“শুধু কালকেতু নয়, ফুল্লরা, মুরারিশীল বা ভাঁড়ু দত্ত পরিবেশের উপযোগী সত্যতায় স্পন্দমান।”— তোমাদের পাঠ্য কাব্যাংশ অবলম্বনে মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

মধ্যযুগের সমগ্র মঙ্গলকাব্য জুড়ে একজন মাত্র স্রষ্টা আপন বৈশিষ্ট্য ও গুণে ধ্রুবতারার ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন তিনি হলেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম। তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে যে চরিত্রগুলি অঙ্কন করেছেন তা বড়ই বিস্ময়কর। মর্তের মানব চরিত্র অঙ্কনে তিনি যে দক্ষতা, বাস্তবজ্ঞান এবং দর্শনশক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে তাঁকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের 'কবিকূল চূড়ামণি' রূপে আখ্যাত করাই শ্রেয়। সমলোচক বলেছেন-

“মুকুন্দরাম যদি একালে জন্মাতেন

তাহলে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ

ঔপন্যাসিক রূপে আখ্যা পেতেন।”


বস্তুত মধ্যযুগের পরিবেশকে নিয়ে এমন বাস্তবসম্মতরূপ সৃষ্টিকরা মুকুন্দরামের মতো প্রতিভাশীল কবির পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে 'অন্নদামঙ্গল' এর কবি ভারতচন্দ্রের কথা মনে আসে। সমালোচক ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন— “ভারতচন্দ্র চরিত্র চিত্রণে ততটা সার্থক নহে যতটা মণ্ডন কলায় কুশলী। মুকুন্দরামের রচনা রীতিতে চারুত্ব ও বক্রতার অভাব আছে কিন্তু বিচিত্র চরিত্র চিত্রণে সে ত্রুটি ঢাকিয়া গিয়াছে।”


কালকেতুর চরিত্র বিশ্লেষণে উক্ত বক্তব্যটির সত্যতা ধরা পড়ে। কালকেতু কাব্যের নায়ক। নায়কের মতই তার বীরত্ব। সমগ্র অরণ্য জগতের মধ্যে সে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। স্বয়ং কলিঙ্গরাজও তার কাছে পরাভব স্বীকার করেছে। বাস্তববাদী কবি মুকুন্দরাম কালকেতু - চরিত্রকে সৃষ্টি করে তাকে ব্যাধ জাতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে সন্নিবেশিত করেছেন। পুত্র এবং স্বামী এই দুই মানবীয় সম্পর্কের সূত্রে কালকেতু বৈশিষ্ট্যময়। পুত্র হিসাবে কালকেতু পিতা-মাতার অনুগত। পিতা-মাতার কাছে সে দায়িত্বশীল পুত্র। স্বামী হিসাবে কালকেতু আদর্শবান। স্ত্রী ফুল্লরাকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। যেদিন শিকার পায় না সেদিন ফুল্লরার কথা ভেবে কালকেতুর কণ্ঠে উদ্বেগ ঘনায়—

“দুখিনী ফুল্লরা মোর আছে পতি আশে।

কি বলিয়া দণ্ডাইব যেয়্যা তার পাশে।”


কালকেতুর ভোজন দৃশ্যে দেখা যায়—

“চারি হাড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ।

ছয় হান্ডি মুসুরী সুপ মিশ্য তথি লাউ৷৷

ঝুড়ি দুই তিন খায় কচু ওল পোড়া।

কচুর সহিত খায় করঞ্জা আমড়া।।”


এই উক্তির মধ্য দিয়ে বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে। বাঙালী যে সত্যই ভোজনরসিক তা স্পষ্টই দেখতে পাওয়া যায়।


কালকেতু সহজ সরল সাংসারিক মানুষ। তাকে মানব চরিত্র সম্পর্কে কখনই বিজ্ঞ বলে মনে হয় না কবি বোধ হয় তাকে একজন স্বাভাবিক মানুষরূপে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ছন্দবেশিনী চণ্ডীর আগমনের কথা প্রকাশ করে ফুল্লরা কালকেতুর চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ ব্যক্ত করলে কালকেতু প্রতিবাদ জানিয়ে বলে।

“পরস্ত্রী দেখিয়া যে নিদয়া জননী।”


কাব্যাংশে দেখা যায়, কালকেতু মূর্খ হলেও সহজ বিষয় সহজভাবে বুঝতে জানে। দেবী প্রদত্ত আংটিটা যখন সে চতুর বেনে মুরারি শীলের কাছে গিয়ে সঠিক অর্থ না পেয়ে, কোনও তর্কে না গিয়ে স্পষ্টই বলেন—

“খুড়া মূল্যা নাহি পাই

যে জন দিয়াছে ইহা তার ঠাঁই যাই।”


সমগ্র কাব্যে কালকেতু চরিত্র যেসব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তা তার ব্যাধ জীবনের প্রতি সঙ্গতি রেখেই। যেমন-অরণ্য জীবনে ঘোড়ার পা টেনে আছাড় মারা, প্রবল মুষ্ঠাঘাতে বাঘের দাঁত ভেঙে দেওয়া। এছাড়া যখন স্ত্রী ফুল্লরার সাথে বচসায় লিপ্ত হয় তখন সাংসারিক জীবনের দরিদ্র স্বামীর কিংকর্তব্যবিমূঢ় রূপটি ফুটে উঠেছে।


কালকেতুর মতো ফুল্লরার জীবনের জন্ম থেকে প্রতিটি স্তর চণ্ডীমঙ্গলে চিত্রিত হয়নি। ফুল্লরা সরলা গৃহকর্মে নিপুণা বাস্তব এক নারীসত্তা। দেবী চণ্ডী যখন এক রমণী বেশে তার গৃহে অবস্থান করেছেন তখন ফুল্লরার শাস্ত সরল জীবনে ঝড় উঠেছে। স্বামীকে নিন্দা ও সন্দেহ করতে দ্বিধা করেনি। সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো ফুল্লরার চরিত্রে সহনশীলতা, ভারতীয় নারী জগতের পরিলক্ষিত হলেও উচ্চবর্ণের সঙ্গে তার জীবন চেতনার বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। যৌথ জীবনের যৌথ দায়িত্ব পালনের দাম্পত্য জীবনের শাস্তির মূল নিহিত। নিজের দায়িত্ব পূর্ণভাবে বহন করে বলেই স্বামীর প্রতি তার নিশ্চিত নির্ভরতা। নিজের দৃঢ় বিশ্বাস থেকে সে ছদ্মবেশিনী চণ্ডীকে পরামর্শ দেয়—

“সতীনে কোন্দল করে দ্বিগুণ বলিবে তারে

অভিমানে ঘর ছাড় কেনি। 

যদি কর বিষপান আপনি ত্যাজিবে প্রাণ

সতীনের কি বা হবে হানি।।”


মধ্যযুগীয় সাহিত্য সৃষ্টিতে টাইপ চরিত্র নির্মাণই প্রধান্য পায়। ভাঁড়ুদত্ত একটা টাইপ চরিত্র, হলেও তার মধ্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী স্বাতন্ত্র্য দেখিয়েছেন। ভাঁড়ু দত্ত তার ভাবনায়, শঠতায়, কর্মে, চক্রান্তে জীবন্ত এক শয়তানের প্রতিমূর্তি। চারিত্রিক বিশিষ্টতায় বাস্তব হয়ে উঠেছে। ভাঁড়ু কূটকৌশলী, ষড়যন্ত্রী—তাই সে অনায়াসে ফুল্লরার কাছে গিয়ে মিথ্যা বাক্য বলেছে—

“কহিনু অনেক ন্যায়   খন্ডিল সকল দায়

ভয় কিছু না করিহ মনে।

মনে পেয়্যা পরিতোষ   ফেনিল সকল দোষ 

বীরকে করিব সেনাপতি।।”


আবার কালকেতুর কাছে ভেট নিয়ে হাজির হয়ে বলেছে—

“তুমি খুড়া হৈলে বন্দী অনুক্ষণ আমি কান্দি 

বহু তোমার নাহি খায় ভাত।।”

এই হল ভাঁড়ু দত্তের দু মুখী পরিচয়।


পরিশেষে বলা যায়, কালকেতুর কাহিনি মধ্যযুগীয় মঙ্গল সাহিত্যের অপূর্ব সৃষ্টি। কবিকঙ্কণ জীবনের সুখ দুঃখময় সংসারের দারিদ্র্যের ঘাত প্রতিঘাতময় বিশ্বাস যোগ্য ছবি এঁকেছেন। মুকুন্দরাম তাঁর কবি প্রতিভার সাহায্যে সীমাবদ্ধ আবেষ্টনীর অনেক ঊর্ধ্বে মানব জীবনের স্বচ্ছন্দলীলা ভূমিতে বিচরণ করেছেন। একটি বিশেষ যুগের সমাজ চেতনা ও মানবমানবীর জীবন তরঙ্গের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলেও তিনি সেই সীমাবদ্ধ কালকে পেরিয়ে চিরকালীন মানব জীবন ধর্মকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।