পুতুলনাচের ইতিকথায় গ্রাম ও নগরের দ্বন্দ্ব আলোচনা করো।

গ্রাম থেকে যে মানুষ শহরে যায়, শহরের জীবনকে শহরের সভ্যতাকে নিজের মতো করে মানিয়ে নেয়, ভালোবেসে সে শহরেই থাকতে চায়। যতই গ্রামের কোমল মাটির শীতল ছায়াত তার অন্তরাত্মার শেকড় প্রোথিত থাকুক না কেন তবু সে যখন গ্রামে ফিরে যায় তখন শুরু হয় সেই মানুষের স্থানিক অস্তিত্বের টানাপোড়েন। গ্রাম ও নগরের দুই জীবনকে আত্মস্থ করার পর সে মানুষ নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়! একের ভেতর জন্ম হয় আর এক মানুষের। পুতুলনাচের ইতিকথায় শশীর জীবন বিপন্ন বিস্ময়ের মতোই দ্বিধাদ্বন্দ্ব পায়ে পথ পরিক্রমায় নামতে বাধ্য হয়েছে। দুই জীবনেই তার আকর্ষণের বিষয়।


‘পুতুল নাচের ইতিকথা' প্রকাশকালে দেশ ইংরেজ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ—সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অধীন। বিশ শতকের প্রারম্ভে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে শহরের আকর্ষণ করছে। তারা ভাগ্যান্বেষণে, জীবিকার সন্ধানে শহরে আসছে। কারণ বণিক ইংরেজের অর্থনীতি ছিল শহরকেন্দ্রিক। জীবনযাত্রায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও শহরে বেশি ছিল। ইংরেজ শিক্ষার মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। সেখানে নিত্য নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হচ্ছে। গ্রামের সম্পন্ন পরিবারের তরুণেরা সেই শিক্ষা নিতে শহরে আসছে। আবার গরিব ঘরের মানুষেরা কলকারখানায় কর্মের সংস্থানে শহর অভিমুখী হচ্ছে। এই প্রবণতার ফলে গ্রামজীবন ক্রমেই হতে লাগল শ্রীহীন নিঃস্ব। সেই উপনিবেশিক ফিউডাল শাসন নিয়ন্ত্রিত গ্রাম ও শহরের জীবনের ছুটি রূপ পুতুলনাচের ইতিকথায় ফুটে উঠেছে।


গ্রাম্যতা ও নাগরিকতা-দুটো পৃথক মানসিকতা এবং তা অবস্থানগত নয়—ভাবগত। গ্রাম্যতা বলতে বুঝি অশিক্ষা, অজ্ঞতা, প্রথানুগত্য, কুসংস্কার ও নিশ্চেষ্টতা। নাগরিকতা অর্থ শিক্ষা, যুক্তিনিষ্ঠা, মার্জিত রুচিবোধ, কর্মতৎপরতা। গ্রামে বাস করেও কেউ গ্রাম্যতা দোষমুক্ত হতে পারে আবার নগরবাসীও গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট হতে পারে। সারল্য, অকপটতা, অকৃত্রিমতা—গ্রামীণ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। জটিলতা, কপটতা, কৃত্রিমতা নাগরিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তবে ওগুলিকে সাধারণ বৈশিষ্ট্য না বলে বিশেষ প্রবণতা বলাই ভালো। শশীর বাবা গোপালের মতো কূট কৌশলী মানুষ সারাজীবন গ্রামেই বাস করেছে। আবার বনবিহারীর মতো সরল বিষয়বুদ্ধিহীন মানুষও নগর জীবনযাপন করেছে।


উপন্যাসে গ্রাম ও শহরের পুনর্বিন্যাসের রূপরেখাটি সুঅঙ্কিত। প্লটের ঘটনা স্থান প্রধানত গাওদিয়া গ্রাম হলেও নানা পথে কলকাতার আলো বাতাস সেখানে পৌঁছেছে, গ্রামীণ চরিত্রগুলি অনেকেই শহরে গেছে এবং নগরজীবনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আবার শহরবাসী মানুষও গাওদিয়াতে এসেছে। তারা গ্রামজীবনের সরল সজীবতায় আকৃষ্ট হয়েছে—কিন্তু কেউ গ্রামে বাধা পড়েনি। কুমুদ মতিতে এবং নন্দ বিন্দুকে নগরজীবনের কোলাহলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে।


গাওদিয়ার সরলচিত্ত ভালো ছাত্র সম্পন্ন গৃহস্থ ঘরের ছেলে শশী উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় গেল। কলেজে ভর্তি হয়ে সে নাগরিক শিক্ষা সংস্কৃতির পরিচয় পেল। বন্ধু কুমুদ তার দৃষ্টি খুলে দিল। বিশ্বসাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান ইতিহাসের সঙ্গে তার পরিচয় হল। শশীর মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন এল। বন্ধু কুমুদের সাহচর্যে সে সংস্কার মুক্ত নাগরিকচিন্তা ও মনন অর্জন করল। শশী ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরে এল। দৈব ও অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম পরিবেশ তার কাছে এখন অসহনীয়। যে গ্রামে একটিও লাইব্রেরি নেই সেখানে সে কী করে বাস করবে? মুক্তবুদ্ধি ও বিজ্ঞানচেতনা দিয়ে চারপাশের চেনা মানুষগুলির অন্ধবিশ্বাস ও প্রথানুগত্য সে ভাঙতে চেয়েছে। সে ডাক্তার হিসেবে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে। যামিনী কবিরাজের বাধা তুচ্ছ করে সেনদিদির চিকিৎসা করেছে এবং মৃত্যুর হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছে। সূর্যবিজ্ঞানের প্রবক্তা যাদবের সঙ্গে সংলাপে শশীর নাগরিকচিন্তা ও মননের পরিচয় পাই। নিজের ঘোষিত ইচ্ছা মৃত্যুর দিন সত্য প্রমাণিত করতে যাদব ও তার স্ত্রী অনেকটা আফিম খেল। ইচ্ছা মৃত্যুর কথা শুনে আলৌকিকতায় বিশ্বাসী মানুষের ঢল সেখানে নেমেছে। লেখক গ্রাম সমাজের বিশ্বাস অবিশ্বাসের চমৎকার ছবি এঁকেছেন। এই ইচ্ছামৃত্যু যে যাদবের আত্মহনন শশী তা বুঝেছিল। বহু যুক্তি দিয়েও সে যাদবকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। খ্যাতির মোহ তার কাছে তখন প্রাণের চেয়েও মূল্যবান। সারাজীবন সূর্যবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে ও যাদব কিন্তু উইল করে তার সমস্ত সম্পদের দায়িত্ব শশীকে দিয়ে গেল। সেই অর্থের গ্রামে শশী আধুনিক চিকিৎসার উপযুক্ত হাসপাতাল গড়ে তুলল। শশী গ্রামকে সত্যিকারের নাগরিকতায় উন্নীত করেছে। কাশীর বাবা গোপাল গ্রামে থেকেও নতুন যুগকে চিনেছেন। ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে সেই ডাক্তার করেছে। চরিত্রটির মধ্যে গ্রাম ও নগর মানসিকতার জটিল মিশ্রণ দেখা যায়। প্রখর বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন গোপাল অর্থলোভে সুন্দরী সেনদিদির বিয়ে দিয়েছিল বৃদ্ধ যামিনীর কবিরাজের সঙ্গে। সেনদিদির সঙ্গে তার জটিল সম্পর্ক। এর পরিণামেই একটি সদ্যোজাত শিশুকে রেখেই সেনদিদির মৃত্যু হয়। গোপাল শশীকে সব দায়িত্ব পাট দিয়ে সেই শিশুটিকে নিয়ে একদিন কাশীর নগর জীবনে ফিরে গেল।


নগর অপসংস্কৃতির ছবি আঁকা হয়েছে দুটি চরিত্রকে নিয়ে শশীর বন্ধু কুমুদ ও ভগ্নীপতি নন্দ। কুমুদ জটিল নাগরিক স্বভাব বিশিষ্ট। সে মুক্তবুদ্ধি, কাব্য সাহিত্যরসিক দক্ষ অভিনেতা, আবার নগর জীবনের বিলাসব্যসন উচ্ছৃশৃঙ্খলতা কপটতাও প্রতারণায় সে অভ্যস্ত। জুয়াখেলা, বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়া, লোকের পাওনা না মেটানো, স্ত্রীর গয়না বিক্রির করায় তার নীতিবোধ একটুও আহত হয় না। সে দায়িত্বহীন তবে হৃদয়হীন নয়। মতির প্রতি তার আবেগ ও ভালোবাসা সত্য ও অকৃত্রিম।


নন্দ সেকালের এবং চিরকালের ভোগবাদী নগর সভ্যতার সৃষ্টি। গ্রামের মেয়ে বিন্দুকে সে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। এর দণ্ড হিসাবে স্ত্রীকে নিষিদ্ধ পল্লীর একটি বাড়িতে সে রক্ষিতার জীবনযাপনে বাধ্য করে। জোর করে মদ ধরিয়ে নাচগান শিখিয়ে নিজের স্ত্রীকে সে বাঈজীতে পরিণত করেছে। বিন্দুকে নগর জীবনের পঙ্ককুণ্ড থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করে শশী ব্যর্থ হয়েছে। শেষদিকে নন্দের স্বভাবে একটা শুভ পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তখন নাগরিক ব্যাধি বিন্দুর রক্তমজ্জায় মিশে গেছে।


শশী-কুসুম-পরাণকে নিয়ে যে বৃত্তটি আঁকা হয়েছে তাতে গ্রামসমাজের সরলতা অকপটতা অকৃত্রিমতার দিকটি স্পষ্ট হয়েছে। কুসুমের অকপট-সরলতা ও অমার্জিত মুখরা স্বভাব একান্তই গ্রামীণ। পরাণের চরিত্রেও দেখি নিখাদ গ্রাম্য সরল্য পরনির্ভরতা ও নিশ্চেষ্টতা। বনবিহারী নগরবাসী হয়েও নগর জীবনের গ্লানিমুক্ত। জয়া বনবিহারী উপবৃত্তটি নতুন নগরে আদর্শ শিল্পীর প্রতিষ্ঠা অর্জনের বাধাকে স্পষ্ট করেছে। কুসুম বাবার কথায় সবাইকে নিয়ে গাওদিয়া ছেড়েছে। জয়ার সংসারে ব্যর্থশিল্পী বনবিহারীর মূল্য ফুরিয়েছে। শশী গ্রামনগরের এই পুনর্বিন্যাস লক্ষ্য করেছে। এবং সাধ্যমত এর মধ্যে সমন্বয় এনে গ্রামকে গ্রাম্যতা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছে। অপসংস্কৃতি মুক্ত যথার্থ নাগরিকতায় উন্নীত করে সে গ্রামকে আদর্শ বাসযোগ্য করে তুলতে চেয়েছে। এই সংকল্প নিয়েই বিলেতে না গিয়ে সে গাওদিয়াতে থেকে গেল। গ্রামনগরের এমন দ্বৈত অথচ পূর্ণাঙ্গ, গ্রাম ও নগরের অস্তিত্বের এমন দোলাচল দ্বন্দ্বময় ছবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম আঁকলেন। বিভূতিভূষণ গ্রামের বাস্তবমুখর ছবি আঁকলেও গ্রাম নগরের এমন দ্বন্দ্বের পীড়া তাতে নেই। গ্রাম ও নগরের দুই সভ্যতার মিশ্রণ, বিমিশ্রণ, ও দ্বান্দ্বিক ছবি বাংলা উপন্যাসে নিপুণভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথাতেই প্রথম আঁকা হল।