শাক্ত পণবলির 'আগমনী’ ও ‘বিজয়া’ শীর্ষক পদগুলির মধ্যে বাঙালির সামাজিক ও ধর্মনৈতিক চেতনার বিকাশ কীরকম ঘটেছে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে লেখো।

সাহিত্য ও সমাজের মধ্যে একটা যোগসূত্র বর্তমান, তা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। মানবমনের ক্রিয়াকলাপের রূপই সাহিত্য। কিন্তু মানুষের কোনো আচরণই পরিবেশ নিরপেক্ষ নয় সহেতু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও পরিবেশের প্রভাব সাহিত্যে থাকবেই। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মূলত ধর্মাশ্রিত। কিন্তু তারই মধ্যে সংলাপ, চিত্রকল্পে সমাজ জীবনের অনেকটাই প্রতিফলিত। লীলাতত্ত্ব এবং শক্তিতত্ত্বের কথা থাকলেও তাঁদের রচনায় সমাজ জীবনের গভীর ছায়াপাত ঘটেছে।


আগমনী-বিজয়ার গানে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে বাৎসল্য রস–কন্যা উমার প্রতি মা মেনকার বাৎসল্য। বাৎসল্যের এই পটভূমিকায় আছে তৎকালীন সমাজের রূঢ় রীতি নীতি এবং কঠোর অনুশাসন। সমাজে তখন গৌরীদান প্রথা প্রচলিত ছিল। অষ্টমবর্ষে গৌরী দান করার বিধান বাঙালি সমাজে বিশেষভাবে গ্রাহ্য হত। পূণ্যলাভের আশায় অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা উমাকে মহেশ্বর হাতে সমর্পণ করায় সমাজের অনুশাসন রক্ষিত হলেও মাতৃহৃদয়ের শঙ্কা দূরীভুত হয়নি। তাই বালিকা উমার সংসার-অনভিজ্ঞতার দরুণ মেনকার উক্তি–

"গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না। 

বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।।

যদি এসে মৃতুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয় 

এবার মায়ে-ঝিয়ে করব ঝগড়া, জামাই বলে মানব না।"


কৌলীন্য প্রথা যুগেরই একটি প্রথারূপে গৃহিত ছিল। কুল রক্ষার তাগিদে কন্যার অভিভাবকগণ পাত্রের গুণাগুণ বিচার না করে বিবাহ দিতেন, পাত্রের কৌলীন্যই ছিল একমাত্র বিচার্য।


লৌকিকতা বা সামাজিকতার ব্যাপারে উদাসীন গৃহকর্তার তুলনায় গৃহিণীরা যে অধিকতর সচেতন ছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় মেনকার উক্তিতে স্বামীকে কৈলাসে পাঠাবার সময় বলে দিলেন–

শিবকে পূজবে বিল্বদলে, সচন্দন আর গঙ্গাজলে, ভুলবে ভোলার মন।...

এনো কার্তিক গণপতি লক্ষ্মী সরস্বতী ভগবতী

এনো মস্তকে করে ।।

জামাই যদি আসেন, এনো সমাদর করে।


প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, গঙ্গা ছিলেন শিবের অপরা পী, এখানে উমার সতীন রূপে শিবের মস্তক-স্থিতা সেই গঙ্গার কথাই বলা হয়েছে। (তৎকালীন সমাজে প্রচলিত নিয়ম ছিল স্বামীর বিনা অনুমতিতে পিতৃগৃহে স্ত্রীর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই গিরিরাজ কৈলাসে গিয়ে উমাকে নিয়ে আসতে চাইলে উমা স্বামীর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেছে—

‘গঙ্গাধর হে শিবশঙ্কর, করো অনুমতি হর, 

যাইতে জনক-ভবনে।


সমাজের কঠোর অনুশাসনের ফলে সমাজে একটা দৃঢ় বন্ধন ছিল প্রাচীন সমাজে পরিবারে-পরিবারে একটা নিবিড় আত্মীয়া ছিল। সুখে-দুঃখে এক পরিবার অপর পরিবারকে সহায়তা করত। উমাকে অপাত্রে দান করার জন্য প্রতিবেশিরা মেনকাকে ভর্ৎসনা করেছে-

“মেয়েকে ফেলিল জ্বলে, ভূধর রমণী।

বিয়ে দিলে এন্নি বরে, ভিক্ষা করে কাল হরে, 

অন্নবস্ত্র নাইকো ঘরে, অতি দুঃখিনী।


আবার উমার আগমনে উল্লসিত প্রতিবেশি—

‘পুরবাসী বলে – উমার মা, 

তোর হারা তারা এলো ওই।"


একটি সুন্দর উজ্জ্বল গোষ্ঠী জীবনের চিত্র। বস্তুতঃ আগমনী-বিজয়ার গানে কবিরা চিত্রের পর চিত্র এঁকেছেন—যে চিত্রে চিত্রিত হয়েছে বাংলার শারদ প্রকৃতি, বাংলার উৎসব, বাংলার সমাজ তার সমস্ত ভালো-মন্দ নিয়ে ।


ধর্মনৈতিক চেতনা : ঈশ্বর নির্ভর জীবন, সুগভীর আস্তিক্যবোধ, আধ্যাত্মিক জীবন অনুসরণ প্রভৃতির জন্য আকাঙ্ক্ষা ‘ভক্তের আকুতি পর্যায়ে রূপকাবরণে উন্মোচিত। ঠিক তেমনই যুসসমস্যাজনিত জীবন-যন্ত্রণার সংকটটি এখানে রূপকের আবরণে প্রকাশিত। জীবননির্বাহের পিচ্ছিল পথে ব্যক্তির নৈতিক চেতনার ক্রমাবুলপ্তি জনিত অনুশোচনাই রূপায়িত এই পদগুলিতে। 'কেবল আসার আশা, ভবের আসা' পদটিতে সংসারের স্নেহ প্রেম চিত্র পদ্মের সঙ্গে উপমিত হয়েছে।


পার্থিব জীবনের রূপক ব্যবহারের মাধ্যমে কবি রামপ্রসাদ আধ্যাত্মিকতার ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ যে তত্ত্ব চিন্তা এখানে উপস্থিত করেছেন তা অনন্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। সমালোচক যথার্থই বলেছেন ‘মাগো তারা ও শংকরী পদটিতে অভাবের দুঃসহ বেদনায় উদ্ভ্রান্ত কবির অভিমান মাতার চরণে বর্ষিত হয়েছে। কবিসাধকগণ নানা উপমা-অলংকার ইঙ্গিতের আভাসে জগজ্জনী আদ্যাশক্তির স্বরূপ নির্ধারণ করতে গিয়েছেন, কারণ যাকে ভক্তি করতে হয় তার একটা রূপায়তন না হলে চলে না।


ভক্তের আকুতিতে শাক্ত কবিগণের একমাত্র লক্ষ্য ‘মাতৃপদ'—সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার সাধনায় তাঁরা যে জ্ঞান ও যোগের পথ ধরে পথ পরিক্রমা করেন তা নীরস আত্মধ্যান নয়, তা ভক্তি বিমণ্ডিত। ফলে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কাব্যধর্মের বিরোধিতার কোনো প্রশ্ন নেই বরং একে অপরের পরিপূরক।