই তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিল। সনাতন ধর্মী কার্যকলাপের মধ্যে 'আর্যসমাজের কার্যকলাপকে তিনি পছন্দ করতেন। মহাত্মা গান্ধির ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা আন্দোলনের উদত্ত আহ্বান এবং নৈতিক আচার-আচরণ তাকে প্রভাবিত করেছিল। অল্প বয়সেই তার পিতৃবিয়োগ ঘটে, ফলে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি নিতে বাধ্য হন। কিন্তু তার একনিষ্ঠ অধ্যাবসায় তার পড়াশোনায় বিরতি ঘটাতে পারেনি। তিনি পরবর্তীকালে বি. এ. পাস করেন এবং শিক্ষা বিভাগের পদে পরিদর্শকের (S. I of Schools) পদে উন্নীত হন।


উপন্যাস সমূহ : তাঁর উপন্যাস সমূহের মধ্যে—সেবাসদন (১৯১৮) প্রেমাশ্রম (১৯২২), বঙ্গভূমি (১৯২৪), কায়াকল্প (১৯২৬), গবন (১৯৩০), কর্মভূমি (১৯৩২), গোদান (১৯৩৬) বিশেষ উল্লেখযোগ্য, এছাড়া তিনি প্রায় ৩০০টি ছোটোগল্প রচনা করেছেন যার কয়েকটি আবার আকারের দিক থেকে উপন্যাস তুল্য।


সেবা সদন : মুন্সী প্রেমচন্দের এটি প্রথম হিন্দি উপন্যাস, যেটিকে তিনি “হিন্দি কা বেহতরীন নবেল’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। এই উপন্যাসে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা দেহব্যাবসা, অসবর্ণ বিবাহ, বেশ্যাবৃত্তির উল্লেখ রয়েছে। ঘটনাটি এমন–সুমনের বিবাহ হয়েছিল বয়স্ক গজাধরের সঙ্গে, স্বামীর সন্দেহপ্রবণ প্রবৃত্তি সুমনকে বেশ্যাতে রূপান্তরিত করল, সুমনকে বেশ্যাতে পরিণত করার পিছনে তার পরিবার ও সমাজের এক বড়ো ভূমিকা ছিল। সুমনের মধ্যে ছিলনা ধর্মশিক্ষার সুযোগ না আনন্দ দানের শিক্ষা। কালের অমোঘ নিয়মে সেই গদাধর একদা সাধু হয়ে যায়। সুমন নিজের স্বামীর সঙ্গে সেবাসদন স্থাপন করেন, সেই সেবাসদনে একে একে ঠাঁই হতে থাকে বেশ্যাদের। যা ছিল নৈতিক শিক্ষাদানের প্রতিষ্ঠান। মূলত এটি আদর্শবাদী উপন্যাসে পরিণত হয়।


প্রেমাশ্রম : প্রেমাশ্রমের কথাবস্তু সেবাসদনের থেকে পৃথক, কিন্তু উভয় উপন্যাসেই আশ্রম প্রতিষ্ঠার কথা আছে একটিতে সেবাসদন, অন্যটিতে প্রেমাশ্রম। প্রেমাশ্রমে প্রেমের মাধ্যমে হৃদয় পরিবর্তন দ্বারা সমাজের আর্থিক বৈষম্যকে অপসারণ করে রামরাজ্যের স্থাপন করা। প্রেমাশ্রমে রয়েছে গান্ধিবাদী প্রভাব এবং বলশোভিক বিদ্রোহের প্রভাব, প্রকৃতপক্ষে ‘প্রেমাশ্রম' হিন্দির প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস।


বঙ্গভূমি : বঙ্গভূমি উপন্যাসে সর্বহারা এবং পুঁজিপতিদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ চিত্রিত হয়েছে। জমিদার ও পুলিশ সেখানে পুঁজিপতিদের সহায়ক রূপে উপস্থিত। মহাত্মা গান্ধি দেশে উদ্যোগীকরণের বিরোধী ছিলেন। এই বিশাল দেশের বিপুল জনসংখ্যার যথার্থ প্রয়োগ হতে পারে কেবলমাত্র কুটীরশিল্পের মাধ্যমে, এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু হল উদ্দোগীকরণের বিরোধ। মূলত উপন্যাসের মধ্যে লেখকের ধারণা পোষিত হয়েছে—'নতুন যুগের হাওয়া সব কিছুকে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে, পুরাতন যুগ আর ফিরবে না।


কায়াকল্প : কায়াকল্প প্রেমচন্দের প্রথম উপন্যাস যার পাণ্ডুলিপি হিন্দিতে পাওয়া গেছে। এই উপন্যাসে মহেন্দ্র কুমার পুনর্জীবন লাভ করে, জমিদার মহল আবার ফিরে আসে। কিন্তু এই মহলের মধ্যে দেবপ্রিয়ার অলৌকিক এবং অতিরঞ্জিত প্রসঙ্গ অবিশ্বাসের পর্যায়ে উপনীত। হিমালয় বাণী মহাত্মার চমৎকারিত্ব অদ্ভূত। তিনি পূর্বজন্মের স্মৃতিকে রোমন্থন করেছেন এবং বৃদ্ধাকে তরুণী রূপে পরিবর্তন করে নেন। প্রেমিক যুগল আনন্দের সঙ্গে বিচরণ করতে থাকেন।


গবন : এখানে মধ্যবিত্তের অভাব অভিযোগকে উদ্ঘাটন করা হয়েছে। মধ্যবিত্তেরা চাকচিক্যের অন্তরালে তাদের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলিকে আবৃত করে রাখতে চায়। লেখক তাঁর সুনিপুণ লেখনীর দ্বারা সুচারু রূপে মধ্যবিত্ত সমাজের নগ্ন রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন।


কর্মভূমি : এখানে প্রেমাশ্রমের মতো কিষাণ ও মজদুর উভয় শ্রেণির সংঘর্ষের কাহিনি চিত্রিত। প্রেমাশ্রমে কৃষকেরা ঐক্যবদ্ধ ছিলনা কিন্তু এখানে কৃষকেরা সংগঠিত তাদের এক মধ্যবিত্ত নেতাও এখানে পাওয়া গেছে।

প্রতিজ্ঞা (১৯০৭), নির্মলা—এ দুটি উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু হল নারী জাতির সমস্যা, পণপ্রথা রূপ সামাজিক অভিশাপের কথাই নির্মলা উপন্যাসের উপজীব্য। অসম বিবাহ নারী জীবনে কী দুর্গতির সূচনা করতে পারে এবং তার পরিণতি কত দুঃখময় হতে পারে তা ‘নির্মলা' উপন্যাসে জ্বলন্তরূপে প্রতিভাত হয়েছে।


গোদান : এটি প্রেমচন্দের অন্তিম ও সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এতে জীবনের অনুভূতি এবং জগতের সারবস্তু বিদ্যমান। এককথায় বলতে গেলে এই উপন্যাসে লেখক নিজের কৃতিত্বের পরিপূর্ণ স্বাক্ষর রেখেছেন। সমালোচকরা এই উপন্যাসটিকে “কৃষক জীবনের মহাকাব্য রূপে অভিহিত করেছেন। বিষয়বস্তুর ব্যাপকতায়, বাস্তবানুগ অনুভবের গভীরতায় চরিত্র সমূহের সজীবত্ব এবং বিশ্বাসযোগ্যতায় এবং অভিজ্ঞতার নিবিড় সাহচর্যে প্রেমচন্দের উপন্যাসগুলি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে...। কেবলমাত্র হিন্দি সাহিত্যের নয়, এমনকি সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যের সীমানাকে অতিক্রম করে লেখকের আলোচ্য উপন্যাসসমূহ বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবার দাবিদার।