সামাজিক নাটকের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য সহ একটি বাংলা সামাজিক নাটক নিয়ে আলোচনা করো।

সামাজিক নাটক বলতে মূলত বোঝায় এমন এক ধরনের নাটক যার বিষয় কোনো সামাজিক সমস্যা। সেদিক দিয়ে যেসব নাটক সমস্যা প্রধান নাটক হিসাবে চিহ্নিত, সেই সব নাটকের সমস্যার প্রকৃতি সামাজিক হলে তাদের সামাজিক নাটকরূপে চিহ্নিত করাই শ্রেয়। তাই বাস্তববাদী আন্দোলনে উদ্ভূত নাটকগুলো এই শ্রেণিভুক্ত। যদিও এ বক্তব্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয় তবুও বলতে হবে, বিভিন্ন সময়ের যেগুলি প্রধান সমস্যা সেগুলিকে অবলম্বন করে লেখা নাটককেই বলতে হবে সামাজিক নাটক। যেমন ঊনবিংশ শতকে প্রধান সমস্যা ছিল (কৌলীন্য) প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি। এইসঙ্গে ছিল অন্তঃসারশূন্য জমিদারদের আভিজাত্যবোধ এবং এই রকম দুই পরিবারের বংশানুক্রমিক লড়াই প্রভৃতি। পরবর্তীকালে সামাজিক সমস্যার পালাদল ঘটেছে। যৌথ পরিবারের অবলুপ্তি এবং সংসার ক্রমশ ছোটো থেকে আরও ছোটো করার প্রবণতাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রকট। এরফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলি এখনও ব্যক্তিগত সমস্যা হয়েই আছে, কিন্তু পরে তা বৃহত্তর সামাজিক সমস্যারূপে দেখা দিতে পারে। তাই এথেকে উদ্ভূত নাটকগুলিও সামাজিক নাটক।


বাংলা সাহিত্যে প্রথম সামাজিক নাটকরূপে উল্লেখ করতে হয় রামনারায়ণ তর্করত্নের— ‘কুলীনকুলসর্বস্ব'কে (১৮৫৪)। সেকালে কুলীনদের বহুবিবাহ ছিল অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা এবং এই সমস্যাকে তাঁর এই জনপ্রিয় নাটকে তুলে ধরা হয়েছিল। এছাড়া তাঁর বহু সামাজিক প্রহসনও আছে যেমন— বহু বিবাহের দোষ নিয়ে লেখা ‘উভয় সংকট’, স্বামীর লাম্পট্য নিয়ে লেখা, ‘চক্ষুদান' ইত্যাদি। তাঁর একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নাটকও ছিল— ‘নবনাটক’। এটি নাটক হিসাবে ত্রুটি মুক্ত, রামরামায়ণের নাটকের কথা বাদ দিলে নাম করতে হয়—শ্রীপতি মুখোপাধ্যায়ের—‘বাল্যবিবাহ নাটক’, তারকচন্দ্র চূড়ামণির—‘সপত্নী' নাটক, হরিমোহন মুখোপাধ্যায়ের—'কাদম্বিনী নাটক' এছাড়া মধুসূদন দত্তের–‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’, ‘একেই কি বলে সভ্যতা'। দীনবন্ধু মিত্রের—'নীলদর্পণ’, ‘সধবার একাদশী’, ‘জামাই বারিক’ ইত্যাদি নাটক এই পর্যায়ভুক্ত। পরবর্তী কালের বহু নাট্যকার সামাজিক সমস্যামূলক নাটক রচনা করে বিশেষ কৃতিত্ব রেখেছেন।


একটি বাংলা সামাজিক নাটক :

গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘প্রফুল্ল’ নাটককে বাংলা সার্থক সামাজিক নাটকরূপে আলোচনা করা যেতে পারে। এর কাহিনি হল, অল্পবয়সে পিতৃহারা যোগেশ নিজে প্রচুর কষ্ট করে বিধবা মা এবং দুটি নাবালক ভাই রমেশ ও সুরেশকে মানুষ করার চেষ্টা করেন। জীবনে তিনি সৎ পথে থেকে, ন্যায় নিষ্ঠাভাবেই প্রতিষ্ঠিত হল, মেজোভাইকে ওকালতিও পাস করান। ছোটো ভাই সুরেশকে পড়াশোনায় কৃতী করতে না পারলেও অমানুষ হতে দেননি। সেই সময়েই সংসারে বিপর্যয় দেখা দেয়, তাঁর ব্যাংক ফেল করে এবং তিনি সর্বশান্ত হন। তাঁর এই দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে মেজো ভাই রমেশ তাঁকে দিয়ে বাড়ি ও সম্পত্তি লিখিয়ে নেয় নিজের নামে এবং পথের একমাত্র কাঁটা যোগেশের একমাত্র পুত্র যাদবকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করে, সেইসঙ্গে মিথ্যা চুরির অপরাধে সুরেশকে জেলে ঢোকায়। যোগেশ মদ্যপানে বিভোর হয়ে সমস্ত ভুলে যাবার চেষ্টা করেন। সংসারের প্রতি দৃষ্টি না থাকায় তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। ছোটো ছেলের শোকে মা উদাসিনী হন—শেষে যাদবকে মারার অপকীর্তি রোধ করতে এসে রমেশের স্ত্রী প্রফুল্লও মারা পড়ে। নাটকটি এভাবেই পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।


এ নাটকের সমস্ত বিষয়ই সমাজ থেকে সংগৃহীত। এবং সামাজিক সমস্যার দ্বারা এ-নাটকের গতি নির্ণীত হয়েছে। প্রথমে যোগেশের পিতৃহারার জন্য নাবালক ভাইদের মানুষ করা এবং ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করা, পরে ব্যাংক ফেল সমস্তই সামাজিক সমস্যার অঙ্গ বিশেষ। অতঃপর মেজোভাই রমেশের চক্রান্তে যোগেশের সংসারে যে দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনীভূত হয়েছে তাও আমাদের পারিপার্শ্বিক চিত্রকলায় সচরাচর দৃষ্ট হয়। প্রফুল্লর মতো ভ্রাতৃবধূ, লক্ষ্মীমন্ত গৃহবধূ‌ একান্নবর্তী পরিবার দুর্লভ নয়। বড়োভাই যোগেশের কর্তব্যপরায়ণতা, শেষে জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে মত্ত মদ্যপ হওয়া সামাজিক জীবনে অসম্ভব কিছু নয়। সমস্ত সম্পত্তিকে শয়তানী করে গ্রাস করার জন্য ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারকে শেষ করা এই সামাজিক সমস্যাটি যাদবের ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। ফলত বিষয়ের বিচারে তো বটেই রূপায়ণের ক্ষেত্রেও আমরা প্রফুল্লকে মোটামুটিভাবে শিল্প সফল সামাজিক নাটক হিসাবে মেনে নিতে পারি।