'চলত রাম সুন্দর শ্যাম— পদটি কোন পর্যায়ের ও কার রচনা? পদটির ভাববস্তু বিশ্লেষণ করে অন্য একটি পাঠ্য পদের সঙ্গে তুলনা করো।

আলোচ্য পদটি গোষ্ঠ লীলা বা বাল্য লীলা পর্যায়ের পদ। উক্ত পদটির পদকার, হলেন— বৈব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি নসির মামুদ।


আমরা জানি বৈক্ষ্ণব সাহিত্যে পঞ্চরসের কবিতার মধ্যে মধুরসের পদের সংজ্ঞা সর্বাধিক। সে তুলনায় বাৎসল্য রসের পদের সংখ্যা অল্প।


কিন্তু সেই পদগুলি আবেগের আন্তরিকতায়, মাতৃহৃদয়ের আকুলতায় যেমন হৃদয়গ্রাহী তেমনই মর্মস্পর্শী। বাৎসল্য রসে ভগবান কৃষ্ণকে সন্তান স্নেহে লালন-পালন মুখ্য বিষয়। মূলত নন্দরাজের স্ত্রী যশোদার স্নেহ আদর যত্ন, ভর্ৎসনা, বন্ধন প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে বাৎসল্যরসের পদগুলি রচিত। বাৎসল্য রস তথা কৃষ্ণের বাল্যলীলা কেন্দ্রিক পদ রচনায় বলরাম দাসের কৃতিত্বই সমালোচকগণ সর্বাগ্রগণ্য বলে মনে করেন। কেন না বালক গোপালকে কেন্দ্র করে মা যশোদার যে স্নেহসিক্তা বাস্তবরূপ তাঁর পদাবলীতে উঠে এসেছে যার তুলনা বৈষ্ণব পদ সাহিত্যে খুব বেশি নেই। যশোদা মিনতি করছেন এভাবে—

“শ্রীদাম সুদাম দাম  শুন ওরে বলরাম

মিনতি করিয়ে তো সভারে।

বন কত অতিদূর    নব তৃণ কুশাঙ্কুর।।

গোপাল লইয়া না যাইহ দূর।।


শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা বা বাল্যলীলার পদগুলিতে মাতৃহৃদয়ের আবেগ, সন্তানের প্রতি স্নেহধারা স্বতঃস্ফূর্তও জীবন্তভাবে চিত্রিত হয়েছে। গোপাল তার সঙ্গীদের সাথে গোষ্ঠে মেতে গেলে মাতার উদ্বেগ, আকুলতা, নানা আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত জীবন্ত তুলিকায় চিত্রিত। আমাদের ঘরের কথা যেন সমস্ত দেবত্বের মহিমাকে আচ্ছন্ন করে জীবন্ত হয়ে ভরে উঠেছে। অন্যদিকে খেলার সঙ্গীদের সখ্যরসও সমানভাবে উজ্জ্বল হয়ে চিত্রিত।


“আমার শপতি লাগে   না ধাইও ধেনুর আগে

পরানের পরাণ-নীলমণি।

নিকটে রাখিয় ধেনু    পূরিহ মোহন বেণু 

ঘর বসি আমি যেন শুনি।।”

পদকর্তা মানবেন্দ্ৰ এই বাৎসল্য রসের বিখ্যাত পদটিতে গোপালের গোষ্ঠগমনের পূর্বে, মাতার নানা আকুলতা উদ্বেগের চিত্র নিপুণতুলিকায় অঙ্কন করেছেন। যশোদা গোপালকে বলছেন, আমার প্রাণাধিক নীলমণি! আমার দিব্যি রইল তুমি যেন কখনও ধেনুর আগে যেও না। আমার মনে বড় আশঙ্ক্ষা তোমার জন্য। এতো সুন্দর বাৎসল্য রস অন্যকোন কোনও পদে লক্ষিত হয়নি।


“চলত রাম সুন্দর শ্যাম

মধুর মধুর গতি সুঠাম

পাঁচনি কাচনি বেত্র বেণু

মুরলি-খুরলি গান রি।”

এটি গোষ্ঠ লীলার পদ। এখানে লক্ষণীয় শ্রীকৃষ্ণ সখাদের নিয়ে গোচারণে চলেছেন। মা যশোদা তাঁকে মোহন মূরতির বেশে সাজিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মুখে মুরলি ধ্বনি বাজে সুরে সাধা বাঁশীতে। মদনের দীপ্তিকেও যেন হার মানায় গোচারণ— কালো তাঁর সেই নয়ন মনোহর মূর্তিটি। কবি এখানে শ্রীকৃষ্ণের বেশ-পরিধান সৌন্দর্যকে খুব অল্প কথায় সুন্দর করে তুলেছেন। কবি নাসির মামুদ বৈব ভাবপন্ন মুসলমান কবি হয়েও শ্রীকৃষ্ণের গোচারণ—বেশ বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর ঐশ্বর্যময় স্বরূপ বিস্মৃত হতে পারেননি।


ঐশীশক্তির অধিকারী শ্রীকৃষ্ণ আজ লীলার ছলে সামান্য রাখাল বেশে গোষ্ঠ বিহার করেন। তাঁর লীলার অন্ত নেই। তিনি যে ভক্তের জন্য নেমে এসেছেন ধরার বুকে। গোষ্ঠ লীলার পদে কবি অনাদি অনন্ত ভগবানের লীলা-মাহাত্ম্য স্মরণ করে ধন্য হতে চেয়েছেন।


গোষ্ঠলীলা বা বাল্যলীলার পদগুলিতে মাতৃহৃদয় মথিত হলেও গোষ্ঠলীলায় শ্রীকৃষ্ণের গোচরণে যাওয়ার বর্ণনাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাল্যলীলায় সখাদের সাথে শ্রীকৃষ্ণের বন-বিহারে যাওয়ার পূর্বে মতো। যশোদার হৃদয়ে যে সন্তান কুশলচিন্তায় ব্যাকুল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গোষ্ঠলীলা এবং বাল্যলীলার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়। বাল্যলীলার মধ্যে যতটা জীবন্ত মাতার আর্তি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রকাশিত গোষ্ঠলীলায় তা একেবারে নেই বললেই চলে। অতএব একথা বলতে হয়, গোষ্ঠলীলা এবং বাল্যলীলা এক নয়, উভয়ে একে অপরের পরিপুরক।