“ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য সাহিত্য প্রধানত ভাষায় মধ্যে দুইটি জিনিসকে মিশাইয়া থাকে, চিত্র এবং সংগীত।”—আলোচনা করো।

“চিত্র ও সংগীতই সাহিত্যের প্রধান উপকরণ। চিত্র ভাবকে আকার দেয় এবং সংগীত ভাবকে গতি দান করে।"
“অপরূপকে রূপের দ্বারা ব্যক্ত করিতে গেলে বচনের মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করিতে হয়।”

ভূমিকা হিসাবে জীবনানন্দ দাশের একটি মন্তব্যকে উদ্ধৃত করে উপস্থিত আলোচনাটির অবতারণা করা যেতে পারে :


‘সৃষ্টির ভিতরে মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন অঘ্রান, এমন মানুষের বা অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়—কিংবা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয়, যে মনে হয় এই সমস্ত জিনিসই অনেকদিন থেকে প্রতিফলিত হয়ে কোথায় যেন ছিল, এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়, সংহত হয়ে, আরও অনেক দিন পর্যন্ত, হয়তো মানুষের সভ্যতার শেষ জাফ্রাণ রৌদ্রালোক পর্যন্ত কোথাও যেন রয়ে যাবে; এই সবের অপরূপ উদ্‌গীরণের ভিতরে অনুভূতির জন্ম হয়; নীহারিকা যেমন নক্ষত্রের আকার ধারণ করতে থাকে তেমন বস্তুসংগতির প্রসব হতে থাকে যেন হৃদয়ের ভিতরে ; সেই প্রতিফলিত অনুচ্চারিত দেশ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে ওঠে যেন, সুরের জন্ম হয়; সেই বস্তু ও সুরের পরিণয় শুধু নয়, কোনো মানুষের কল্পনামনীষার ভিতর তাদের একাত্মতা ঘটে—কাব্য জন্ম লাভ করে।


বাহিরের জগৎ আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করে আরেকটা জগৎ হয়ে উঠছে, রবীন্দ্রনাথের সে কথাটার ব্যাখ্যা ও বর্ণনা এর চেয়ে আর স্পষ্ট করে বলা যায় না বুঝেই জীবনানন্দের শরণ নিতে হল। তবে তিনি যে ভাবনা বা উপলব্ধির অলৌকিক জননের কথা বলেছেন, সেটা একমাত্র কাব্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, যাবতীয় আর্ট ভাবনারই ভ্রুণ হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত এই। তবে শুধুই ভ্রুণ হয়ে ওঠার। কেননা, তিনি যে 'কাব্য জন্ম লাভ করে? বলেছেন, তখনো পর্যন্ত কাব্যের সেই জন্মলাভ ঘটেছে কেবলমাত্র কবির মনোলোকে। কাব্যের আসল জন্মলাভ ঘটে তখনই ; যখন সেই অপরূপ কাব্য-ভাবনা বা কল্পনামনীষা আধারিতা হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, অর্থাৎ যখন তা ভাষা শরীর গ্রহণ করে, তখন। তার আগে নয়।


কিন্তু সাধারণ ভাষার কাজ তো শুধু হচ্ছে খবর জারি করা, reporting, একজনের একটা মামুলি ব্যবহারিক বক্তব্য দ্বিতীয় বা অপর ব্যক্তির জ্ঞানগোচর বা বুদ্ধিগোচর করা। কিন্তু খবরটাই যেখানে শুধু অসাধারণ নয়, অপরূপ ও অলৌকিক, এবং অনির্বচনীয় একটা অভিজ্ঞতার, সেটাকে বুদ্ধিলোক পার করে অপরের অনুভব এবং মনোগত উপলব্ধিতে পৌঁছে দেওয়া যাবে কী উপায়ে ? এখানে একটা কথা কিন্তু আমাদের আগে থেকেই পরিষ্কার বুঝে রাখা দরকার। 'অনির্বচনীয়' কথাটার মানে কিন্তু আদৌ 'অভাবনীয়' নয়, সেকথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই আমাদের অদ্ব্যর্থ ভাষায় অবহিত করে দিয়েছেন। “তা যদি হত তাহলে ওটা কাব্যে অকাব্যে কুকাব্যে কোথাও কোনো কাজে লাগতো না। বস্তু পদার্থের সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায়, কিন্তু রস পদার্থের করা যায় না। অথচ রস আমাদের একান্ত অনুভূতির বিষয়। তাই ওটা অনির্বচনীয়।” (ছন্দ) তা সে যাই হোক, কিন্তু অনুভূতির বিষয়টাকেই বা বাচ্য করা যায় কীভাবে ?


নিজের প্রশ্নের উত্তর রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিয়েছেন। “ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য, সাহিত্য প্রধানত ভাষার মধ্যে দুইটি জিনিস মিশাইয়া থাকে—চিত্র এবং সংগীত। তদুপরি আরও একটা বিষয় সাহিত্যের ভাষায় একটা সহজ সলীল এবং আকর্ষক লাবণ্যও থাকা চাই।”


বিষয়টা আরও একটু তলিয়ে এবং চার পাশ থেকে বাজিয়ে বুজে নেওয়া দরকার।


ভাষার চিত্র মেসানোটি কী ব্যাপার সর্বাগ্রে সেটা দেখা যাক। কারণ, এখনকার সাহিত্যবিচারে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশের সমালোচক মহলে এই ব্যাপারটাকেই সর্বপ্রকার সাহিত্যকৃতিতে, বিশেষত কবিতায় সবচেয়ে ওজনদার উপকরণ হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে এখন এর নাম হচ্ছে 'ইমেজারি’ অর্থাৎ বিমূর্তকে মূর্ত করার সাজ সরঞ্জাম, যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'শুধু মুখের কথায় যে কথাকে বোঝানো যায় না, সে কথাকে ছবি এঁকে বোঝানো যায়। যেমন, ‘দেখিবারে আঁখি-পাখি ধায়’ বলে বলরাম দাস শ্রীমতীর শ্যামরূপ চোখে দেখতে পাওয়ার দুর্বার আকুলতাকে বুঝিয়েছেন।


এ দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। বিষয়টাকে আরও বিশদ ভাবে বোঝার জন্য গুটিকয় সমান্তরাল দৃষ্টান্ত আমরা নিজেরাও খুঁজে পেতে এনে পরখ করে দেখতে পারি। যেমন— 

‘বলেছে সে এতদিন কোথায় ছিলেন?

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।


এখানেও এক রমণীর চোখ। কিন্তু এ রমণীয় চোখ ধেয়ে যাওয়ার ছটফটানিতে ছুট ব্যাকুল পাখি নয়—পাখির নীড়। হাজার বছর ধরে জীবনের পথ হাঁটা এক ক্লান্ত পুরুষ প্রাণের নিশ্চিন্ত নিবিড় আশ্রয়।

আবার রবীন্দ্রনাথ নিজে যে এক চোখের ছবি এঁকেছেন—

‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস,

তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।


সে চোখে আছে পতঙ্গের প্রতি প্রজ্জ্বলিত দীপশিখার যে আহ্বান সেই আমন্ত্রণ।


তবে এ সমস্ত ক-টি ছবিই হচ্ছে নিরবয়ব ভাবলোক, মনোলোকের ছবি, অক্ষরে অক্ষরেই যাদের চরিত্র বচনাতীত। যাদেরকে ঠিক পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে ধরা যায় না। অপরদিকে নিছক চর্মচক্ষুতে যে ছবি দৃশ্য, যেসব ছবি সচরাচর পটুয়াদের এলাকার, সে ছবিও যে সাহিত্য তার ভাষার পটে প্রায় সমান স্পষ্টতায় আঁকতে সক্ষম, তারও গুটিকয় নমুনা দেখা যাক। যথা—

‘মেঘৈমেদুরম্বরং বনভুব শ্যামাস্তমালদ্ৰুমৈঃ'


বাংলার 'আদিকবি' জয়দেবের আদি শ্লোকে বর্ষার একটি ছবি। এই ছবিটার ভাষ্য আমরা স্বয়ং প্রমথ চৌধুরীর পায়ের কাছে বসে শুনে নিচ্ছি—'কবি শুধু দুটি কথা বলেছেন, আকাশ মেঘে কোমল ও বনতমালে শ্যাম; তিনি তুলির দুটি টানে একসঙ্গে আকাশের ও পৃথিবীর চেহারা এঁকেছেন। এ চিত্রের ভিতরে কোনো রেখা নেই, আছে শুধু রং, আর সে রং নানা জাতীয় নয়, একই রং শ্যাম, উপরে একটু ফিকে নিচে একটু গাঢ়। এ বর্ণনা হচ্ছে চিত্রকররা যাকে বলে ল্যান্ডস্কেপ পেন্টিং। তুলির দুটানে জয়দেব বর্ষার নির্জনতার, নীরবতার, তার নিবিড় শ্যামশ্রীর কী সমগ্র কী সুন্দর ছবি এঁকেছেন। এ ছবি যার চোখে একবার পড়েছে, তার মনে এ ছবির দাগ চিরদিনের মতো থেকে যায়।


এর পাশে একালের কবি আঁকা আর একটি ল্যান্ডস্কেপ নিরীক্ষণ করা যাক—

‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে। 

জনশূন্য ক্ষেত্রমাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে, 

শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার 

রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার 

স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি। ক্ষীণ নদীরেখা 

নাহি করে গান আজি, নাহি লেখে লেখা 

বালুকার তটে। দূরে দূরে পল্লি যত 

মুদ্রিত নয়নে রৌদ্র পোহাইতে রত 

নিদ্ৰায় অলস ক্লান্ত।


চিত্র সমালোচকদের ভাষায় এ ছবির ডিটেলের কাজ অনেক বেশি। এতে রং যেমন আছে, তেমন আছে রেখারও কাজ। তাছাড়া ছবিটা বোধ হয় আমাদের সকলেরই কোনো না কোনো সময় দেখাও আছে। ট্রেনে চেপে কিছু দূরে কোথাও যেতে যেতে রেলগাড়ির জানালা দিয়ে এমন দৃশ্য হয়তো আমাদের কতবারই চোখে পড়েছে। কিন্তু সে ছবিকে আমরা এমন আদিগন্ত অগাধ নিটোল প্রশান্তির এমন অন্তরঙ্গ চিত্র রূপে কে কবে কখন দেখতে পেয়েছি? এই ভাবে দেখার পর এ ছবির দাগও আমাদের মনের ভিতর চিরদিনের মতোই? থেকে যায়।

নিচের ছবিটাও একটা ল্যান্ডস্কেপের—

‘মধ্যাহ্ন নগর মাঝে পথ হতে পথে 

কর্মবন্যা ধায় যবে উচ্ছ্বলিত স্রোতে 

শত শাখা-প্রশাখায়-নগরের নাড়ি 

উঠে স্ফীত তপ্ত হয়ে, নাচে সে আছাড়ি 

পাষাণ ভিত্তির পরে ; চৌদিকে আকুলি 

ছুটে পান্থ, ধায় রথ, উড়ে শুষ্ক ধূলি।”


কিন্তু একেবারে বিপরীত প্রান্তের ল্যান্ডস্কেপ। ক’লকাতার বা কলকাতার মতো যে কোনো একটা মেট্রোপলিটান শহরের যে-কোনো কাজের দিনের দুপুর বেলাকার একটা ছবি। আর আঁকা হয়েছে যেন সেই ফরাসি পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট পর্বের বর্ণোন্মত্ত ডাচ পটুয়া ভ্যান গগের (Vincent Van Gogh) আঁকা ছবির কায়দায়-অতিশয় চড়া রঙে। ফলে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় কর্ম-উদ্ব্যস্ত ঊর্ধ্বশ্বাস এই গোটা রৌদ্রাক্ত শহরটারই সমস্ত কর্ম, ঘর্ম, আর ধুলোর ঝাপ্‌টা একেবারে দর্শকের চোখে-মুখে লাগছে।


ভাষার ভিতরে সাহিত্য কী উপায়ে ছবি আঁকে বা ছবি মিশোয়, এতগুলি ছবি দেখার পর সেকথা বুঝতে আমাদের বোধ হয় আর তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এইবার তা হলে দেখা যাক সাহিত্যে সংগীতের মিশেলটা কী ব্যাপার।


এ প্রসঙ্গে এখানকার বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ মোটামুটি যা বলেছেন তা হচ্ছে ছন্দ। শাস্ত্র হিসাবে ‘ছন্দ’ যদিও একটা অতিশয় জটিল তাত্ত্বিক ব্যাপার, যার অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনার অবকাশও আমাদের এ আলোচনায় নেই। তবে ছন্দ যে মূলত ভাষার ভিতরে একটা দোল আর তালের, আর তাদের ছকবাঁধা তারতম্যের ব্যাপার, এবং আমাদের সাধারণ কথোপকথনেও উচ্চারিত বাক্যের অর্থ অনুধাবনের জন্যও একটা স্বাভাবিক অথচ বিশেষ নিয়মানুধীন যতি বিন্যাসের প্রয়োজন হয়—এ বোধ সম্ভবত ছান্দসিক না হয়েও আমাদের সকলেরই কিছু না কিছু আছে। জীববিজ্ঞানীদের মতে এই বোধটা নাকি আমাদের আজন্ম সংস্কার। আপাতত ছন্দের এই চরিত্রটুকু জেনে রাখলেই আমাদের কাজ চলে যাবে।


তাছাড়া, শাস্ত্রমতে কাব্যের যে রীতিটাকে আমরা ছন্দ বলে চিনি—মাত্র ও পর্ব-পর্বাঙ্গের বিধিবদ্ধ চরণবিন্যাস, সে রীতিটা তো পৃথিবীর প্রায় সবদেশের কাব্যক্রম থেকেই ক্রমে ক্রমে বাতিলও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সংগীত বা সুরটা নয়—ইংরেজিতে যেটাকে বলে ‘কেডেন্স' (Cadence) শব্দজ ধ্বনির সুষম বিন্যাস—সেটা ভাষা থেকের যাবার নয়। কেন যাবার নয় ? তারও উত্তর রবীন্দ্রনাথের কাছেই পাওয়া যাবে। 'হবট স্পেন্সেরের একটা লেখার মধ্য পড়িয়াছিলাম যে সচরাচর কথার মধ্যে যেখানে একটু হৃদয়াবেগের সঞ্চার হয় সেখানে আপনিই কিছু না কিছু সুর লাগিয়া যায়। বস্তুত রাগ দুঃখ আনন্দ বিস্ময় আমরা কেবলমাত্র কথা দিয়া প্রকাশ করি না—কথার সঙ্গে সুর থাকে। এই কথাবার্তার আনুষঙ্গিক সুরটাই উৎকর্ষ সাধন করিয়া মানুষ সংগীত পাইয়াছে। স্পেন্সরের এই কথাটা মনে লাগিয়াছিল। [জীবনস্মৃতি] এই সুরটাই হচ্ছে সাহিত্যের সাঙ্গীতিক উপকরণ। কারণ এই সুরের আসল চরিত্র হচ্ছে এটা dynamic— গতিমান এবং গতিজনক; বেগবান এবং বেগ প্রদায়ক।


ব্যাপারটা আরও একটু খোলশা করে বুঝতে আমরা আধুনিক ইংরেজি কাব্যের গুরুস্থানীয় Ezra Pound (1885–1972) এর কাছে কিছু সহায়তা পেতে পারি। কবিতার মধ্যে সংগীতের মিশেলটা তিনি এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—

"The whole thing is an evolution. In the beginning simple words were enough food, water. fire. Man desires to communicate with his fellows. He desires an ever increasingly complicate communication. Gestures serve to a point. Symbols or metaphors also may serve, particularly when you desire communication of something not present to the eyes, or when you desire to communicate simple ideas. Gradually you wish to communicate an idea and its modifications, or an idea with a crowd of its effects, or a still more complex idea and its concomitant emotions or an impression that is emotive.

"You begin with a yell or a howl and a bark. You develop into the dance and into music, and into music with words, developing in its turn into words with music, and thus, finally into words with a vague adumbration of music, words suggestive of music, a cadence that preserve some accurate traits of the original emotive empression." [Selected Writings]


কিন্তু ভুললে চলবে না, এই চিত্রও সংগীত—এ দুটি সাহিত্য সৃষ্টির কেবল উপকরণই মাত্র—যেমন বাড়ি তৈরির উপকরণ হচ্ছে ইট, সিমেণ্ট, বালি, পাথরকুচি—এইসব। এই উপকরণগুলি দিয়ে কেউ বাসগৃহ গড়ে, কেউ গড়ে ভজনালয় বা মন্দির, কেউ চণ্ডীমণ্ডপ, কেউ নাটমঞ্চ বা প্রমোদভবন, কেউ স্মৃতিসৌধ, কেউ আবার সুপার মার্কেট বা বহুতল বহু ফ্ল্যাটযুক্ত বাড়ি—এগুলি হচ্ছে সেই গড়ার কাজের মাধ্যম ও বিষয়। এই বিষয় ও মাধ্যমটাকে যিনি যত পোক্ত ও আকর্ষণীয় করে গড়তে পারেন তিনিই তো তত সার্থক স্থপতি ও শিল্পী। এই কৃতিত্বটাই সৃষ্টি। এই কৃতিত্ব যেখানে উপস্থিত নেই, সেখানে ইট চুণ বালি—শুধুই ইট চুণ বালি—এছাড়া তাদের অন্য কোনো মূল্য নেই। স্রষ্টাকে আমরা তাঁর এই সৃষ্টির মধ্যেই পাই। এরই মধ্যে তিনি সমাদৃত ও স্মরণীয় হয়ে থাকেন।


এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ চিত্র ও সংগীত নামক সাহিত্যের প্রধান দুটি উপকরণের উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গেই—প্রায় একই নিঃশ্বাসে—সাহিত্য সৃষ্টির সেই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়টারই প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন; 'সাহিত্য' গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গে বারবারই করেছেন, সেটি হচ্ছে উপরোক্ত স্থপতির মতো, লেখকের নিজস্ব রচনা কৌশল, তাঁর হাতের গুণ বা কারিগরির বাহাদুরি—তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত স্টাইল। এটিকে রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের শ্রী ও হ্রী অর্থাৎ তাদের লাবণ্যর সঙ্গে তুলনা করেছেন। উপমা রবীন্দ্রনাথস্য। লেখকের স্টাইল সম্বন্ধে এর চেয়ে বোধক ও উত্তম উপমা সত্যিই ভাবা যায় না। লাবণ্যেরই মতো সাহিত্যের এই গুণটার প্রতি আমরা স্বতঃই আকৃষ্ট হই—কিন্তু ওটা যে বস্তুত কী জিনিষ, সেটা আজও পর্যন্ত কেউ যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লিষ্ট করে দেখাতে পারেন নি। উত্তম লেখকের এই হাতের গুণটা অননুকরণীয়। এবং প্রকৃতপক্ষে এই একান্ত স্বকীয় রচনা কৌশলের মধ্যেই লেখক যথার্থভাবে বেঁচে থাকেন।