মঙ্গলকাব্য রচয়িতাদের মধ্যে মুকুন্দরামের কল্পনার মৌলিকতা ও জীবন-পর্যবেক্ষণের স্বাতন্ত্র্যের যে পরিচয় মিলে তাহা তাঁহার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু ও চরিত্রচিত্রণের সাহায্যে বুঝাইয়া দাও।

‘কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতে দেবদেবী এবং নানা অলৌকিক ঘটনা আমদানি করা হইয়াছে, কিন্তু জীবনরসিক কবি এই সকল বাস্তব-বিরোধী উপাদানের সাহায্যে যে জগৎ ও জীবন অঙ্কিত করিয়াছেন, তাহা আমাদের চোখে দেখা বাস্তব জগৎ।- আলোচনা করো।


মঙ্গলকাব্যের কাহিনী দেবমাহাত্ম্যমূলক। স্বর্গের দেবতা মর্ত্যে আসিয়া কি ভাবে তাঁহার পূজা প্রচার করেন মঙ্গলকাব্যের কাহিনীর মধ্যে তাহার সবিস্তার বর্ণনা আছে। দেবতার শক্তি অলৌকিক, সেই অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি মানুষের আস্থা ছিল। আস্থা ছিল বলেই ঘোর অমাবস্যার রাত্রেও দেবতার বিশেষ ভক্তটি যখন সূর্যোদয় দেখিয়ে দেয় তখন তাতে অবিশ্বাসের কিছু থাকে না। মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যে এই অপ্রাকৃত জগতের চিত্র অঙ্কন করেছেন বটে কিন্তু তার মধ্য দিয়েই আমরা এই কবির বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাই। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখ্যানাংশ ও চরিত্র বিশ্লেষণ করলে আমরা এই কবির তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় পাই। মুকুন্দরামের শিল্পীমানস এমন উপাদানে গঠিত ছিল যাতে তিনি প্রকৃত জীবনরসিকের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে তাঁর পারিপার্শ্বিক জগৎকে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন।


গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে কবির আত্মপরিচয়, হরগৌরীর সংসার, প্রসূতির আহারে অরুচি, গর্ভবেদনা, নবজাতকের মাঙ্গল্য কর্মানুষ্ঠান, কালকেতুর শৈশবলীলা ও বিবাহের উদ্যোগ, বিবাহের পণ-নির্ধারণ, বিবাহোৎসব, কালকেতুর জীবন সংগ্রাম ও ব্যাধ বৃত্তি, তার দরিদ্র সংসারের অভাব অনটনের তালিকা, অঙ্গুরীয় বিক্রয়কালে বণিকের শাঠ্য, নবনির্মিত নগরে প্রজা-সংস্থাপন ও তাহাদের বিভিন্ন বৃত্তি বর্ণনা, ভাঁড়ুদত্তের লোক ঠকাইয়া জীবিকার্জন প্রভৃতি চিত্রের এবং মুরারি শীল, ভাঁড়ু দত্ত প্রভৃতি চরিত্রের মধ্য দিয়ে মুকুন্দরাম মঙ্গলকাব্যের অপ্রাকৃত কাহিনীর পটভূমিকায় যে জগৎ অঙ্কিত করেছেন তাহা নিঃসন্দেহে আমাদের পরিচিত জগৎ। কবির অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি তৎকালীন বঙ্গসমাজের সমগ্র চিত্র উদ্ঘাটিত করে দেখিয়েছে। কেবল তাই নয়, কবিকঙ্কণের আশ্চর্য রচনা-নৈপুণ্য, অনুপম বর্ণনামাধুর্যে সমাজের অতি তুচ্ছ বিষয়গুলি সজীব ও সরল হয়ে উঠেছে। মুকুন্দরামের কাব্য পাঠ করতে করতে মনে হয় যেন, অতীত যুগের একখানি জীবন্ত ছায়াচিত্র আমাদের মানসনয়ন সম্মুখে অবিরাম অভিনীত হচ্ছে। তাঁর ন্যায় আর কোন কবি জীবনের এমন অবিকল নিখুঁত চিত্র আর অঙ্কিত করতে পেরিছেন বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু কেবল সমাজের বাহ্যিক দৃশ্যবলী অথবা সামাজিক চরিত্রগুলির কর্মজীবনের বাহ্যিক চিত্র অঙ্কিত করেন নি, উহার ভিতর দিয়ে সমাজের আভ্যন্তরীণ অবস্থা, ভাবধারা ও গতি ফুটিয়ে তুলেছেন। সমাজতত্ত্ব ও সামাজিক লোকচরিত্রের পরিপূর্ণ জ্ঞান কবির অস্থিমজ্জায় সংমিশ্রিত ছিল। সেই অসাধারণ শক্তি প্রভাবে কবি মানবজীবনকে এমন কি মানবসমাজের ছায়া বনচারী পশুজাতির উপর আরোপ করিয়া পশুসমাজকেও সজীব ও প্রাণবান করে সমর্থ হয়েছেন।


মুকুন্দরামের কল্পনার মৌলিকতা এবং জীবন পর্যবেক্ষণশক্তির যথার্থ পরিচয় মেলে তাঁর বাস্তব জীবন চরিত্রাঙ্কনে। মুকুন্দরাম দেবদেবীর চরিত্রগুলিকেও যথাসম্ভব মনুষ্যধর্মের দ্বারা জীবন্ত করেছেন। মানব-চরিত্রাঙ্কনে মুকুন্দরাম যে সহানুভূতি, বাস্তব জ্ঞান ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তির পরিচয় দিয়েছেন তা মধ্যযুগের সাহিত্যে সুদুর্লভ। এই সকল চরিত্রাঙ্কনের মধ্যে আবার স্ত্রী-চরিত্র ও খল চরিত্রগুলি অঙ্কনে মুকুন্দরাম অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। কালকেতুর উপাখ্যানের ফুল্লরা এবং ধনপতির উপাখ্যানের লহনা, খুল্লনা এবং দুর্বলা যেন প্রতিদিনের দেখা চরিত্রে পরিণত হয়েছে। মুরারি শীল, তার পত্নী এবং ভাঁড়ু দত্ত তাহাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। মুরারির অঙ্গুরীয় ব্রুয়ব্যাপারে শাঠ্য এবং কালকেতুর নগরে ভাঁড়ুর নষ্টামি বর্ণনাকালে যে প্রচ্ছন্ন পরিহাস কৌতুকের আমদানী করা হয়েছে তা উচ্চ প্রতিভার পরিচায়ক। মুকুন্দরাম খুব বৃহৎ মহৎ বিস্ময়কর বিশাল চরিত্র সৃষ্টি করিতে না পারলেও সাধারণ, প্রত্যক্ষ, পরিচিত ও বাস্তব চরিত্রাঙ্কণে অসাধারণ কুশলতা দেখিয়েছেন। ‘অতিপল্লবিত, অহেতুক বিস্তারের স্থলে অর্থ ঘন সংক্ষিপ্তি, অনিয়ন্ত্রিত ভাবাবেগ ও ভক্তিবিহ্বলতার অস্বচ্ছলতার স্থলে মিতভাষিতা ও তীব্র ভাস্বরতা, নির্বিচার প্রথানুবর্তনের স্থলে বাস্তব স্বীকৃতির প্রখর মৌলিকতা, অধযান্ত্রিক পূর্বরোমন্থনের স্থলে নূতন অনুভূতির দীপ্ত ঝলক–এই সমস্তই তাঁর রচনারীতির বৈশিষ্ট্য। তাঁর রচনার উপর এক সচেতন, মননশক্তির পরিচয় দীপ্যমান। তাঁর শিল্পবোধ মার্জিত, জীবনবাদসম্ভূত রসিকতা তাঁহার পূর্ববর্তীদের গ্রাম্য ভাঁড়ামো হতে স্বতন্ত্র জাতীয়। তাঁর কৌতুকরস কেবল কথায় সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর বঙ্কিম কটাক্ষ, অর্থগূঢ় মন্তব্য ও সমগ্র মনোভাব ও জীবনদর্শনের নানামুখী বিস্তার হতে তির্যক রেখায় ঠিকরে পড়েছে।