একরাত্রি গল্পের নায়কের জীবনে ‘একরাত্রি' কীভাবে অনন্ত রাত্রির ব্যঞ্ছনা নিয়ে এসেছে তা আলোচনা করো।

সুরবালা ছিল গল্প কথকের বাল্যসাথী। যখন তাকে পাওয়া সহজ ছিল, তখন নায়ক পতিত ভারতবর্ষের চাঁদা আদায়কার্যে ব্যস্ত, ম্যাটসিনি-গ্যারিবল্ডি হবার স্বপ্নে বিভোর। দেশোম্বার কার্যের বিরাট আহ্বানের তলায় সেদিন গ্রাম্যবালিকা সুরবালার নীরব আকর্ষণ চাপা পড়েছিল। একদিন সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের সঙ্গে সুরবালার বিয়ে হয়ে গেল। আর নায়কেরও একদিন দেশের কাজ শেষ হল। পিতার মৃত্যু হওয়ায় তার ওপর এসে পড়ল মা ও ঘরের দায়িত্ব। যে একদিন গ্যারিবল্ডি হবার স্বপ্ন দেখত, সে হল নোয়াখালি বিভাগে একটি ছোটো শহরে এন্ট্রান্স স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার। সেই গ্রামেই সুরবালার শ্বশুরবাড়ি। সেকেন্ড মাস্টার একদিন রামলোচনবাবুর বাড়ি যায় এবং ‘পাশের ঘরে অত্যন্ত’ মৃদু একটু চুড়ির টুং টাং কাপড়ের একটুখানি খশ্ খশ্ শব্দ শুনতে পায়, অনুভব করে সুরবালার অদৃশ্য উপস্থিতি। সেদিনের অনায়াস লভ্যা সুরবালা আজ অপ্রাপণীয়া। মন তোর দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়। সে ভাবে সুরবালা তার কী না হতে পারত। কিন্তু আজ সে কত দূরে। আজ তার সঙ্গে দেখা হওয়াই শক্ত, তার সঙ্গে কথা বলায় দোষ, তাকে চিন্তা করা পাপ।


সেই দরিদ্র সেকেন্ড মাস্টারের জীবনে একদিন এল একটি মধুময় অনন্ত রাত্রি। সে রাত্রি বিকট বজ্র-গর্জনে ভয়াবহ, অবিশ্রান্ত বর্ষণে মুখর। সেই দুর্যোগের রাতে রামলোচনবাবু মোকদ্দমার কাজে বাইরে গিয়েছিল। রাত যখন একটা দেড়টা, শোনা গেল বন্যার কল্লোল। সমুদ্র যেন সর্বগ্রাসী পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। স্কুলের কাছেই ছিল একটা পুকুর, যার পাড় খুব উঁচু। সেকেন্ড মাস্টার পাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিল, আর অন্যদিক থেকে কাছে এসে দাঁড়াল সুরবালা। চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। বর্ষণেরও বিরাম নেই। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দুজনেই নীরব। পদতলে উদ্দাম গতি প্রলয় বন্যা। মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধ সেই ঘনান্ধকার রাতের অবসান ঘোষণা করে যখন দিনের সূর্য উদিত হতে চলেছে তখন সুরবালা নিঃশব্দ পদক্ষেপে চলে গেল। গল্প কথক বা নায়ক সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবল—‘আমি এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার, আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হইয়াছিল—আমার পরমাণুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটি মাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।


রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, মানুষের জীবন এবং সেই জীবনের সার্থকতা পৃথিবীর সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলন ও আলোড়নের ঊর্ধ্বে। জীবনের এবং মনের স্বাভাবিক চাহিদাগুলোকে তৃপ্ত না করে ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। ‘একরাত্রির নায়ক’ একদিন দেশপ্রেমের নেশায় প্রতিজ্ঞা করেছিল, আজীবন বিবাহ না করে দেশ সেবা করে যাবে। সেই প্রতিজ্ঞার স্বাভাবিক পরিণামে যা ছিল জীবনে সুলভ, তা দুর্লভ হয়ে উঠল। স্বপ্ন যখন শূন্যে বিলীন হয়ে গেল তখন সেকেন্ড মাস্টারের পদে অধিষ্ঠিত নায়কের একমাত্র অবলম্বন অতীত দিনের স্মৃতি রোমন্থন। সে স্মৃতির অবলম্বন সুরবালা। জীবনের অনেকখানি সময় সে বিভিন্ন কাজে ব্যয় করেছে। কিন্তু প্রকৃত শান্তির সন্ধান পায়নি। যে রাতে তার স্বপ্নসৌধের সমস্ত দুয়ারগুলি ঝড়ের হুঙ্কারে ভেঙে গেল তখন সে এসে দাঁড়াল নির্জন রাতের অন্ধকারে। তার পদতলে তখন গর্জন করেছে প্রলয়ঙ্কর বন্যা, মাথার ওপর আকাশ জোড়া অন্ধকার। সেই রাতে সুরবালা এসে দাঁড়াল তার পাশে। সুরবালার নির্বাক উপস্থিতি সেই রাত্রিকে অনন্ত রাত্রির মর্যাদা দিয়েছে। নায়কের কাছে এই একটিমাত্র রাত্রি তার জীবনের অনেক রাত্রির চেয়ে অধিকতর মূল্যবান। সার্থকতায় এ রাত্রি অনন্যা। এই রাত্রিতেই নায়ক খুঁজে পেয়েছে জীবনের পরম চরিতার্থতার ঠিকানা, এই একটি রাত্রিই তার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র সার্থকতা। এই রাত নায়কের জীবনে ক্ষণ-শাশ্বত সত্যের উজ্জ্বল উদ্ভাসনে জ্যোতিষ্মান। একটি তুচ্ছ জীবনের মধ্যে যে পরম আশ্চর্য সম্পদ লুকিয়ে ছিল রবীন্দ্রনাথ তাকেই একটি প্রলয়ঙ্কর রাত্রির সংকীর্ণ ভূখণ্ডে চিরন্তন করে তুলেছেন।


এমনি করেই ছোটোগল্পের কুশলী লেখক জীবনের খণ্ডাংশের মধ্যে সমগ্রকে প্রতিফলন করেন, এমনি করেই নিটোল শিশিরবিন্দুর মধ্যে সীমাহীন আকাশের মহিমা আত্মপ্রকাশ করে। ছোটোগল্প লেখকের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব এখানেই।