‘বুলান মণ্ডলের প্রতি কালকেতুর' এবং কালকেতুর প্রতি ফুল্লার উপদেশ অংশদুটির মধ্যে মুকুন্দরামের কবি প্রতিভার কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে, তা আলোচনা করো।

চরিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে মুকুন্দরাম যে কত বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন তা তাঁর কাব্য ‘চণ্ডীমঙ্গল'—স্পষ্ট ধরা পড়ে। জমিদার ও প্রজার পারস্পরিক সু-সম্পর্ক দেখানোর জন্য তৎকালীন কৃষি নির্ভর অর্থনীতিটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন কবি। বুলান মণ্ডলের সঙ্গে কালকেতুর কথোপকথন কালে তা অনুভত হয়-

“শুন ভাই বুলান মণ্ডল।

আমার নগরে বৈস    যত ইচ্ছা চাষ চষ 

তিন সন বহি দিও কর ॥

হালপ্রতি দিবে তঙ্কা    কারে না করিহ শঙ্কা 

পাটায় নিশান মোর ধর।।”


তৎকালীন সমাজে অত্যাচারী জমিদাররা হাল প্রতি একটার বেশি কর নিত কিংবা পাট্টা কবুলিয়ৎ চুক্তি করত না তার প্রমাণ এতদ্বিষয়ক প্রস্তাবে রয়েছে। এই অংশ থেকে জানা যায় তখন ধান, বীজধান ইত্যাদি দাদন দিয়ে দেড়গুন দ্বিগুণ কর আদায় করা হত।


বুলান মণ্ডলের প্রতি কালকেতুর আশ্বাস-প্রদানের মধ্যে এমন ভূমি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচয় ফুটে উঠেছে। মুকুন্দরাম এই অংশে তাঁর বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। বুলান মণ্ডলকে কালকেতু আরও বলেছে—

“নাহিক বাউড়ি দেড়ি    রয়্যা বস্যা দিবে কড়ি

ডিহিদার নাহি দিব দেশে।

সেলামি বাঁশ গাড়ি    নানা ভাবে যত কড়ি 

নাহি দিব গুজরাট বাসে।।"


এমনকি বুলানকে ডিহিদারকে কর দিতে মানা করেছে। এও বলেছে প্রজারা গুজরাটে বাস করলেও কোনও কর দিতে হবে না। অতএব এটি একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা। তৎকালীন সমাজের বাস্তব ছবি এই অংশে যে ফুটে উঠেছে সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার উপায় নেই।


আর পাঁচটা সাধারণ বধূর মত ফুল্লরা গৃহবধূ, সাদা সিধা। সে স্বামী সোহাগনী। ছদ্মবেশিনী চন্ডিকাকে দেখে তাই সে সতীন ভয়ে ভীত উৎকণ্ঠা হয়ে উঠেছিল। চণ্ডীর আত্মপ্রকাশের পরও তার আশঙ্কা দূর হয়নি। কারণ চণ্ডী দেবী হলেও নারী তো বটে। দেবী কালকেতুকে সাতকোটি মূল্যের আংটি দিতে চাইলে ফুল্লরা কালকেতুকে তা নিতে নিষেধ করে—

“একটি অঙ্গুরী নিলে হবে কোন কাম। 

সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম।।”


কালকেতু ফুল্লরার এ উপদেশ অমান্য করে অঙ্গুরী গ্রহণ করলো যা মুরারি শীলের নিকট বিক্রি করে তার সাতকোটি ধনপ্রাপ্তি হল। অবশেষে গুজরাট নগর স্থাপন করলো ও রাজা হল । কালকেতু স্ত্রীবুদ্ধিকে আমল দেয়নি বলেই তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় থেকেছে। রাজা কালকেতুর অতুল বৈভবের মধ্যে ফুল্লরা রাণী হয়ে বসল, যার সঙ্গে পশারিনী ফুল্লরার কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।


অবশ্য ফুল্লরার সক্রিয়তা বিশেষভাবে দৃষ্ট হয় কালকেতুর চরম বিপদ-মুহূর্তে। কলিঙ্গরাজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত কালকেতুকে সে গোলা ঘরে লুকিয়ে থাকতে পরমার্শ দিয়েছে। কৃ ট চক্রী ভাঁড়ু দত্ত কৌশলে ফুল্লরার কাছ থেকে ধান্য ঘরে কালকেতুর আত্মগোপনের কথা বুঝতে পেরে সৈন্যদের জানিয়ে দেয়― ফলে কালকেতু কলিঙ্গ সৈনদের হাতে বন্দী হয়। কালকেতু ফুল্লরার উপদেশ গ্রহণ করায় পরাজিত হয়ে বন্দী হয়েছে।

“এমন সময়ে আসি ফুল্লরা সুন্দরী। 

গলাতে কুড়ালি বান্ধি করহে গোহারি।।”


পরিশেষে বলতে হয় কালকেতুর প্রতি ফুল্লরা উপদেশ বর্ণনার ভঙ্গিমায় কবিকঙ্কন ফুল্লরাকে ছোট করতে চাননি। স্ত্রীবুদ্ধির বিন্যাস ঘটিয়েছেন মাত্র। তাছাড়া ফুল্লরার মধ্য দিয়ে মধ্যযুগীয় স্ত্রী-বুদ্ধির প্রতি বক্রোদৃষ্টিপাত করেছেন। তিনি যে সমাজ সচেতন বাস্তবজ্ঞান সম্ভৃ ত তার বহিঃপ্রকাশও ঘটিয়েছেন।


মুকুন্দরাম ফুল্লরার কোটালের কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষা অংশে ফুল্লরার প্রতি স্বামী প্রীতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু রাণী চরিত্রের সঙ্গে কোনও সঙ্গতি স্থাপন করেননি। মুকুন্দরামের কলমে ফুল্লরা রাজ রাণীরূপে ব্যর্থ।