নিয়তির অমোঘ নিয়মে 'হালদার গোষ্ঠী'তে যে বিচ্ছিন্নতার কালো মেঘ ঘনীভূত হয়েছিল, তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করো।

‘পৃথিবীর কোনো বিষয়ই চিরস্থায়ী নয়, সবই নশ্বর' একথা ইতিহাস বলে। অতীতের দিকে চোখ মেললে দেখা যায় কত বড়ো বড়ো মানব সভ্যতা, রাজা রাজ্য, রাজপ্রাসাদ ধ্রুব তারকার মতো সে জ্বলজ্বল করত, অথচ একদা সেই মহিমা হারিফে সবই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, অবশ্য এটাই জাগতিক নিয়ম, সবই যদি চিরস্থায়ী হত তাহলে সৃষ্টি গতি রুদ্ধ হত—যাওয়া এবং আসাই শাশ্বত চিরন্তন। এর মধ্যে কোনো কারণ অনুসন্ধান বৃথা, অপচেষ্টার নামান্তর। আলোচ্য গল্পটি এমনই ইঙ্গিতে অভিনব।


গল্পের শুরুতেই লেখক জানিয়েছেন—“এই পরিবারটির মধ্যে কোনো রকমের গোল বাধিবার কোনো সংগত কারণ ছিল না। অবস্থাও সচ্ছল, মানুষগুলিও কেহই মন্দ নহে, কিন্তু তবুও গোল বাধিল।” অর্থাৎ কোনো কিছুর ভাঙন যে অনিবার্য কারণবশত হয়েই থাকে সে বিষয়ে লেখক ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন ওই কথাটির মধ্যে। লেখক আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন—“মানব জীবনের যোগ বিয়োগের বিশুদ্ধ অঙ্ক ফলটি উদ্ধার করিতে তিনি (ভাগ্য দেবতা) মনোযোগ করেন না, এইজন্য তাঁহার ব্যবস্থার মধ্যে একটা পদার্থ তিনি সংযোগ করিয়াছেন, সেটা অংসগতি। যাহা হইতে পারিত যে হঠাৎ আসিয়া লণ্ডভণ্ড করিয়া দেয় । ইহাতেই নাট্যশালা জমিয়া উঠে, সংঘাতের দুইকূল ছাপাইয়া হাসিকান্নার তুফান চলিতে থাকে।” অর্থাৎ সমস্ত বিষয়েই যে বিধাতার অমোঘ হাত ছানি প্রকট এবং হালগোষ্ঠী ও তা থেকে বেয়াত পায়নি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।


হালদার গোষ্ঠীর বতর্মান জমিদার মনোহরলাল। সাধারণত জমিদার সম্পর্কে নানান পুস্তকে যে নিষ্ঠুরতার কাহিনি আমরা পাঠ করে থাকি। মনোহরলাল তা থেকে কম কিছু নন। তাঁর এই নিষ্ঠুরতার পরিচয় বহন করে থাকে নায়েব নীলকণ্ঠ। "বাবুর ঐশ্বর্যভাণ্ডারের দ্বারে সে মূর্তিময় দুর্ভিক্ষের মতো পাহারা দেয়। বিষয়টা মনোহর লালের কিন্তু তাহার মমতাটা সম্পূর্ণ নীলাকন্ঠের।” এই পরিবারের সবচেয়ে যোগ মানুষ যদি বলতে হয় ‘বনোবিলাস'। ইনি মনোহরলালের বড়ো ছেলে, মানবীয় গুণে সমৃদ্ধ, প্রজাদের দারিদ্র্য দুঃখ দুর্দশায় তার মন প্রতিনিয়ত কাঁদে কিন্তু নিরুপায়ের ন্যায় তাকে নীরব থাকতে হয়। মাঝে মধ্যে দু একটা নিষ্ঠুর ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বনোয়ারী পিতার নিকট চক্ষুকূল রূপে চিহ্নিত হয়েছে আর নীলকণ্ঠের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছে।


বনোয়ারীর স্ত্রী কিরণ লেখা। বনোয়ারী থাকে অনু, তথা পরমাণু বলে ডাকতো। হালদার গোষ্ঠীর বড়ো ছেলে হিসাবে পিতার কাজের সমালোচনা করা স্বামী হলেও সে বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি। উভয়ের মধ্যে প্রেম-প্রীতি বিনিময়ের কোনো ঘাটতি না থাকলেও কিরণ -- এই একটা বিষয়ে স্বামীর সঙ্গে দ্বিমত। অনেক বুঝিয়েছে কোনো ফল হয়নি। দিনগুলি যখন এমনভাবে কাটছিল ঠিক সেই সময় ঘটে গেল একট অনিবার্য অঘটন। “সুখদা মধুকৈর্বতের স্ত্রী, মনোহরলালের প্রজা। সে একদিন অন্তপুরে আসিয়া কিরণ লেখার পা জড়াইয়া ধরিয়া কান্না জুড়িয়া দিল।” কারণ, অন্যের হঠকারিতায় তারা জমিদারের নিকট ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে, জমিদারকে কিংবা তাঁর নাথের নীলকণ্ঠকে বলে কোনো লাভ নেই দেখে সুখদা কিরণলেখার স্মরণাপন্ন হয়েছে—সে কোনো প্রকারে তাকে উদ্ধার করতেই হবে, নইলে তারা ভেসে যাবে।


সুখদার নিকট কিরণ লেখা যখন নিজের অক্ষমতার কথা বলতে শুরু করেছে ঠিক সেই সময় বনোয়ারী এসে পড়ে, এবং সুখদার কান্না মিনতি অনুরোধ প্রকৃতিতে ব্যথিত হয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বনোয়ারী নীলকণ্ঠের নিকট গেল। নীলকণ্ঠকে বহু অনুরোধে যখন রাজি করানো গেল না—মধু কৈবর্তের ঋণ থেকে মুক্ত দিতে, তখন বনোয়ারীর বিবেকে বাধল, বাড়ির বড়ো ছেলে হয়েও কোনো ফল হল না বনোয়ারী জেদের বশবর্তী হয়ে নিজেই মধুকৈবর্তকে এগিয়ে এল। নীলকণ্ঠ বিষয়টি অনুধাবন করে মধুকে জব্দ করতে তাকে খাজাঞ্জীখানায় আটকে রাখলে বনোয়ারী পুলিশ লাগিয়ে নীলকণ্ঠকে গ্রেফতার করে। পিতার সঙ্গে যেটুকু সুসম্পর্ক ছিল তাও নষ্ট হল এমনকি শ্রী কিরণ লেখাও তাকে এড়িয়ে চলতে থাকে।


বনোয়ারী নিঃসন্তান ছোটোভাই বংশীলালের পুত্র সন্তান হরিদাসের জন্মের পর হালদার গোষ্ঠীর প্রায় সবার মমতা ভালোবাসা বংশীশালের প্রতি ধাবিত হয়। বিশেষ করে অকালে বংশীলালের মৃত্যু হলে কিরণলেখা হরিদাসকে সন্তানের মতো বুকে টেনে নেয় স্বামী বলে যে কোনো পদার্থ সংসারে আছে তা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। এই সময় আরো একটা অঘটন ঘটল—বড়ো ছেলে প্রতি রোধবশত মনোহরলাল তাঁর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর হরিদাসের নামে উইল করে পরোলোক গত হন, অর্থাৎ বনোয়ারীর স্বস্ত্রীক একটি জীবনটা কাটতে হবে হরিদাসের আশ্রিত হয়। কাজেই তার মনে উপ্ত হতে থাকে ভয়ংকর জিঘাংসার বীজ। পিতার উইল করা দলিল নস্যাৎ করতে একদিন চোরের মতো তা চুরি করে, কিন্তু দলি নষ্ট করা তার আর হয়ে ওঠে না, হরিদাসের স্নেহের নিকট পরাভব স্বীকার করে দলিল তার হাতেই ফিরিয়ে দেয়, কিরণকে সাক্ষী রেখে।


কিন্তু সময় অনেক অতিবাহিত হয়ে গেছে, বাপের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে তার খেয়ালই দিল—সে একজন স্থায়ী, ঘরে তার সুন্দরী স্ত্রী আছে, যখন খেয়াল হল তখন বোধ করি মনের মধ্যেকার সুখ পাখিটা অনাহারে মারা গেছে। একবার ভালো করিয়া কিরণের দিকে তাকাইয়া দেখিল। দেখিল, সেই তন্বী এখন তো তন্বী নাই, কখন সেটা হইয়াছে সে তাহা লক্ষ্য করে নাই। এতদিনে হালদার গোষ্ঠীর বড়ো বৌয়ের উপযুক্ত চেহারা তাহার ভরিয়া উঠিয়াছে, আর কেন। এখন অমর শতকের কবিতগুলোও বনোয়ারির অন্য সমস্ত সম্পত্তির সঙ্গে বিসর্জন দেওয়াই ভালো। সংসারে বনোয়ারী নিজেকে বড়ো অপ্রয়োজনীয় মনে হল ভেবে নিল একবার এখানে থাকা অবাস্তর। “সেই রাত্রেই বনোয়ারির আর চাকরি খুঁজিতে বাহির হইল।"


এ থেকে স্পষ্টই অনুমিত হয়, সংসারে তথা মানব জীবনে যা কিছু অঘটন সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। সবই বিশ্বদেবতার অঙ্গুলিত হেলনে। নইলে হালদার গোষ্ঠীর মতো সুখী স্বচ্ছল পরিবারে এভাবে অহেতুক ভাঙন শুরু হত না। এরজন্য কাউকে অনিবার্য ভাবেই, অর্থাৎ এর করুণ পরিণতিতে চিত্ত বিগলিত হলেও সবই ভবিতব্য বলে মেনে নিতে হবে।