‘একরাত্রি' গল্পের জীবন ও প্রকৃতি এক আশ্চর্য মেলবন্ধনে গ্রথিত হয়ে জীবনকে এক অসাধারণ পূর্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছে। গল্পটির গঠন বিন্যাস বিশ্লেষণ করে বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলি বাস্তবজীবন ও প্রকৃতিলোকের অবিচ্ছিন্ন ঐক্যে বিবৃত হয়েছে একথা বার বার মনে করিয়ে দেয়। ঘটনা বিন্যাস বা চরিত্র নির্মিতির নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথের অনুভূতিময় মানব জীবনের সুখ-দুঃখের ইঙ্গিত গল্পগুলির অন্যতম প্রাণসত্তা বলে আবিষ্কৃত হতে পারে। সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট গল্পগুলির প্রকৃতি বিচার করে সমালোচক বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেছিলেন—“গল্পে চরিত্র বিন্যাস ও ঘটনা সমাবেশ একদিকে চলেছে বাস্তব নিষ্ঠার পথ ধরে, কাহিনিটুকু বলা হচ্ছে খুবই স্পষ্ট করে, গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে উপস্থিত মুহূর্তের সুখ-দুঃখগুলি গভীরভাবে আঘাত করছে পাঠকের মনে, আবার সেই সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে চিরকালের দৃষ্টিতে বর্তমানকে দেখবার একটি ইঙ্গিতও লেখক দিয়ে যাচ্ছেন।”


সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলিকে অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য সতর্ক পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার নয়। রচনারীতি এবং গঠন বিন্যাসের সূত্রে গল্পগুলির কাহিনি ও চরিত্র-বিন্যাস সব এই নতুন অনুভবে আস্বাদনবাহী হয়ে উঠেছে। তাই বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের প্রতি আলোকপাত করে লিখলেন—“গল্পগুচ্ছের রচনারীতি সরল ও সুমিত, কোথাও জমকালো নয়, কোথাও চমক লাগাবার ইচ্ছা নেই, লেখকের গলা কোথাও চড়ে না, গল্পের বিশেষ কোনো অংশে বিশেষভাবে জোর দেবার প্রলোভন থেকে মুক্ত। পাত্র - পাত্রীর মধ্যে হঠাৎ নিজে আবির্ভূত হয়ে মন্তব্য করা তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ—এরকম মন্তব্য যেখানে আছে গল্পটি নায়ক কিংবা নায়িকার নিজের মুখেই বলা।” গঠন বিন্যাসের চারুত্ব ও পরিপাট্যের দিকে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ নজর দিয়েছিলেন দেখা যায়। নিটোল গল্পের বয়ন বিন্যাসে তাঁর গল্পগুলি সুচারু শিল্পিত চেতনার এক একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


‘একরাত্রি’ গল্পের গঠন বিন্যাসের কয়েকটি স্পষ্ট পর্ব চিহ্নিত হতে পারে। প্রথম পর্বে পাঠশালায় বাল্যজীবন থেকে সুরবালার সঙ্গে খেলার সম্পর্ক ইত্যাদি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে গল্পের প্রারম্ভিক সূচনা। এই পর্বে নায়কের চোখে সুরবালা শুধুই অবহেলার পাত্রী। দ্বিতীয় পর্বে পরিবর্তিত দৃশ্যপটের উন্মোচন। নাজির সেরেস্তা হবার ইচ্ছা নিয়ে বক্তার কলকাতা আগমন ও যথা সময়ে উৎসাহের সঙ্গে দেশের জন্য উন্মাদনা প্রকাশ এই পর্বের সারবস্তু তৃতীয় পর্বের সামান্য একটা সংবাদ গল্পের পট পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করে তুলে গতি প্রবাহের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। এখানকার দুটি সংবাদ, প্রথমত পিতার আদেশ সত্ত্বেও সুরবালাকে বিবাহে অসম্মতি ও তারই পরিণতি হিসাবে উকিল রামলোচনবাবুর সঙ্গে তার বিবাহ হয়ে যাবার সংবাদ। বক্তা দেশপ্রেমের মন্ত্রে উত্তেজনা ও উন্মাদনায় এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন যে এ সংবাদ শুনেও তাঁর ভাবান্তর হল না।


চতুর্থ পর্বের গল্প কথক নিজের জীবনকে আশাভঙ্গকারী উপাত্তে এসে দাঁড় করিয়েছে। পিতার মৃত্যুর পর এন্ট্রান্স স্কুলে সেকেন্ড মাস্টাররূপে তাকে অখ্যাত পল্লি জীবনে প্রবেশ করতে হয়েছে। এখানে একটি সামান্য সংবাদ আছে পাঠকের জন্য। স্কুলের অনতিদূরেই সরকারি উকিল রামলোচনবাবুর গৃহ এবং সেখানে তার স্ত্রী সুরবালা, যে বাল্যকালে কথকের খেলার সাথি ছিল। এই ঘটনাকে অসম্ভব বলে বর্ণনা করা যায় না। সংবাদ, সমাজ ও জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে থাকে আপাতদৃষ্টিতে আকস্মিক বলে মনে হয়। ‘একরাত্রি’ গল্পের গঠন বিন্যাসের আকস্মিকতা এই পর্বে এবং গল্পের শেষ অধ্যায়ে চমৎকার শিল্প প্রকারণের ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছে। বক্তার রামলোচনবাবুর সঙ্গে কথোপকথনের সময় একটি নারীর কৌতুহলীদৃষ্টি গল্পের ভাববস্তুতে প্রবলভাবে ছায়াপাত করেছে। যাকে প্রথম থেকে অবহেলা করেছে তাকে একবার মাত্র দেখার জন্য কথকের মন বেদনায় ভরে উঠেছে।


গল্পের পঞ্চম পর্ব আরও তাৎপর্যপূর্ণ এবং কাহিনির গ্রন্থনার দিক থেকে তীব্র পরিণাম মুখী। ঝড় বৃষ্টির প্রলয়ঙ্করী বানের পরিপ্রেক্ষিতে নিজ নিজ গৃহ ছেড়ে সুরবালার গৃহাভিমুখে যাত্রা করেছে এবং বন্যার প্রকোপে পুকুর পাড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সুরবালাও সেই অন্ধকার রাত্রিতে একই স্থানে পুকুর পাড়ে এসে উপনীত হয়েছে। বক্তার অন্তরে এক অনিবচনীয় আনন্দের পরিচয় পাওয়া যায় এই পর্বের অন্তিম লগ্নে। মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পেয়েছিল সেকেন্ড মাস্টার। তাই সেই রাত্রির বর্ণনায় তাঁর যে আনন্দের সৃষ্টি করে তা তুলনাহীন। আর এই আনন্দের সুযোগ করেছিল ‘একরাত্রি' নামক এক দুর্যোগপূর্ণ রাত্রি। তাই এই গল্পের পরিকাঠামোকে বড়ো করে দেখতে প্রকৃতিকে ভালো করে দেখতে হয় এবং এরই মধ্যে এই গল্পের কাহিনি বিন্যাস বা গঠন বিন্যাস সমর্পিত।