“শাক্ত কবি মাত্রেই ভক্ত এবং তাদের সব পদেই এক ধরনের আকুতির প্রকাশ ঘটেছে।” – ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পাঠ্যপদ থেকে উপযুক্ত উদ্ধৃতি দিয়ে এই আকুতির স্বরূপ ব্যাখ্যা করো।

শাক্ত পদাবলির দুটি ধারা– একটি 'উমাসঙ্গীত তথা আগমনী বিজয়ার গান, অপরটি ‘শ্যামাসঙ্গীত'। একটিতে জগজ্জননীর রূপ অপরটিতে ভক্তের আকৃতি বর্ণিত হয়েছে। সমস্ত শাক্ত পদাবলিতে মাতা-সন্তানের পারস্পরিক সম্পর্কটিই প্রকাশিত। সস্তানের প্রতি মাতার স্নেহ ‘বাৎসল্যরস' এবং জননীর প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রতিবাৎসল্যরস’ মূলত ভক্তিরসেরই আধার তা ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পদগুলি বিশ্লেষণ করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।


বিশেষত 'আগমনী-বিজয়া' পদে সন্তানের প্রতি মাতার যে অপত্যস্নেহ তা বাৎসল্য রসেরই পরিচায়ক আবার ‘ভক্তের আকুতি'তে জননীর প্রতি সন্তানের যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ভক্তির নিদর্শন। মাতৃপদে আশ্রয় গ্রহণের জন্য আর্তি এখানে লক্ষ্যণীয়। রামপ্রসাদ এই সংসারকে কয়েদখানা দেখেছেন। দুঃখের দারুণ অভিজ্ঞতায় মন বৈরাগ্যে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। মাতৃচরণে স্থান নেওয়ার কী করুণ চেষ্টা—

“যে ভালো করেছ কালী, আর ভালোতে কাজ নেই। 

ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা, আলোয় আলোয় চলে যাই।”


শাক্তপদে ভক্ত-হৃদয়ের আন্তরিক অনুরাগের যে রূপ স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটেছে তা বড়োই বিচিত্র ও গভীর। বলা বাহুল্য, শাক্তপদে ভক্তির স্বরূপ উদ্ঘাটনই পদকর্তাদের অভিপ্রায় ছিল, তাঁদের সাধন-তত্ত্বের স্বরূপ প্রকাশ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির বিবরণ দানের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না।


ভক্ত কবিরা তাঁদের মাতৃকা আরাধনায় একজাতীয় আকৃতির প্রকাশ ঘটালেন। এই আকৃ তির প্রকাশ একপ্রকার মানবের আকৃতি। শাক্ত পদে এই আকৃতি নানা মাত্রা পেয়েছে।

  • ১। কামনা বাসনা ও বিপর্যয় থেকে মুক্তির আকৃতি। 
  • ২। মাতৃচরণ নির্ভরতার মাধ্যমে দুঃখ জয় করার আকৃতি।
  • ৩। ‘দেবতাকে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা' করার আকৃতি।

শাক্ত কবিরা শক্তিদেবীর আরাধনায় বসে কামনা বাসনার বাঁধন থেকে মুক্তি পাবার আকৃতি বারবার প্রকাশ করেছেন।

“মাগো তারা ও শঙ্করী

কোন অবিচারে আমার পরে করলে দুঃখের ডিক্রি জারি? 

এক আসামী ছয়টা প্যাদা, বল মা কি সাপাই করি।"


ভোগবাসনায় মৰ্ত্তমানব জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তাৎকালীন সমাজে বাঙালির জীবনকে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার বিশৃঙ্খলায় সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে দিত না। ফলে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল সমকালীন জীবন। সেই বিপদ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য শাক্ত কবিরা শক্তিদেবীর চরণে দুঃখ জয় করার আকৃতি বারবার প্রকাশ করেছেন।


সন্তান যেমন মায়ের কাছে আবদার করে, মান-অভিমান করে নিজের অস্তরের আর্তি জানায়, রামপ্রসাদও তেমনি নিজের আরাধ্য দেবীর কাছে অভিমান প্রকাশ করেছেন এবং নানাভাবে নিজের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন—

“মা, খেলবি বলে, ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতল

এবার যে খেলা খেলালে মাগোঁ, আশা না পুরিল।।”


এই অভিমান আরও তীব্র হয়েছে সাংসারিক অভাব-বেদনার আঘাতে –

“আমি তাই অভিমান করি, আমায় করেছ গো মা সংসারী।

অর্থ বিনা ব্যর্থ যে এই সংসার সবারি।”


নিজের মধ্যে ভক্তিভাবের গভীরতায় কখনো কখনো ব্যত্যয় ঘটে যায় এবং মায়ের প্রতি অভিমান আরও তীব্র হয়। কমলাকাস্তের মতো সাধকও তখন অভিমান প্রকাশ করেন–

“জানি, জানি গো জননি, যেমন পাষাণের মেয়ে !

আমারই অন্তরে থাক মা, আমারে লুকায়ে ॥”


সংসারে প্রবৃত্তিই হল সকল দুঃখের মূল, এই সত্য জেনে প্রবৃত্তি নিরোধ করতে চেয়েছেন শাক্ত কবিগণ। কখনো সাহসের সঙ্গে মৃতুঞ্জয় শিবের মতন দুঃখ জয়ের চেষ্টা করেছেন আবার কখনো দুঃখে কাতর হয়ে সেই দুঃখে সান্ত্বনা পাবার আর্তি প্রকাশ করেছেন মায়ের কাছে –

“ব্রহ্মময়ী কর্মডুরি দে মা কেটে

প্রাণ যাবার বেলা এই করো মা, ব্রহ্মরন্ধ্র যায় যেন ফেটে ॥”


অর্থাৎ ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে প্রাণ বেরিয়ে গেলে কর্মডুরি ছিন্ন হয়, জীবকে আর জন্ম-জরা মৃত্যুর ত্রিতাপ দুঃখের আবর্তনে ফিরে আসতে হয় না। কিন্তু জীবন থেকে এমন চিরন্তন মুক্তির কথা শাক্তসাধকদের গানে অনুরণিত খুব বেশি হয়নি।


নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ও সংসার গারদ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে –

“তারা কোন অপরাধে,

এই দীর্ঘমেয়াদে,

সংসার গরাদে থাকি বলি 

মসিল ছয় দূত,

তসিল করে কত,

দারাসুত পায়ের শৃঙ্খল।”


ভগবানের আকৃতির মধ্যে মিশে আছে অবোধ শিশুর সারল্য ও মান-অভিমান। সাংসারিক জীবনে মা না হলে যেমন অবোধ শিশুর চলে না, তেমনই জাগমুক্তির সাধনায় কবি রামপ্রসাদেরও জগজ্জননীকে না হলে চলে না। কমলাকাস্তের প্রার্থনাও মায়ের অভয়পদ–

"মা না করি নির্বাণে আশ,

না চাহি স্বর্গাদি বাস,

নিরখি চরণ দুটি হৃদয়ে রাখিয়ে।”


সংসারের কর্মে অনেক সঙ্কীর্ণতা ক্লেদ পঙ্কিলতা থাকে। তাই আমাদের দুঃখের কারণ হয়। শাক্ত পদকাররা সেই দুঃখের কারণ থেকে মুক্তি চেয়েছেন, মায়ামোহ যুক্ত দেহ সত্তা আত্মার ওপর আবরণ রচনা করে। শাক্তসাধক ভক্তসাধক। ভক্তি বিশ্বদলেই তার মাতৃসাধনা। তাই জ্ঞানের আলোকে ভক্তির রসে অস্তরের মুক্তি খুঁজেছেন। তাই গেয়েছেন—

“আমায় দে মা পাগল করে ব্রহ্মময়ী! 

আর কাজ নাই জ্ঞান-বিচারে।”


অতএব শাক্ত কবিরা “সে যে ভাবের ভাবী, ভাব ব্যতীত অভাবে কি ধরতে পারে ?” তাই তাঁদের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ভাবরসের সাধনার কথা। তান্ত্রিক প্রক্রিয়ামূলক শক্তিসাধনার পরিবর্তে বাৎসল্য প্রতিবাৎসল্য রসের মাতৃসাধনায় অন্তরের ভাবকেই ব্যক্ত করেছেন তারা। এককথায় শাক্ত সাধকদের আকৃতি মাতৃস্নেহের জন্য, মায়ের চরণে শাস্তির আশ্রয়ের জন্য। শাক্ত ভক্তের আকৃতির এই হল মূল পরিচয় এবং তৎকালীন বাঙালির মনের সত্য আকৃতি।