বীরসার বিদ্রোহ গণবিদ্রোহ।

বিশ শতকের শেষলগ্নে বীরসার নেতৃত্বে যে গণবিদ্রোহ ছোটোনাগপুর অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল তার বিবরণ আমরা সুরেশ সিং রচিত 'The Storm and the Hanging Mist' নামক গ্রন্থে এই বিদ্রোহের বিবরণ পাই। এই গ্রন্থে তিনি বিদ্রোহের স্বরূপ সম্পর্কে বলেছেন—“মুণ্ডারী কৃষিব্যবস্থা ছিল অসাম্প্রদায়িক। সামন্ত ও জমিদারদের তথা ব্যক্তিগত মালিকানার উত্তরণের মধ্যেই বিদ্রোহের চাবি খুঁজে পাওয়া যাবে।” মুণ্ডারা অরণ্যের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঘুরে বেড়াত। অরণ্যের ফলমূল সংগ্রহ, পশু শিকার করে দিন কাটাত। তাদের নিজস্ব একটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল। সেখানে প্রধানদের কথামতো আদিবাসী তথা মুণ্ডা সমাজ পরিচালিত হত। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই সমাজে চির ধরে। বাইরের জায়গা থেকে মালিক, মহাজন, জমিদার এসে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। যাদেরকে মুণ্ডারা দিকু বলত। এই দিকুরা মুণ্ডাদের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করত। দিকুদের অত্যাচার চরমে ওঠে ১৭৬৫ সালের পর সমগ্র আদিবাসী অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে আসলে। ইংরাজ সরকার কর্তৃক নিয়োজিত নতুন জমিদার নিজ নিজ প্রজাস্বত্ব কায়েম করতে মুণ্ডাদের উপর করের বোঝা চাপিয়ে দিল। খাজনা আদায়ে তাদের উপর চালাত অকথ্য অত্যাচার। ফলে তারা মহাজনের দ্বারস্থ হত চড়া সুদে টাকা ধার করতে। কিন্তু সে টাকাও তারা দিতে পারল না। তখন তাদের বেট বা বিনাশ্রমে বাধ্য হয়ে খেটে দিতে হত। সমকালীন একটি প্রতিবেদনে জনা যায়—“যখন একজন অত্যাচারী একটি খোড়া চাইতেন, কোলরা তা দিতে বাধ্য, পালকি চাইলে পালকি দিতে বাধ্য। কেউ মারা গেলে মাজনা, জন্মালে মাজনা, বিবাহে ও পুজা পার্বণে এবং ঠিকাদারের কাছারিতে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে আলাদা আলাদা খাজনা দিতে হত।”


দিকুদের অত্যাচার এইভাবে চরমে উঠলে মুণ্ডাদের সামাজিক ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। পঞ্চায়েতের হর্তাকর্তারা দিকুদের দাসানুসাঙ্গে পরিণত হল। ফলে মুণ্ডারা হারিয়ে ফেলল নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বাজাত্যবোধ। কিন্তু স্বাধীনতা ও স্বাজাত্যবোধ ফিরে পাবার জন্য তারা সরকারের বিরুদ্ধে কয়েকটি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সেগুলি ইতিহাসের পাতায় আদিবাসীদের বিদ্রোহ হিসাবে পরিচিত। যেমন—১৭৯৮ খ্রিঃ ছোটোনাগপুরের মুণ্ডা বিদ্রোহ, ১৮২০ খ্রিঃ মুণ্ডা বিদ্রোহ, ১৮৩১ খ্রিঃ–৩২ খ্রিঃ বিদ্রোহ, ১৮৫৭ তবে ১৮৯৫–১৯০০ খ্রিঃ বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে বীরসা বিদ্রোহ মুণ্ডারী জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত করেছিল।


১৮৭৫ সালের কোনো এক বৃহস্পতিবার সুগানা মুণ্ডার ঘরে করাম মুণ্ডানীর গর্ভে বীরসার জন্ম হয়। শৈশবে পিতার দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে মামারবাড়ি চলে আসে। সেখানের স্থায়ী পাঠশালায় অক্ষরজ্ঞান শিখে চাইবাসার খ্রিস্টান মিশনে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হয়। সেখানে মিশনারীদের সঙ্গে মতবিরোধে মিশন ত্যাগ করে ফিরে আসে নিজ গ্রামে। মানসিক অস্থিরতায় ঘুরে বেড়ায় অরণ্যে। তারপর মানসিক সুস্থিরতা ফিরে পেতে আনন্দ পাঁড়ের কাছে বৈশ্বব ধর্মের দীক্ষা নেয়। কিন্তু সেখানেও নিজ মনের শান্তি ফিরে না পেয়ে বীরসা আবার নিজ সমাজে ফিরে আসে। কিন্তু কোনোদিন নিজেদের সমাজে প্রচলিত সংস্কার মানেনি বা অন্যদের আচার সর্বস্ব পালনে বাধা দিয়েছিল। এরপর অরণ্যজননীর কথামতো নিজেকে ‘ধরতি আবা’ বা মুণ্ডাদের ভাগ্যবান হিসাবে প্রতিপন্ন করল। দলে দলে মুণ্ডারা তার আচার আচরণে মুগ্ধ হয়ে তার কাছে আসতে লাগল। মুণ্ডারা একত্রিত হতে লাগল। ফলে ইংরেজ সরকারের টনক নড়ল। ১৮৯৫ খ্রিঃ ১২ আগস্ট পুলিশের তৎপরতায় বীরসা গ্রেপ্তার হয়। এবং দুবছর সশ্রম কারাদণ্ড ও পঞ্চাশ টাকার জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছমাস কারাদণ্ড হয়।


বীরসার গ্রেপ্তারে সমস্ত আদিবাসী সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে পশুপতি প্রসাদ মাহাতো তথ্য প্রকাশ করে “বীরসার গ্রেফতারের পরদিন ৭০০০ সশস্ত্র জনতা ছালবাদ গ্রামে কর্মবিরতি পালন করে। গ্রামে গ্রামে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কয়েকজন আদিবাসী গ্রেপ্তার হয়। তারা স্বেচ্ছায় বীরসার সঙ্গে জেলে যেতে রাজি হয়। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কালীকৃষ্ণ মুখার্জির এজলাসে বিচার শুরু হয়। গ্রামে গ্রামে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য বীরসার দুবছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছমাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৮৯৭ খ্রিঃ ৩০শে নভেম্বর বীরসা জেল থেকে ছাড়া পায়।–“সঙ্গে সঙ্গে সে খবর ছড়িয়ে গেল বাতাসের আগে। আবার মুণ্ডা গ্রামে গ্রামে মাদল বাজল, মেয়ে-পুরুষে নাচল, গান গাইল।" বীরসার মুক্তির কিছুদিন পরে ডোনকা মুণ্ডা ও সালীর বাড়িতে এক সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভাতে নির্ধারিত হয় পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি। সরকারি নির্দেশের তোয়াক্কা না রেখেই জনগণের নৈতিক চেতনাকে পূর্ণ সঞ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করার জন্য বীরসা এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করে। ধর্মীয় সংগঠনের মধ্য দিয়ে প্রস্তুতি চলতে থাকে। “বীরসার পরনে ধবধবে কাপড়, মাথায় পাগড়ি, গায়ে পিরান, পায়ে খড়ম।” সে তার শিষ্যদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ জারি করে—“তবে শুন। আজ হতে যে আমারে পুজবে সেই বীরসাইত। তোমাদের হাতে সময় নাই। এতকাল ভেবেছি মুণ্ডার শত্রু কে ? কে তার দুশমন ? এখন জমিদার জোতদার মহাজন ? যারা এসে আমাদের খেতে খামারে জুড়ে বসেছে শুধু তারাই দুশমন ? না যারা খুঁটকাটি গ্রামগুলো জমিদারদের হাতে তুলে দিল, সেই সরকার ?” বীরসা তার লড়াই-এ সঙ্গী হিসাবে এক হাতে নিল অভিজ্ঞ সোমা মুণ্ডাকে এবং অন্য হাতে রাখল গয়া মুণ্ডাকে। বীরসা ঠিক করল ‘বেস্পতিতে রবিতে সব মিলবে। ধর্মের কথা লড়াই-এর কথা বলবে। সমগ্র দলটাকে বীরসা তিনভাগে ভাগ করে দিল। প্রথম—প্রচারক, এদের কাজ হল বাড়িতে রবিবার ও বৃহস্পতিবার মিটিং-এর ব্যবস্থা করবে এবং মিটিং-এর শেষে সকলের জন্য রাতের ঠাঁই দেবে। দ্বিতীয় দল হল—পুরাণক, এই দলে থাকবে বৃদ্ধারা, তারা দলকে লড়াই শেখাবে এবং নানারকম পরামর্শ দিয়ে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলবে। তৃতীয় দলটি হল—নানক। এই পর্যয়ের যোদ্ধারা হবে বীরসাইত এবং পুরাণবাদের কাছে লড়াই জেনে নেবে।


বীরসা সবাইকে জানালো—“এখন আর ধিমা ধিমায় কাজ হবে না। আগে মোরা একসঙ্গে সকল কাজ করব। লড়াই শিখা, নানক জোগাড়, পঞ্চায়েত, ঘাঁটি তৈরি, রসদ‌ জোগাড়, সকল কাজ চলবে।" বীরসা প্রতিজ্ঞা করল—“মোদের পুরানো দখল পেতে চাই। পুরানো দেবস্থান চাই।” কারণ চুটিয়া আর জগন্নাথপুরের মন্দির তাদের ছিল। এখন তারা সেই মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পায় না। বীরসার এ বক্তব্যে বীরসাইতরা যখন এক বাক্যে গর্জে ওঠে তাদের সম্মতি প্রকাশ করল তখন বীরসা সবাইকে থামিয়ে বলল—“একসঙ্গে সকল মুণ্ডা সকল দেশ জুড়ে লড়ব। আমার এ লড়াই-এর নাম উলগুলান। বুঝলে ? উলগুলান !”


উলগুলান শব্দটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লেখিকা জানিয়েছেন—“উলগুলান! নতুন ছেলেদের, নানকদের দীক্ষার মন্ত্র হল এই পাঁচটি শব্দে! হাটে-জঙ্গলে, পাহাড়ে, শহরে, দুর্জন অচেনা মুণ্ডা একসঙ্গে হলে একে বলে 'উল'। ও বলে ‘গুলান'। দুজনে একসঙ্গে বলে উলগুলান।” তবে মুণ্ডা ভাষায় উলগুলানের আক্ষরিক অর্থ হল 'গণবিদ্রোহ'। এই গণবিদ্রোহ বীরসাইতরা শুরু করে ১৮৯৯ খ্রিঃ ২৪ ডিসেম্বর। আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হল ইউরোপীয় মিশনারীদের হত্যা। ক্রমশ চার্চে বিদ্রোহীদের অগ্নিসংযোগের ফলে ভস্মীভূত হতে থাকে। এই বিদ্রোহের আগুন ধীরে ধীরে রাঁচি আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু বীরসা মুণ্ডা তার বিদ্রোহী বাহিনীকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ৯ জানুয়ারি শৈলরাকার পাহাড়ের গুহায় জমায়েত হলে ইংরেজরা দূত মারফত খবর পেয়ে বীরসাইতদের আক্রমণ করে। বীরসাইতরা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হলেও শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তবে রাতের অন্ধকারে বীরসা ও বহু মুণ্ডা আত্মগোপন করে। ৩ ফেব্রুয়ারি সেনত্রার জঙ্গলে আত্মগোপন থাকাকালীন বীরসা ইংরাজ সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এবং তাকে প্রথমে কদগাঁও, তারপরে খুঁটি ও পরে রাঁচি জেলে নিয়ে এসে সেখানে জেল কর্তৃপক্ষের অকথ্য অত্যাচারে বীরসা রক্তবমি করে ৯ জুন মারা যায়।


ইংরাজ সৈন্যরা সর্বমোট ৪৮২ জন বীরসাইতকে গ্রেফতার করেছিল। তার মধ্যে ১৯০১ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে বীরসার সহযোগী ৩৮৪ জন মুণ্ডার বিরুদ্ধে বিচার চলে। বিচারাধীন অবস্থায় জেলের মধ্যে মৃত্যু ঘটে ২০ জনের। বিচারের ফল দাঁড়ায় কনস্টেবলকে মারার জন্য গয়া মুণ্ডা ও তার ছেলে সাবে মুণ্ডা আর চক্রধরপুরে কনস্টেবলকে মারার জন্য সুখরাম মুণ্ডার ফাঁসি হয় । যাবজ্জীবন দীপান্তর হয় ৪০ জনের। সাত বা ততোধিক বছরের কারাকণ্ড হয় পাঁচজনের। পাঁচ বছরের জন্য কারাদণ্ড হয় ৪ জনের। তিন বছরের জন্য ৩ জনের। এছাড়া আরও কয়েকজনের এগারো বছরের জন্য কারাদণ্ড হয়। মোটের উপর এমনভাবে এক অশ্রুসজল অবস্থার মধ্য দিয়ে বীরসা বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।


সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটুকু বলা যায়, বীরসা বিদ্রোহের পূর্বে আদিবাসীদের মধ্যে যতগুলি বিদ্রোহ পরিলক্ষিত হয়েছিল তা ছিল বিদ্যুৎ চমকের মতন। ক্ষণিকের জন্য অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে আবার সরকারি দমনপীড়নের দ্বারা মুহূর্তেই প্রশমিত হয়েছে। কারণ সেসকল বিদ্রোহ ছিল পরিকল্পনা বিহীন। শুরুতেই বিদায়ের বাণী বেজে উঠত। কিন্তু বীরসা বিদ্রোহ সে তুলনায় ছিল স্বতন্ত্রধর্মী। অবতাররূপে বিরাজ করে যেভাবে বীরসাইতদের নিয়ে গুপ্ত সভা করা, এবং পরিকল্পনা মাফিক দলবিভাজন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া সবই গণচেতনার অঙ্গীভূত বিষয়। বীরসার বিদ্রোহে স্ত্রী-পুরুষ সহ শিশু নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করেছিল। এও তো জনজাগরণের আর এক রূপ। হয়তো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে বীরসার বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। তথাপি পরবর্তীকালের জন্য এই বিদ্রোহ এক সুদূরপ্রসারী আলোকজ্জ্বল দিনের সন্ধান দিয়ে গেছে। কারণ এই বীরসা বিদ্রোহের পর আদিবাসীদের আর তেমন কোনো বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। আরও একটা সুখবর হল—“তদানীন্তন গভর্নমেন্ট কর্তৃক ১৯২৯ সালের তিন আইন এবং পাঁচ প্রবর্তিত হবার ফলে অবশেষে মুণ্ডাজাতি সত্য সত্যই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার সুযোগ লাভ করল।" এ থেকে সহজেই বলা যেতে পারে বীরসা মুণ্ডার বিদ্রোহ রূপ নিয়েছিল গণ বিদ্রোহের।