বাংলা নাট্যসাহিত্যে তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭ খ্রীঃ–১৯৫৯ খ্ৰীঃ)

বাংলা নাটকে তুলসী লাহিড়ী


নট-নাট্যকার-পরিচালক ও গীতিকার তুলসীদাস লাহিড়ী বাংলা নাট্য সাহিত্যে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রথমে গণনাট্য এবং পরে নবনাট্যে বহুরূপী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হন। সৎ আদর্শ প্রবণ জীবনধর্মী নাটক রচনার সূত্রপাত হয়। জন্মস্থান রঙ্গুরের অভিজ্ঞতা, পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি, কৃষিজীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের মন্বস্তরের কঠিন আঘাত, বিশেষ আদর্শবোধ ও মূল্যবোধে আস্থা তাঁকে সৃষ্টিশীল নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত করে।


তুলসী লাহিড়ীর জন্ম ও কর্মজীবন:

১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে (১৩০৩ বঙ্গাব্দে) উত্তরবঙ্গের রঙ্গুর জেলার অন্তর্গত নলডাঙ্গার এক জমিদার পরিবারে তুলসী লাহিড়ীর জন্ম হয়। পিতা সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। ন্যাশানাল স্কুলে হয় তাঁর শিক্ষারম্ভ। তারপর বি. এল. পাশ করে রঙ্গুর এবং আলিপুরে আইন ব্যবসায় যুক্ত হন। সেই কাজে সফলতা না পেয়ে সঙ্গীতচর্চা-অভিনয়-সাহিত্যসৃষ্টি প্রভৃতি নানা কাজে এবং শেষে কৃষিকার্যে আত্মনিয়োগ করেন।


প্রথমে পিতার কাছ থেকে সঙ্গীতের প্রেরণালাভ, তারপরে রঙ্গুরে শ্রীতারাপ্রসন্ন সান্যালের কাছে অভিনয় শিক্ষা, শেষে ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁর সহযোগিতায় ১৯২৯-এ হিজ মাস্টারস্ ভয়েস থেকে নিজের লেখা দু'খানা গানের রেকর্ড প্রকাশ করেন। এইভাবে সুরকার-গীতিকার-অভিনেতা রূপে তুলসী লাহিড়ীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। অতঃপর নাট্যমঞ্চে ‘স্বয়ংবরা’, ‘পোষ্যপুত্র’, ‘মন্দির’ প্রভৃতি নাটকে সুর সংযোজন করেন। প্রগতিশীল নাট্যধারার সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু, নীতি ও আদর্শগত বিরোধের ফলে ১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার সিনেমা জগৎ ও গ্রামোফোনের জগৎ ছেড়ে দিয়ে জলপাইগুড়ি জেলার অংশবিশেষে ধানজমি কিনে তুলসী লাহিড়ী চাষবাসের চেষ্টা করেন। সেই উপলক্ষেই কৃষকজীবনের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে। কৃষকদের জীবন নিয়ে সৃষ্টিশীল নাটক রচনার সূচনাও হয় এই পর্বে।


প্রখ্যাত অভিনেতা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গী হয়ে একসময় তিনি গণনাট্য সঙ্ঘের অফিসে আসেন। আবার একদিন তিনি গণনাট্য ছেড়ে এই মনোরঞ্জনের মাধ্যমেই নবনাট্য সংস্থা বহুরূপী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। গণনাট্য তুলসীর প্রথম নাটক ‘দুঃখীর ইমান’ মঞ্চস্থ করেনি, কিন্তু ‘বহুরূপী’ তুলসীর আর একটি নাটক ‘পথিক’ অভিনয় করে তার যাত্রা শুরু করেছিল। বিপরীতভাবে শ্রীরঙ্গম মঞ্চে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর পরিচালনায় ‘দুঃখীর ইমান' প্রথম অভিনয় ১২ই ডিসেম্বর, ১৯৪৬) অভিনীত হয়েছিল।


শুধু তাই নয়, সমকালের পেশাদারী রঙ্গমঞ্চেও এই নাটক নানা দিক থেকে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরে বহুরূপী গোষ্ঠী ‘ছেঁড়া তার’ নাটকটিও অভিনয় (১৭ই ডিসেম্বর, নিউ এম্পায়ার) করে তার নাট্যপোযোগিতা প্রমাণ করে। অবশ্য ‘বহুরূপী' থেকে তুলসী লাহিড়ী বেরিয়ে আসেন একসময়। পরে তিনি ‘আনন্দম্' এবং 'রূপকার' নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেন।


তুলসী লাহিড়ীর রচনাসমূহ:

নাটক : 

  • (ক) ‘দুখীর ইমান' (১৯৪৭), 'পথিক' (১৯৪৯), ‘ছেঁড়া তার’ (১৯৫৩), 'বাঙলার মাটি' (১৯৫৩), 'লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার' (১৯৫৯), ‘ঝড়ের মিলন’ (১৯৬০), 'চৌর্যানন্দ'।

  • (খ) একাঙ্ক নাটক : ‘নাট্যকার' (১৯৫৬)। 

  • (গ) প্রবন্ধ : 'নাট্যকারের ধর্ম' (১৯৬০)।


পঞ্চাশের মন্বস্তরের পটভূমিতে লেখা তুলসী লাহিড়ীর ‘দুঃখীর ইমান' নাটকটি একটি গ্রামের হিন্দু-মুসলমান কৃষক সমাজের কাহিনী। নাট্যকারের জবানীতে, উত্তরবঙ্গের “সুন্দরদীঘির সহজ সরল চাষীদের সংস্পর্শে এসে সর্বপ্রথমে তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ ও ঘাত প্রতিঘাত নিয়ে একটা কিছু লেখার ইচ্ছা মনে হয়েছিল। ধনতান্ত্রিক সভ্যতার চরম পরিণতি মন্বন্তরের দিনে এই চিরবঞ্চিত ও অবজ্ঞাতের দল, যারা ধনলোভীর লোভের যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছিল, তাদের ছবি আঁকতেই এ নাটকের সৃষ্টি” (‘নাট্যকারের নিবেদন')। পক্ষান্তরে, শিশির ভাদুড়ীকেও এক প্রশ্নের জবাবে নাট্যকার জানিয়েছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ – Synge Bernard Shaw-H. G. Wells প্রমুখ সাহিত্যিকদের রচনায় "Inspired" হয়ে তিনি এ নাটকটি লেখেন।


এই নাটকের অনতি-পূর্ববর্তী সময়ে লেখা হয় বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ (১৯৪৪)। এই দুটি নাটকের বিষয়বস্তু গণনাট্যের উপযোগী হয়েছিল। সেক্ষেত্রে এই দুই নাটকের পরিণতিগত পার্থক্য কেউ কেউ লক্ষ্য করেছেন। প্রখ্যাত অভিনেতা ও গণনাট্য বোদ্ধা সুধীপ্রধান বলেছেন—নবান্ন নাটকে “কৃষক হিরো”, কিন্তু Passive Hero। কিন্তু তুলসীবাবু আর এক ধাপ অগ্রসর হলেন।


‘দুঃখীর ইমানে’র হিন্দু-মুসলিম ক্ষেতমজুর দুজন প্রকৃত সক্রিয় ‘হিরো’, নিজেদের বিবেচনামত চেষ্টায় জীবন পরিবর্তন করে এবং সেই চেষ্টা ভদ্রলোকশ্রেণীর আইনকানুন মতে পবিত্র না হলেও মানবিকতার বিচারে গ্রাহ্য। বিজন মার্কসবাদ পড়ে যা করতে পারেন নি তুলসীবাবু না পড়ে তাই করেছেন। তুলসীবাবু মৃত্যুর আগেও আমাকে বলেছেন যে “তিনি মার্কস-লেনিনের কোন বই পড়েন নি”। ‘দুঃখীর ইমান’ নাটকের শেষে আছে অপরাধীর (ধর্মদাস) স্বীকারোক্তি। পুলিশ অফিসারের উদারতায় তার মুক্তি হয়েছে। আর সেই কারণেই গণনাট্য তাকে গ্রহণ করতে পারেনি। সুধীপ্রধানের ভাষায়, “আমাদের প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও ‘দুঃখীর ইমান’ এর শেষ দৃশ্যে পুলিশ অফিসারকে সদাশয় রূপে চিহ্নিত করায় আমরা সে নাটক গ্রহণ করতে সাহসী হইনি। কারণ জনযুদ্ধ রাজনীতির জন্য কমিউনিস্টরা আগেই বিপক্ষীয়দের দ্বারা নিন্দিত হচ্ছিল” (“নবান্ন : প্রযোজনা ও প্রভাব’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৮)।


এই নাটকের দুটি দিক লক্ষণীয়এক, এই নাটকের ভাষা এবং পটভূমি। কৃষকদের ভাষায় আঞ্চলিকতার প্রকাশ দেখা গেছে। দুই, ভাববাদী আদর্শের প্রকাশ। কোন কোন সমালোচকের মতে, এই নাটকের শেষাংশ ‘সেন্টিমেন্টাল'। তবু অপরাধীর মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা এখানে সার্থক হয়েছে।


‘দুঃখীর ইমানে’ যেমন আছে গ্রামের কৃষকের ছবি, তেমনি ‘পথিকে’ আছে কয়লাখনি অঞ্চলে একটি চায়ের দোকানকে কেন্দ্র করে খনির মালিকদের অত্যাচারের পটভূমিতে রচিত এক রোমান্টিক চিত্র। নাটকটির আলোচনা প্রসঙ্গে সুধীপ্রধানের অভিমত : ‘পথিক’ নাটকে তুলসীবাবু একদিকে কয়লাখনির সাধারণ শ্রমিকদের ধ্বংসের নীচে চাপা পড়ার কাহিনী পটভূমিকা করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালোবাজারী ও ডাকাত দলের বিরুদ্ধে এক আদর্শবাদী ভবঘুরেকে হাজির করেছেন—যিনি কোন দলের লোক নন অথচ সত্যের জন্য প্রাণ দিতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত দিলেন। অর্থাৎ তুলসীবাবুর নাটকে শ্রমিক এল বটে, কিন্তু ‘হিরো’ মধ্যবিত্ত কোন দলের নয়, এমনকি নিয়মিত ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীও নয়। “কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধা বিভক্ত হওয়ার যুগ আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রগতিশীল শিল্পজগতে তার কি প্রতিক্রিয়া শুরু হয় তা এখানে স্পষ্ট” (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১৪২)। একথা অনস্বীকার্য, নাটকের মূল সমস্যা থেকে নাট্যকার শেষ পর্যন্ত কিছুটা লক্ষ্যচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু অভিনয় গুণে নাটকটির চলচ্চিত্ররূপ জনপ্রিয় হয়েছিল।


মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা হয় তুলসী লাহিড়ীর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘ছেঁড়া তার'। এই নাটকের কাহিনী কৃষক-জীবন আশ্রিত। তবে পূর্ববর্তী নাটকের ‘দুঃখীর ইমানে’র কৃষক জীবনের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। সুধীপ্রধান বলেছেন “এ কৃষক মধ্যবিত্ত বাবুদের মত লেখাপড়া জানা কৃষক তবে গরীব। কৃষক জীবনের সাধারণ সমস্যার সঙ্গে মুসলিম সমাজের তালাকের সমস্যা তিনি যেভাবে এই নাটকে উত্থাপন করেছেন বাংলা সাহিত্যে তার কোন তুলনা আছে বলে জানি না” (“নবান্ন : প্রযোজনা ও প্রভাব’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪২)। বস্তুত, ‘ছেঁড়া তার’ নাটকে তুলসী লাহিড়ীর পূর্ববর্তী নাটক ‘দুঃখীর ইমান’ থেকে উত্তরণ ঘটেছে সহজ, সরল, আনন্দবাদের প্রকাশে। এই বিষয়ে আলোকপাত করে সমালোচক ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক দুটি নাটকের তুলনামূলক আলোচনায় বলেছেনঃ “এই ‘আনন্দবাদ’ তুলসী লাহিড়ীর নাটকের একটি প্রধান সুর। ‘দুঃখীর ইমান’ থেকে তার উদ্ভব, পরবর্তী নাটকে তার পরিণতি। এই আনন্দবাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আশাবাদ, ঈশ্বরের ন্যায়ধর্মের প্রতি অবিচল ও অটল বিশ্বাস। এটাই নাট্যকারের মূল জীবনদর্শন। প্রথম নাটকটির মাস্টারমশাই এবং ধর্মদাস চরিত্র পরবর্তী নাটকে মহিম ও রহিমে রূপান্তরিত হয়েছে” (দ্রষ্টব্য : 'তুলসী লাহিড়ী ছেঁড়া তার’, প্রথম প্রকাশ মার্চ ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)। ‘দুঃখীর ইমান’ নাটকের নিবেদন অংশে নাট্যকার লিখেছিলেনঃ “সংশয় কুহেলিকাচ্ছন্ন মন আলোর আশায় চারিদিকে চাইছে। মন নিরন্তর প্রশ্ন করছে –তিমির বিনাশন সে আলো এ-জগতে আবার আসবে কি?” এই প্রশ্ন ‘ছেঁড়া তার’ নাটকের শেষে শোনা গেছে আর একবার ফুলজানির মুখে। নাট্যকার নাটক শেষ করেছেন এইভাবে : “এর উত্তর কিভাবে, কি ভাষায় কেমন করে সর্বশক্তিমান শোনাবেন-জগৎ আজ তাই জানবার জন্য উৎকণ্ঠায় উদগ্রীব হয়ে আছে।”


তুলসী লাহিড়ীর পরবর্তী নাটক ‘বাঙলার মাটি' প্রধানত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার নাটক। এই নাটকের দুটি প্রধান চরিত্র আবু মিঞা এবং কালীবাবু। আবু মিঞাই নাট্যকারের মুখপাত্র (তুলসীবাবু নিজে এ চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন)। আবু মিঞা কয়েকটি ভাবাদর্শে ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী। তাই তার সংলাপ প্রায়শঃই বক্তৃতা-ভারাক্রান্ত। নাটকের প্রথম অঙ্কে নায়িকা চিত্রার প্রতি তাঁর উক্তি “আরে দিদি, মানুষের জ্ঞানের অতীত এক অলখ্ শক্তি যে তার ভাগ্য বিধাতা। মানুষের তদবীরে কিছু হয় না। মালিক যা মঞ্জুর করেন তাই হয়।” এই ঐশ্বরিক আস্থা —ভগবান ও মানুষের প্রতি বিশ্বাসই তার চরিত্রের ভিত্তিভূমি। তার মতে, মানুষই পারে ভগবৎ বিধানকে সুন্দর করে তুলতে: “মনে হ'য়েছে চোখের জলে মানুষের অতীতের গ্লানি ধুয়ে নির্মল হবে—শান্ত সমাহিত হয়ে—চিরসুন্দরের সাধনায় নিজে সুন্দর হবে, জগৎকে সুন্দর করবে।” এই নাটকটি শেষ হয়েছে এই রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে—“বাঙলার মাটি, বাঙলার জল, ধন্য হউক”। নাটকের নামটি এই গান থেকেই সংগৃহীত।


তাঁর পরবর্তী নাটক, 'লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার’ মধ্যবিত্ত পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে রচিত। এখানে একটি চরিত্র এক দুঃস্থ নারীকে বলেছে : “দুখের পোড় খাওয়া দুঃখীর দল সব তোমার পাশে আছে। যে দুর্নীতি দুনিয়ায় হাহাকার এনেছে, ঘরে ঘরে সর্বনাশ ছড়িয়েছে, যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে দিয়ে মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটিয়েছে, আজ নূতন করে তাকে নির্মূল করার শপথ নিয়ে, স্নেহ, দয়ামায়া, মমতা ভরা ঘর গড়ার আশা নিয়ে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে।” এই নাটকের অন্যতম চরিত্র ইন্দ্রনাথ পরিস্থিতির চাপে আত্মহত্যা করেছে। একাধিক মৃত্যুদৃশ্য বা সংবাদ এ নাটকে থাকলেও ভূমিকা অংশে শোনা গেছে আশার বাণী: “বাণী ও হরিসাধন এ যুগের তপস্বী, তাদের তপস্যা সার্থক হবে এ বিশ্বাস রাখি।” রচয়িতার দায়িত্বের দিকটি ‘নাট্যকার একাঙ্কিকায় নির্দেশিত : “যারা লাভের লোভে নানা কুকর্ম করছে ‘তারা মনুষ্যত্বের পরম শত্রু, অথচ মানুষ বারবার তাদের ক্ষমা করেছে। তাদের মুখোস খুলে দেওয়া নাট্যকারের ধর্ম।” এই নাটকটি ১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে গণনাট্য সঙ্ঘ কর্তৃক অভিনীত হয়, তুলসী লাহিড়ী স্বয়ং মুখ্য চরিত্র কমলবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেন।


তুলসী লাহিড়ীর ‘নাট্যকারের ধর্ম’ প্রবন্ধটি ১৯৬০ খ্রীস্টাব্দের ১৪–২০শে এপ্রিল কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় গণনাট্যের রাজ্যোৎসব উপলক্ষে 'স্যুভেনিরে’ প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি অন্যায়-অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে সমাজকে সচেতন করা এবং মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণগুলির প্রকাশে নাট্যচরিত্র নির্মাণের উপর জোর দিয়েছেন। ‘গণনাট্য’ না ‘নবনাট্য’ কোন্ গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য তার নাটকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দেখা গেছে, এই সূক্ষ্ম তর্কের মীমাংসায় উভয় গোষ্ঠীর সমালোচকেরা চিন্তামগ্ন। তবু সমাজসচেতন শুভচেতনায় বিশ্বাসী এই নাট্যকার আশাবাদী মানুষের যে চিত্র এঁকেছেন বাঙালী দর্শকের হৃদয়ে তা নিরন্তর প্রতিফলিত হবে এই প্রশ্নে : “আজও যারা বেঁচে আছে তারা রাত্রির সাধনা করে, প্রভাতকে বরণ করে আনবে এই আশায় উন্মুখ হয়ে দিগন্তে চেয়ে আছে, —কবে এ মেকী সভ্যতার দন্ত দূর হবে—কবে শাসন সংরক্ষণের নামে হৃদয়হীন শোষণের অবসান হবে কবে মানব সত্যসত্যই হৃদয়ধর্মী হবে—সেই আশায়।”