“আঠারো শতকে নৈরাজ্যিক অবস্থার ছবি পদাবলিতে প্রতিফলিত।”—'ভক্তের আকুতি'র অন্তর্গত তোমাদের পঠিত পদগুলি অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার করো।

“সংসারের দুঃখকষ্ট পীড়িত মানবহৃদয়ের গভীর আর্তি একটা সাধারণীকৃত রূপ লাভ করেই শাক্ত পদাবলির মধ্যে কাব্যের সামগ্রী হয়ে উঠেছে।”- এই মন্তব্যটি মুখ্যভাবে অবলম্বন করে ‘ভক্তের আকুতি' শীর্ষক শাক্ত পদাবলির কাবত্ব নির্ণয় করো।


শাক্ত পদাবলি বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক লগ্নের সৃষ্টি। 'ভক্তের আকুতি’ পর্যায়ের পদগুলির কাব্যমূল বিচার করলে সে সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপট উদ্‌ঘাটিত হয়। সময়ের ঘূর্ণীঝড়ে কবিরা তন্ত্রসাধনার আশ্রয় অপেক্ষা মাতৃস্নেহক্রোড়ের আশ্রয়কে অধিকতর কাম্য মনে করেছেন। শাক্ত কবিগণ বিশ্বজননীকে শুধু মা রূপে কল্পনা করে তার সঙ্গে মান অভিমানের পালা অভিনয় করে তার ভীষণ মূর্তিকে কল্যাণী মূর্তিতে রূপায়িত করে তৃপ্তি পাননি। তাই তাঁরা মাকে মেয়েতে পরিণত করে তাঁদের ভক্তিসাধনার পরিবর্তে স্নেহবুভুক্ষার তৃপ্তি সাধনার উপায় আবিষ্কৃত করলেন।


শাক্ত পদাবলির দুটি পর্যায়। একটি 'উমা সঙ্গীত' বা 'আগমনী বিজয়া'র গান অপরটি ‘শ্যামাসঙ্গীত’ তথা ‘সাধনসঙ্গীত’। জন্ম-মৃত্যু বলয়িত দেহধারণের অসার্থকতার আক্ষেপই ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পদগুলির বৈশিষ্ট্য হলেও কবিরা সমাজকে অস্বীকার করে কাব্য লেখেননি। আকৃতির উদারতম সর্বশ্রেণির কবিরা এক মঞ্চে সমাসীন—সে মঞ্চটি থেকে মাতৃচরণের কেবল ভক্তির অর্ঘ্যই দেওয়া যায়। জীবনের প্রতি আসক্তি মানুষের সাধারণ বাসনা। এই আসক্তি মানুষের নিরুপায় আর্দ্র একটি অনিবার্য যুগযন্ত্রণায় সূত্রবদ্ধ হয়ে ভক্তের আকুতি পর্যায়ের বিভিন্ন পদে প্রকাশিত—

“তারা এবার আমারে করো পার। 

তরঙ্গে পড়েছি শ্যামা না জানি সাঁতারা ॥ 

একে দেহ জীর্ণ তরী, তাহে পাপ হইল ভারে।

কি ধরি কি ধরি, ভব জলধি অপার ॥”

কাব্যমূলে উপরিউক্ত পংক্তিগুলি প্রশংসার দাবিদার।


আন্তরিক ভক্তি, শান্তিপ্রিয় জীবন, বিদ্যাবুদ্ধি ও শিক্ষাগত উৎকর্ষ সত্ত্বেও জীবনে প্রতিষ্ঠা না পাওয়ার যে হাহাকার তা ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পদে করুণ বিলাপের আকারে প্রকাশিত। রামপ্রসাদের একটি পদে সাধারণ জীবনের করুণ অভিজ্ঞতার বেদনাময় প্রকাশ মেলে—

মাগো তারা ও শঙ্করী,

কোন অবিচারে আমার 'পরে করলে দুঃখের ভিক্রি জারি?


জীবনের আত্মবিলাপ-এর আন্তরিকতায় কবিতাটি উল্লেখযোগ্য এবং কাব্যগুণান্বিতও বটে। এই পর্যায়ের মূল সুর মাতৃচরণের প্রতি স্থির অচপল। শাক্ত কবিদের এই নিষ্ঠার অকৃত্রিম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কাব্যগুণেও উৎকর্ষতা লাভ করেছে। কিছু কিছু পদ –

“কি দিয়ে করিব পূজা, কি বল আছে আমার

তুমি গো অখিলেশ্বরী, সকলি যে মা তোমার”


সংসারে মায়ার শৃঙ্খল ছিন্ন করা বড়োই কঠিন। আবার মায়ার বন্ধনে যে সাময়িক সুখের আস্বাদ তা মরিচীকার মতোই মিথ্যা। এই জগতে মানবজীবন তাই যেন কলুর বলদের মতোই কেবল অন্ধ পাকে আবর্তিত। এই জীবন যেন ভূতের বেগার খাটার মতো।


প্রাত্যহিক জীবনযাপনের তথা মূল দেহটাকে বাঁচিয়ে রাখার উপকরণ সংগ্রহের জন্য তথ্য, শ্রম ইত্যাদির প্রয়োজন। কিন্তু সে সবই যে চিরন্তন মুক্তিসুখের বাধাস্বরূপ। রামপ্রসাদ সেই কথাটি অকুণ্ঠ স্বরে ধ্বনিত করেছেন–

“ম’লেম ভূতের বেগার খেটে

আমার কিছু সম্বল নাইকো গেঁটে 

নিজে হই সরকারি মুটে, মিছে মরি বেগার খেটে।

আমি দিন মজুরী নিত্য করি, পঞ্চভূতে খায় গো বেঁটে ॥”


মোহবদ্ধ জীবকে কবিরা নানাভাবে চিত্রিত করেছেন; এমন জীব কোথাও ‘চিত্রের পদ্মেতে পড়া' ভ্রান্ত ভ্রমর, কোথাও ভানুমতীর কুহকে মোহমুগ্ধ। শাক্ত পদাবলির ভক্তিভাব বিচিত্র, মধুর, রহস্যময়, প্রীতিপূর্ণ বিশ্বাসপ্রবণ সন্ধানে ভাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত একে ভক্তি না বলে প্রতিবাৎসল্য বলা যেতে পারে। সস্তানের সঙ্গে মাতার সম্পর্ক গভীর—তা নাড়ীর সম্পর্ক। জননীর প্রতি অভিযোগ সস্তানকে যেন দুঃখের সংসারে ডালি দেওয়ার মতো।

“কি অপরাধ করেছি মা, কেন এত শাস্তি কড়া।”


এছাড়া সন্তানের অনুযোগ মিশ্রিত অভিমান -

“মা নিম খাওয়ালে চিনি বলে কথায় করে ছলো।

ওরা মিঠার লোভে তিত মুখে সারাদিনটা গেল।”


জননীর সাড়াশব্দহীন মূক প্রকৃতি দেখে সস্তানের মনে হয় তিনি পৃথিবীর শোক দুঃখ যন্ত্রণার অতীত। শাক্ত কবির কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয় –

“মা ডাকিস নারে মন মাকে কোথায় পাবি,

থাকলে আসি দেখা দিত সর্বনাশী বেঁচে নাই।"

সস্তানের তীব্র আর্তনাদে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছে।


অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথম শাক্ত সাধনার বাহ্যিক আচার-আচরণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ভক্তিবাদের পুনরুজ্জীবন শুরু হল। একটি বিশেষ যুগে পরিবেষ্টনীর বশীভূত হয়েই তারা মাতৃ আরাধনা করেছেন। সংসারের দুঃখকষ্ট পীড়িত মানবহৃদয়ের গভীর আর্তি প্রকাশিত হওয়ায় শাক্ত পদাবলির কাব্যত্ব আভাসিত হয়েছে দর্শন তত্ত্বময়তার সঙ্গে। তবে ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদে ঐহিক জীবনের অচরিতার্থতায় ভক্তের ক্ষুব্ধ কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেলেও ত কখনই সাধারণীকৃত হয়ে বিশ্ব মানবের সার্বজননী আক্ষেপে পরিণত হতে পারেনি যতটা 'আগমনী বিজয়া' পর্যায়ে প্রকাশিত হয়েছে।